ফিচার্ড লেখালেখি

শ্রুতিনাটক – যুদ্ধ শিশু   ।।।।   সুশীল কুমার পোদ্দার

শ্রুতিনাটক – যুদ্ধ শিশু   ।।।।   সুশীল কুমার পোদ্দার

<টেলিফোন>
ভদ্রলোক – হ্যালো…
ভদ্রমহিলা – I am Joytte Anderson, Can I talk to Mr. Basu?
মিঃ বাসু– yes, Basu speaking
জয়তি – I think you are Bangladeshi
মিঃ বাসু– yes, I am
জয়তি – নমস্কার, কেমন আছেন? আমি অনেক কষ্টে আপনার টেলিফোন নম্বার পেয়েছি
মিঃ বাসু– sorry, আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না, তা কার কাছে আমার টেলিফোন নম্বর পেলেন?

জয়তি – আমি ভ্যাঙ্কুভার থেকে ওয়াটারলুর একটা conference এ এসেছি। conference না আসলেও আমাকে যে আসতেই হতো । আমার যে আপনার সাথে দেখা করা খুব প্রয়োজন। আমি কতো দিন অপেক্ষায় ছিলেম কবে আমার এমন এক সুযোগ আসবে। জানেন, ভাগ্য আমাকে তেমন সাথ দেয় না। আমি বড় দুর্ভাগা। অথচ আজ আমার ভাগ্য দেবতা আমায় সাথ দিল। আমায় পরিচয় করিয়ে দিল একজন বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সাথে। তিনিই আপনার টেলিফোন নম্বার দিয়েছেন

মিঃ বাসু– আচ্ছা, ঠিক আছে। বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?

জয়তি – আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। please না বলবেন না….

মিঃ বাসু– আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি বিকেলে ফ্রি আছি। আপনি চলে আসেন। আমি আমার বাড়ীর ঠিকানা আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি

জয়তি – আপনাকে অনেক ধন্যবাদ. শীঘ্র দেখা হবে

<কলিং বেল>

মিঃ বাসু– আসুন, আসুন

<জয়তি তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে>

মিঃ বাসু– এই!!, আপনি কি করছেন? আমায় আপনি বিব্রত করবেন না, please

জয়তি – জানেন, আমি এক শিকড় বিহীন দুর্ভাগা। সেই ছোটবেলা থেকে আমি আমার পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত। আমার কোন পিতা নেই। আমার নেই কোন পিতৃ পরিচয়। তবে আমার মনের মাঝে আমি আমার পিতার এক ছবি এঁকেছি। সেই ছবির মতই আপনি দেখতে। তাইতো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার বড় সাধ হল। আপনি মনে কিছু করবেন না

মিঃ বাসু– তা বলুন, আপনি যা বলতে চান। কী আপনার প্রশ্ন?

জয়তি – আমার সারাটা জীবন প্রশ্ন বোধক চিহ্নের উপর দাড়িয়ে আছে? আমার অনেক প্রশ্ন। জানেন ছোটবেলায় আমার জীবনে কোন প্রশ্ন ছিল না। আমার পিতামাতা কানাডীয় ব্রিটিশ বংশভূত। উনারা দুজনই ডাক্তার। আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন। একদিন আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেম – আচ্ছা daddy, আমার গায়ের রং কেন ব্রাউন! তিনি বলেছিলেন – এ প্রকৃতি জগত বড় বেশী রহস্যময়। মনে হয় তোমার সাথে সে রহস্য করেছে। পরে জানতে পেরেছি আমি তাদের পালিত সন্তান। সুদূর বাংলাদেশ থেকে তারা আমায় নিয়ে এসেছেন

