ফিচার্ড মত-মতান্তর

বাংলার ঘরে ঘরে বেনজির, মোশাররফ বা রাগীব আলীতে ভরপুর!

বাংলাদেশের-ভবিষ্যৎ-কি

বাংলার ঘরে ঘরে বেনজির, মোশাররফ বা রাগীব আলীতে ভরপুর!

শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক।। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমদ গোপালগঞ্জে হিন্দুদের শতশত বিঘা জমি দখল করেছেন। সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুরে অরুন গুহ মজুমদারের ৭০কোটি টাকা মূল্যের বাড়ী মাত্র ২০লক্ষ টাকায় কিনেছিলেন, সেটিও দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ মিডিয়া এনিয়ে কিছুটা হৈচৈ হয়েছিলো বলে! সিলেটের রাগীব আলী হিন্দুর সম্পত্তি জবর-দখল করে দানবীর হয়েছেন, তিনি কিছুকাল জেল খেটেছেন, তাতে কি, এখন তার বড় উকিল, তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে? উত্তরবঙ্গের সাবেক এমপি দবির উদ্দিন-র বিরুদ্ধে হিন্দু জমি জবরদখলের বিশদ রিপোর্ট মিডিয়ায় এসেছিলো। বাস্তবতা হচ্ছে, সুযোগ পেলে প্রায় সবাই হিন্দু সম্পত্তি দখল করেন বা করেছেন।

মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যখন হিন্দুর বাড়ীটি দখল করেন, তখন প্রয়াত আব্দুল গাফফার চৌধুরী আমেরিকায় এসেছিলেন। এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমি তাঁকে মন্ত্রীর হিন্দু বাড়ী দখলের কাহিনীটি জানালে তিনি তাৎক্ষণিক আমায় বললেন, ‘হিন্দুর সম্পত্তি গনিমতের মাল’। তাই বলছিলাম, বাংলার ঘরে ঘরে বেনজির, মোশাররফ বা রাগীব আলীতে ভরপুর’। এদের মধ্যে ধরা খেলে কেউ কেউ ‘ভূমিদস্যু’ বলে আখ্যায়িত হ’ন, ছোটখাট দস্যুরা দেশের সর্বত্র বিরাজমান। মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে কিছু সংবাদ বেরিয়ে যায়, তখন আমরা জানতে পারি, অন্যরা ‘অধরা’ থেকে যায়! এমনকি তদানীন্তন পাকিস্তান বা পূর্ব-পাকিস্তান এবং আজকের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকেও ‘ভূমিদস্যু’ বলা যায়?

রাষ্ট্র কিভাবে ভূমিদস্যু হয়? হয়, পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে জমিদারী স্বত্ব বাতিল আইন হয়। আইনটি ছিলো শুধুমাত্র পূর্ব-পাকিস্তানের জন্যে, পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্যে নয়। কারণ পশ্চিম-পাকিস্তানে জমিদাররা ছিলেন প্রায় সবাই মুসলমান, এবং পূর্ব-পাকিস্তানের প্রায় সকল জমিদার ছিলেন হিন্দু। সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং হিন্দুদের থেকে জমি কেঁড়ে নেয়ার জন্যে পাকিস্তান এ আইনটি করেছিলো এবং এর সফল বাস্তবায়ন করে, হিন্দুরা জমি হারায়, মুসলমানরা ‘বিনে-পয়সায়’ হিন্দুর জমি জবর-দখল করে। পূর্ব-পাকিস্তানে হিন্দুর জমি কেঁড়ে নেয়ার ইতিহাস এক করুন অধ্যায়, এবং সেই ধারা আজো চলছে।

