লাশ আর লাশ, সৎকারে কুলাতে পারছে না শ্মশান
এবার মৃত্যুপুরী মুম্বাই, রাত-দিন কবর খনন করছেন গোরখোদকরা!
সিবিএনএ অনলাইন ডেস্ক/ ১ মে, ২০২১ | করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে কাবু গোটা ভারত। দিন যত যাচ্ছে ততই উত্তরোত্তর বাড়ছে সংক্রমণের দাপট। স্বস্তি নেই। চারিদিকে অক্সিজেন, বেডের আকাল। অব্যাহত মৃত্যু মিছিল। ভারতের দৈনিক সংক্রমণের রেশ ইতিমধ্যে চার লাখের ঘরে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় দিনরাত এক করে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন ভারতের প্রথম সারির করোনা যোদ্ধারা চব্বিশ ঘণ্টা নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া তারা।
তবে মুম্বাইয়ে শুধু ডাক্তাররা নন, করোনার মৃত্যু মিছিলে দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছেন গোরখোদকরা। যদিও ওই কেউই চিকিৎসক নয়, প্রাণ বাঁচাতে পারে না। তবে শেষযাত্রায় মানুষকে সমাধিস্ত করতে ওদের ভূমিকা কোনও অংশে কম নয়।
মারণ করোনার দ্বিতীয় ছোবলে যখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে দিল্লি। এবার মুম্বাইয়ে ঠিক তখনই সারাদিন ক্লান্তিহীন শরীরে করোনায় মৃত মানুষদের সমাধিস্ত করতে কবর খুঁড়ে চলেছেন ওরা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাকালেই এখন দুটো ছবিই চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তা হলো, হাসপাতালগুলিতে ঠাঁই নেই রোগীদের রাখার অন্যদিকে শ্মশানে, গোরস্থানে করোনায় মৃত মানুষের শেষকৃত্যের জন্য লম্বা লাইন।
যদিও অদৃশ্য এই করোনাকে এখন আর ভয় পান না ৫২ বছরের কামরুদ্দিন। গত ২৫ ধরেই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত তারা কয়েকজন। তবে ২০২০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত এতো মানুষের মৃত্যু মিছিল একবারে কখনও দেখেছেন কিনা মনে করতে পারছেন না ওই তারা।
এদিন তিনি জানান, করোনায় যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছেন তাতে কবর খোঁড়ার জন্য ২৪ ঘণ্টায় তাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে। গোরস্থানের বাইরে শেষকৃত্যের লম্বা লাইন। অবসর নেওয়ার মতো ফুরসত নেই। শুধু তাই নয়, গত তিন চার মাসে সারাদেশে যেভাবে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে তাতে এখন আর করোনাকে ভয় পান না তারা। সাহসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষের কবরের মাটি খুঁড়ে যাচ্ছেন তারা।
একই অবস্থা রাজধানী দিল্লিতেও। চারিদিকে শুধুই হাহাকার আর মৃত্যু মিছিল। শ্মশান গুলির বাইরে দাহ করার জন্য শবের লাইন। অ্যাম্বুলেন্সগুলি দেহ নামিয়ে দিয়ে ফের ছুটে চলেছে আরও মৃতদেহ নিয়ে আসতে। যেন শ্মশানে লাট পড়েছে মরা পোড়ানোর। এদিকে সুষ্ঠভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করারও সময় নেই। কাঠের অভাব। মরা পোড়ানোর জায়গার অভাব। ফলে রাজধানীতে নতুন করে খোঁজা হচ্ছে শবদেহ দাহ করার জায়গা।
এই বিষয়ে কামরুদ্দিন আরও জানিয়েছেন, করোনার কারণে গত একবছর ধরে কোনও ছুটি মেলেনি তাঁদের। তিনি ও তার সহকারী ঘড়ির কাঁটার থেকেও দ্রুত কবর খোঁড়ার কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এমনকি গত একবছর ধরে তাদের একমাত্র কাজই হল অ্যাম্বুলেন্স থেকে শবদেহগুলি নামিয়ে সেগুলি গোরস্থানে কবর দেওয়া।
লাশ আর লাশ, সৎকারে কুলাতে পারছে না শ্মশান ! ফ্রান্সেও করোনার ভারতীয় ধরন
ভারতে করোনাভাইরাসের মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে দিল্লিতে মৃতদেহ সৎকারের জায়গার সংকট তৈরি হয়েছে। শ্মশানজুড়ে দৃশ্যমান শুধু লাশ আর লাশ। এত লাশ সৎকারে কুলাতে পারছে না শ্মশান। ফলে নয়াদিল্লির পুলিশ শ্মশানের সংখ্যা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। সূত্র : এনডিটিভি, আনন্দবাজার, বিবিসি। জ্যেষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরে বেশির ভাগেরই মৃত্যুর কারণ এখন কভিড। জায়গার অভাবে কভিড আক্রান্তদের জন্য নয় এমন শ্মশানেই প্রিয়জনকে দাহ করছেন অনেকে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন, ওষুধ ও শয্যার অভাবে স্বজনদের হাহাকার বাড়ছে। সৎকারের জায়গার জন্য ছোটাছুটি করছেন স্বজনরা। বৃহস্পতিবার দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। দৈনিক সংক্রমণে এ পর্যন্ত বিশ্বের সব দেশের রেকর্ড ছাড়িয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৪৫২ জন। এক দিনেই রাজধানী নয়াদিল্লিতে মারা যান ৩৯০ জন। মহামারী শুরুর পর এক দিনের হিসাবে যা সর্বোচ্চ। এ অবস্থার জন্য নির্বাচনী সভা এবং ধর্মীয় সমাবেশের অনুমোদন দেওয়াসহ মহামারীর এ সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা বাড়ছে দেশটিতে। এদিকে বেশ কয়েকটি রাজ্যে এরই মধ্যে টিকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মজুদ কমে যাওয়ায় টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করেছে ২ কোটি মানুষের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই।