মিঃ বাসু– তাইতো বলি আপনার নাম কেন জয়তি অ্যান্ডারসন। তার পর…

জয়তি – আমি আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠি মনের মাঝে এক কষ্ট নিয়ে, অনেক অভিমান নিয়ে। আমার বাবা-মাকে দেখতে বড় ইচ্ছে হয়। যেদিন আমি তের বছরে পড়লেম, সেদিন আমার মা, আমার হাতে তুলে দিলেন এক পুরানো বাক্স। আমি সে বাক্স খুলে ফেলি। ফ্রক পড়া এক মায়াময় মুখ – আমার মা। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। মিঃ অ্যান্ডারসন আমায় সান্তনা দিয়ে বলেন – এতোদিন শুধু তোমার বড় হবার অপেক্ষায় ছিলেম। তোমার আত্মপরিচয় জানা তোমার অধিকার – সে অধিকার থেকে তোমায় বঞ্চিত করতে পারি না। বাক্সের মাঝে অনেকগুলো চিঠি, বেশ কিছু ছবি। আমি আবিষ্কার করলেম আমার মায়ের নাম অলকানন্দা

মিঃ বাসু– কি বললে অলকানন্দা? জন্ম সিরাজগঞ্জ, জেলা পাবনা!

জয়তি – হ্যাঁ, আপনি চিনতে পেরেছেন আমার মাকে?

মিঃ বাসু– (অনেকক্ষণ চুপ) হ্যাঁ মা, আমি তোমার মাকে চিনতাম। অনেক কাছ থেকে চিনতেম। সে চেনা একসময় জানাতে পরিণত হয়েছিল। আমাদের সে স্বপ্ন যে অনেক আগেই তো ভেঙ্গে গেছে! তুমি অর্ধশতক পার করে দিয়ে কেন আজ সেই দুঃসহ স্মৃতি খুঁচিয়ে সামনে নিয়ে এলে?

জয়তি – দুবছর আগে আমি আমার স্বামীর সাথে আমার শিকড়ের খোঁজে বাংলাদেশে গিয়েছিলেম। আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করে ছিল শত বিস্ময়, শত অপমান। আমি এই প্রথম জানতে পারি আমি এক যুদ্ধ শিশু। আমার রক্তে মিশে আছে হানাদার পিশাচের রক্ত – যারা তার সম্ভ্রম নষ্ট করেছিল।

তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন । যে তিন লক্ষ বঙ্গ ললনা পাকিস্তানী হানাদারের হাতে লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়েছিল, হয়েছিল বিরঙ্গনা, তার মাঝে আমার মাও ছিলেন।

বাংলাদেশে তখন অবাঞ্ছিত সন্তান জন্মদানের জন্য মাদার তেরাসা সহ বিদেশী অনেক স্বেচ্ছা সেবক সংস্থা গড়ে উঠেছিল। এমনি এক স্বেচ্ছা সেবক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন ডাঃ অ্যান্ডারসন। মা আমায় তার হাতে সঁপে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন।

মিঃ বাসু– আমি তাকে অনেক খুঁজেছি। লোক লজ্জার ভয়ে ওদের পরিবার একদিন রাতের অন্ধকারে অন্যত্র চলে যায়। তা, তুমি কি তাকে খুঁজে পেয়েছ? তোমার সাথে কি দেখা হয়েছিল? কেমন আছে অলকানন্দা? ও কেমন আছে…!!!

জয়তি – আমিতো সেই প্রশ্ন নিয়েই এসেছি আপনার কাছে? কেন মাকে অপমানে আত্ম হননের পথ বেছে নিতে হল! আপনার কি কিছুই করার ছিল না সেদিন?