এরপর ১৯৬৫ সালে আসে শত্রু সম্পত্তি আইন। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় এ আইনটি প্রণীত হয় এবং  এর ব্যবহার বড় বড় শিল্প-কারখানার ওপর সীমিত ছিলো। ১৯৬৯ সালে আন্দোলনের মুখে জরুরী অবস্থা উঠে যায়, কিন্তু শত্রু-সম্পত্তি আইনটি বিশেষ ক্ষমতাবলে রেখে দেয়া হয়। এরপর ১৯৭১, স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের দলিলে বলা হয়েছিলো যে, দেশ স্বাধীন হলে সকল ‘কালা-কানুন’ বাতিল হবে। তা হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আইনটি রেখে দিয়েছিলেন ‘অর্পিত-সম্পত্তি’ নামে। মনোরঞ্জন ধর তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন, একজন হিন্দুর হাত দিয়েই এ আইনটি আসে। হয়তো তিনি চেষ্টা করেছেন, পারেননি। এজন্যে হিন্দুরা মনোরঞ্জন ধরকে মনে রাখেনি।

অতঃপর জেনারেল জিয়া, তিনি তহশিলদারকে ক্ষমতা দেন হিন্দুর সম্পত্তিকে ‘শত্রু-সম্পত্তি’ হিসাবে ঘোষণা করার। ফল যা হবার তাই হয়, তহশিলদারগন দলিলে হিন্দুর নাম দেখে দেখে তা ‘শত্রু-সম্পত্তি’ হিসাবে নোটিশ দেয়া শুরু করে। হিন্দুরা বাপ্-দাদার সম্পত্তি হারাতে শুরু করে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, একবার সম্পত্তি ‘শত্রু-সম্পত্তি’ হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা একরকম অসম্ভব। ‘শত্রু’ বা অর্পিত সম্পত্তি, যাই বলিনা কেন, এর যাঁতাকলে হিন্দুরা পিষ্ট হতে থাকে। এরশাদ আমলে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে, তিনি একটি ‘স্টে-অর্ডার’ জারি করেছিলেন। খালেদা জিয়ার আমলে আবার শুরু হিন্দুর জমির জবর দখল।

শেখ হাসিনা প্রথম দফায় ক্ষমতাসীন হয়ে ৫বছর সময় নেন আইনটি বাতিল করতে। মেয়াদের একেবারে শেষে ১১ই এপ্রিল ২০০১-এটি বাতিল হয়, যদিও একটু ফাঁক ছিলো, আইনটি গেজেট হতে একটি সময়সীমা দেয়া হয়। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা নির্বাচিত পরাজিত হ’ন, খালেদা জিয়া আবার ক্ষমতাসীন হ’ন, এবং আইনের খসড়াটি বাতিল করেন। ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় আইনটি বাতিল করেন। আইনটি এখন নেই, কিন্তু এর জ্বালাতন আছে। এর সুফল এখন পর্যন্ত কোন হিন্দু পেয়েছেন বলে কেউ শুনেনি। এরমধ্যে হিন্দু সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। হারানো সম্পত্তি হিন্দুরা ফেরত পাবেন, এ গ্যারান্টি নেই?

এ আইনে হিন্দুরা কতটা সম্পত্তি হারিয়েছেন সেই হিসাব নেই? বলা হয়, দেশের প্রতিটি  উপজেলা অফিসই শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি’র ওপর? হ্যাঁ, গাফফার চৌধুরীর সংজ্ঞামতে ঐসব ‘গনিমতের মাল’ প্রায় সবই মুসলমানদের দখলে। শুনতে খারাপ লাগলেও কথা কিন্তু সত্য। পুলিশ প্রধান, মন্ত্রী, এমপি যখন হিন্দু সম্পত্তি দখল করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই নীচের তলার মানুষ বসে থাকবে না? হিন্দুর জমি বা সম্পত্তি জবর দখলের ঘটনা বাংলাদেশে একটি নিত্য-নৈমত্যিক ঘটনা, গ্রামে-গঞ্জে এটি মহামারী, মামলা-মোকদ্দমা তো আছেই! দেখার কেউ নেই? তাই বলছিলাম, দোষ একা বেনজির আহমদের নয়? দেশে ছোটবড় বেনজিরের সংখ্যা অগুনতি। [email protected];


এসএস/সিএ

 

সংবাদটি শেয়ার করুন