দুনিয়াজুড়ে নয়া ছাত্র আন্দোলন ।।।। পুলক বড়ুয়া
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুগপৎ ফিলিস্তিনের পক্ষে এবং ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল। বিক্ষোভে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত কোম্পানি ও ব্যক্তিদের বয়কট করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
প্রথমে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। পরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিক্ষোভ দমনে পুলিশ নির্মম আচরণ করে। অভিযোগ উঠেছে, শান্তিপূর্ণভাবে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরব্যাপী পুলিশি নির্মমতার এই চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেলে ধরেছে। লস অ্যাঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া এবং আটলান্টায় বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বিক্ষোভকারী-শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে ৪০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ চলছে।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ইহুদি বিদ্বেষের জন্য অভিযুক্ত তার মধ্যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। গত সপ্তাহে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট বিক্ষোভকারীদের ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বললে একশোর বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়। এ ঘটনা বিক্ষোভকে আরো উসকে দেয়।
বিক্ষোভের কারণে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ইউনিভার্সিটিতে কমেন্সমেন্ট অনুষ্ঠানে ভালো ফলাফল অর্জনকারী জনৈক শিক্ষার্থীর ভাষণ বাতিল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে হুমকি থাকার কারণে এটি বাতিল করা হয়েছে। গত হপ্তায় নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ম্যানহাটন ক্যাম্পাসে কিছু বিক্ষোভকারী তাৎক্ষণিকভাবে তাঁবু টানিয়ে বসে যায়। সেখান থেকে পুলিশ ১২০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
গত বুধবার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি চত্বরে একদল শিক্ষার্থী অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়ে বসে বিক্ষোভ শুরু করে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হার্ভার্ড আন্ডারগ্র্যাজুয়েটস প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করে। তবে পুলিশ ডেকে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে অস্বীকৃতি জানান হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট। গত বৃহস্পতিবার বোস্টনের এমারসন ইউনিভার্সিটিতে ১০৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বাতিল করতে হয়েছে। বিক্ষোভের সময় চার জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন।
চলমান প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্যেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্পাসের ভেতরেই ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করেছেন। ক্যাম্পাসের আইভি লিগ স্কুলের সামনে যেখানে এই পতাকা উত্তোলন করা হয় সেই জায়গাটি সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকার জন্য সংরক্ষিত।
এছাড়া তারা ওয়াশিংটন হিলটন হোটেলের ওপরের ফ্লোরের জানালা থেকেও একটি বিশালকার ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করেছিল। এটি মূলত হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা সমিতির বার্ষিক নৈশভোজের স্থান।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ শিবিরে পুলিশি দমনপীড়নের সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিল স্টেইন। ক্যাম্পাসে নতুন করে গ্রেপ্তার হওয়া ১০০ জনের মধ্যে স্টেইন ছিলেন।
২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী স্টেইন। প্রচারণা ব্যবস্থাপক এবং একজন ডেপুটিসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও স্টেইনের নির্বাচনী দল শিক্ষার্থীদের দাবি এবং তাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে সমর্থন করে।
বেশ কিছু মার্কিন সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ না করতে, ইসরায়েলে বিনিয়োগ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা যখন নানা পদক্ষেপ নিচ্ছিল, তখন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ছবিতে দেখা গেছে, সশস্ত্র পুলিশ স্টেইনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এসব ছবিতে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশি দমনপীড়ন, সহিংসতা ও তাদের গ্রেপ্তারের দৃশ্যও ফুটে উঠেছে।
ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ সমর্থনে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের সমর্থনে প্রতিবাদে যোগ দেন স্টেইন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, দাবি না পূরণ হওয়া পর্যন্ত তারা চলে যাবেন না।
গ্রেপ্তারের আগে ধারণ করা একটি ভিডিওতে গ্রিন পার্টির এই প্রার্থী জানান, তিনি শিক্ষার্থীদের এবং তাদের সাংবিধানিক বাক স্বাধীনতার অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। স্টেইন বলেন, আমরা এখানে সেই শিক্ষার্থীদের কাতারে দাঁড়াতে যাচ্ছি- যারা গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে, গণহত্যা বন্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে।
জিল স্টেইনের যোগাযোগ পরিচালক ডেভিড শোয়াব বলেছেন, স্টেইন শনিবার বিকেলে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ কিছুক্ষণ পরেই গ্রেপ্তার শুরু করে।
তিনি বলেন, এটি লজ্জাজনক যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো তাদের নিজস্ব শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগকে সমর্থন করছে। তারা কেবল শান্তি, মানবাধিকার এবং আমেরিকান জনগণ ঘৃণা করে- এমন গণহত্যার অবসান চাচ্ছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ দিনে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অন্তত ৯০০ ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইহুদিবাদী সরকারকে সমর্থন করা ওয়াশিংটনের নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও বিক্ষোভে নামছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্ষোভ সামাল দিতে যখন মার্কিন প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে তখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের অনেক দেশেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কানাডা, ইউরোপের ফ্রান্স, ইতালি থেকে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য অংশের ক্যাম্পাস এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সমর্থনে ফ্রান্সের প্যারিসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। একই সঙ্গে সায়েন্সেস পো থেকে প্যালেস্টাইন কমিটি একটি বিক্ষোভের আয়োজন করে যেখানে শিক্ষার্থীরা বুধবার প্রায় ১০টি তাঁবু স্থাপন করে। পুলিশের ধরপাকড় সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার ফের জড়ো হন বিক্ষোভকারীরা।
ইতালির রোমে সাপিয়েনজা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত ১৭ এবং ১৮ এপ্রিল বিক্ষোভ, অবস্থান ধর্মঘট এবং অনশন করে। ১৯ এপ্রিল রাত থেকে যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ডে অবস্থিত ক্যাম্পাস পিয়াজা দখল করে রেখেছে ‘ওয়ারউইক স্ট্যান্ডস উইথ প্যালেস্টাইন’ নামে ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপ। সোমবার ইংল্যান্ডের লেস্টারে একটি বিক্ষোভ হয় যাতে লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন প্যালেস্টাইন সোসাইটি অংশ নেয়। গত মাসে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইসরায়েলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতার প্রতিবাদে একটি ক্যাম্পাস ভবন দখল করে।
বার্লিনে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্টের সামনে তাঁবু খাটিয়ে ইসরাইলের কাছে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে। সুইডেনের সড়কগুলো ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো ও ইসরাইলকে বয়কট করো’ স্লোগানে মুখরিত ছিল গত শনিবার। লন্ডনের কেন্দ্রে এদিন হাজারো মানুষ ফিলিস্তিনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পথে নেমে আসেন।
অস্ট্রেলিয়ায় সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত মঙ্গলবার ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং শুক্রবারেও তাদের সেই বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। এছাড়া মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত বৃহস্পতিবার তাদের মূল ক্যাম্পাসের দক্ষিণ লনে তাঁবু খাটায়।
সময় যত গড়াচ্ছে গাজায় আগ্রাসন বন্ধের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ততই বাড়ছে। যদিও এই আন্দোলনকে ভালোভাবে নিচ্ছে না ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে ভয়ানক বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি অবিলম্বে এসব বিক্ষোভ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের জোরদার আন্দোলন থামার কোনো লক্ষণ নেই।