মিঃ বাসু– অলকা…অলকানন্দা নেই? আমি অপরাধী। আমি ভীতু, আমি কাপুরুষ! সমাজের বাঁধা নিষেধ পেরিয়ে আমি সেদিন ওকে কোন আশ্বাস দিতে পারিনি।

১৯৭১, দেশে তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। আমরা তখন কেবল কলেজে ভর্তি হয়েছি। এক সাথে কলেজে যাই, এক সাথে ফিরি। এক দণ্ড ওকে না দেখলে নিজকে নিঃস্ব মনে হয়।। এমনি করে কবে যে আমরা দুজন এক হয়ে গেছি জানিনে। একদিন শহরে মিলিটারি এলো। ওরা নির্বিচারে পুড়িয়ে দিল বাড়িঘর, সম্পদ।আমরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলাম । একদিন আমার মতো ভীতু, সেও তার বন্ধুদের সাথে বেড়িয়ে পড়লো জন্মভূমিকে মুক্ত করবে বলে।

তারপর, একদিন অনেক হাত ঘুরে অলকার চিঠি পেলাম – সে চিঠিতে ভীতি, আর আমাকে হারানোর ভয়। আমি তখন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। আমার যে হাতে সময় নেই ওদেরকে খুঁজে বেড় করার…

জয়তি – এমনি অনেক না পাঠানো চিঠি আমি খুঁজে পেয়েছি মায়ের রেখে যাওয়া বাক্সের মাঝে। আমিতো সেখানেই আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। তা, আমার মায়ের সাথে কি আপনার আর দেখা হয়নি?

মিঃ বাসু– দেখা… দেখা হয়েছিল। যখন দেখা হল, তখন অলকা আর সেই অলকানন্দা নেই। ওর গায়ে শত ছিন্ন শাড়ী, চোখের কোনে কালি, ফ্যাঁকাসে, শীর্ণকায়। আমি ওকে চিনতে পারিনি। সেদিন আমাদের দায়িত্ব পড়েছিল মিলিটারি ক্যাম্প থেকে আমাদের মা বোনদের উদ্ধার করা। আমি তো বুঝতে পারিনি, ওদের মাঝে আমার অলকানন্দা রয়েছে। আমাকে দেখে সে ডুকরে কেঁদে উঠে আমায় জড়িয়ে ধরেছিল।ওর চলার শক্তি নেই। আমি ওকে কাঁধে করে পোঁছে দেই ওদের সেই পোড় বাড়ীতে।

জয়তি – তারপর?

মিঃ বাসু– ওর বাবা-মা ওর দিকে হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে থাকে। জয়তি ফিরে এসেছে বলে ওদের মাঝে নেই কোন উত্তাপ। ওর মা ডুকরে কেঁদে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যায়। দূরে দাড়িয়ে পাড়া প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে। ও ঠাই দাড়িয়ে থাকে। ওকে কেউ ঘরে ডেকে নেয় না।

আমার যে তখন যুদ্ধ শেষ হয়নি। আমার পরিবার কে কোথায় জানিনে। তাই আমি ওকে ওর বাবা-মার কাছে রেখে ফিরে যাই আমার আপন জনের খোঁজে। যাবার সময় ওকে কথা দিয়ে যাই- শীঘ্র ফিরে আসবো বলে।

জয়তি – আপনি কি ফিরে এসেছিলেন? বলুন.. চুপ করে আছেন কেন? বলুন

মিঃ বাসু– না, আমি সেদিন ভয় পেয়েছিলাম। সমাজের ভয়, পরিবারের ভয়

জয়তি – জানেন এমনি করে হাজার বিরঙ্গনা কেউ আত্মঘাতী, নয়তো সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে ভয়ে ভয়ে, ধুকে ধুকে নীরবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ রাষ্ট্রের তেমন উদ্যোগ নেই ওদের পাশে দাঁড়ানোর। ২৬সে মার্চ আসে, ১৬ ই ডিসেম্বর আসে, কে রাখে ওদের খোঁজ? আমি যে ওদের পাশে দাড়াতে চাই!

মিঃ বাসু– আমাকেও সাথে রেখে। সেদিন যা করতে পারিনি, আজ এই বয়সে এসে যদি কিছুটা ঋণ শোধ করতে পারি, তাহলে আমার অপরাধী মন যে শান্তি পাবে…আমায় সাথে নিও মা, আমায় সাথে নিও…



এসএস/সিএ
সংবাদটি শেয়ার করুন