বিশ্বে দৈনিক প্রতি ৪ মৃত্যুর একজন ভারতে : ভারতে মহামারীর হানা কোথায় গিয়ে থামবে, এখনো পর্যন্ত তার সদুত্তর মেলেনি। তবে সংক্রমণের পাশাপাশি যেভাবে মৃত্যু বেড়ে চলেছে, তাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক মহলেও। কারণ এই মুহূর্তে যে হারে মৃত্যু বেড়ে চলেছে গোটা বিশ্বে, তার ২৫ শতাংশই ভারতে। গত ২৮ এপ্রিলের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে ওই দিন বিশ্বের সর্বত্র ১২ হাজার ৩০৩ জন করোনা রোগী প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ভারতেই মারা যায় ৩ হাজার ২৯৩ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন বিশ্বে করোনায় যত মৃত্যু ঘটছে, তার প্রতি চারটির মধ্যে একটি ঘটছে ভারতে।
ফ্রান্সেও ভারতীয় ধরন : এবার ফ্রান্সেও মিলল করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন। দেশটিতে ভারতীয় ধরনের করোনায় তিনজন আক্রান্তও হয়েছেন। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছিল, বিশ্বের অন্তত ১৭টি দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন পাওয়া গেছে। সূত্র : জি-নিউজ।
এক প্রতিবেদনে ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সূত্রে বলা হয়েছে, বি.১.৬১৭ নামক এ ধরনের খোঁজ কয়েক দিন আগেই মিলেছে। প্রথম ভারতীয় ধরন ধরা পড়ে দক্ষিণ পশ্চিম ফ্রান্সের এক নারীর। সম্প্রতি ভারতে এসেছিলেন তিনি। গত বুধবার এ তথ্য নিশ্চিত করে ফ্রান্সের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আক্রান্ত বাকি দুজনও নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে ফ্রান্সে যান। তারা দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের বাসিন্দা।
ফ্রান্সে করোনা সংক্রমণ রোধে এক মাসের কঠোর লকডাউনের ঘোষণা করা হয়। আগামী ১৯ মে থেকে বেশকিছু বিধিনিষেধ মেনে মিউজিয়াম, সিনেমা হল ও থিয়েটার খুলবে। প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানিয়েছেন, দেশে যেসব ক্যাফে রেস্তোরাঁ আছে, তা এবার ধীরে ধীরে খোলা হবে। চার ধাপে ধীরে ধীরে সবকিছু ফের স্বাভাবিক করা হবে। অর্থনীতি বাঁচাতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।
ব্রাজিলে মৃত্যু ৪ লাখ ছাড়াল : ব্রাজিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যায় শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পরই দেশটির অবস্থান। সংক্রমণ রোধে কড়াকড়ি শিথিল ও ধীরগতির টিকাদান কর্মসূচির কারণে সামনের মাসগুলোতে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে সতর্কতা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
খবরে বলা হয়, ব্রাজিলে গত বৃহস্পতিবার করোনায় ৩ হাজার ১ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়। এর ফলে মহামারীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ ১ হাজার ১৮৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
চলতি বছরে ব্রাজিলে করোনার সংক্রমণ এত ভয়াবহ ছিল যে পুরো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। এমনকি এক মাসের মধ্য ১ লাখের মতো মানুষের মৃত্যু ঘটে। সে সময় প্রতিদিন ৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এপ্রিলের শুরুতে তা কিছুটা নেমে আসে। তখন অনেক স্থানীয় সরকার সংক্রমণ রোধে আরোপিত লকডাউন শিথিল করে দেয়। তবে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কড়াকড়ি শিথিল করায় সামনের মাসগুলোতে মৃতের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। শুধু টিকা দিয়ে সংক্রমণ রোধ করা যাবে না। তাদের মতে, প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হতে থাকবে। মহামারীবিদ পেদ্রো হাল্লাল বলেন, গত বছরের মতো একই ভুল করতে যাচ্ছে ব্রাজিল। কভিড-১৯ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এখন কী করছে ব্রাজিল? ফের কড়াকড়ি শিথিল করে দিল এবং মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন ২ হাজারে স্থির করতে যাচ্ছে, যেন শুধু একটা রোগে প্রতিদিন ২ হাজার মানুষ মারা যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।