ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

মালতি || রীতা আক্তার

মালতি || রীতা আক্তার

সিঁথীর সিঁদুর এখনও টকটকে লাল। প্রসস্হ কপাল জুড়ে রয়েছে কুমকুমের সোহাগ চিহ্ন। পরনে লাল বেনারসী, গা ভর্তি গয়না, আলতা রাঙা পা দুটি খাটের উপর থেকে এক হাত ঝুলে রয়েছে, চোখ দুটো রক্ত জবার মতো টকটকে লাল, কি যেনো বলতে চেয়েছিলো?  কত আকুতি সে চোখের চাহুনীতে। জিভের আংশিক ভাগ বেরিয়ে এসেছে ঠোঁট ভেদ করে। নিথর দেহটা ঝুলছে সিলিং ফ্যানের সাথে। অভাগী মালতির কী তবে এই ভাবেই মৃত্যু লেখাছিলো?
      যেদিন মালতির মা প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলো, সেদিন আকাশ ভেঙে যেনো বৃষ্টি ঝরে পড়ছিলো। ভাদ্র মাস তবুও সে কি বৃষ্টি!মেঘের চড়াৎ চড়াৎ শব্দে আকাশ বাতাস যেনো গর্জে উঠছিলো। তারই মাঝে শোনা গেলো কান্নার আওয়াজ। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মালতির বাবা অপেক্ষা করছিলো এই বুঝি দাই সু খবরটা দিবে। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক করে দাই বলে উঠলো ওওও পারুও বাপ, শুনছো গো, তোমার ঘর আলো কইরা লক্ষি আইছে গো লক্ষি। 
তিন কন্যা সন্তানের পর এবারও মেয়ে হলো বলে মনক্ষুন্ন হয়ে সেই ঝড়ের মধ্যে পা বাড়ালো মালতির বাপ। যাওয়ার আগে দাইকে বলে গেলো, ঐ মেয়ের মুখও আমি দেখতে চাই না। গাঙের জলে ভাসায়ে দাও ওরে। 
এই বলে, সেই যে ঝড়ের রাতে হারিয়ে গেলো মালতির বাপ, আর ফিরে আসেনি। সে বেঁচে আছে কি মরে গেছে সে খবরও পাওয়া যায় নি আজও।
        সেই থেকে শুরু হলো মালতির দুঃখের জীবন। কত বেলা খেয়ে না খেয়ে একটু একটু করে মালতিও লাউয়ের ডগার মতো বেড়ে উঠতে লাগলো। সকালে সূর্য যেমন কাঁচা সোনা রোদ ছড়িয়ে দেয়, তেমনি কাঁচা সোনার মতোন গায়ের রঙ ছিলো মালতির। শুধু পেটে ছিলো না ভাতের যোগাড়। 
       ধানের চাতালে কাজ নিলো মালতি। উঠতি বয়স, তার উপর রুপবতী। কু দৃষ্টির অন্ত ছিলো না। 
দু হাড়ি ধান সেদ্ধ করতে বসে আগুনের তাপে মালতির মুখটাও যেনো ঝলছে যাচ্ছিলো। একমনে কি যেনো ভেবে চলছিলো সে। 
রহিমা খালার  ডাকে সংবিৎ ফিরে পেলো মালতি। 
– – ওলো মুখ পুড়ি, কই একটু শাড়ীর আঁচলডা দিয়া গতরখান ঢাইকা রাখতে পারোছ না? শকুনের কি অভাব আছে না কি লো। ডাঙ্গর হইতাছোস একটু বুইঝ্যা শুইন্যা চলিস। 
— গতর ঢাকমু কেমনে?  শাড়ি ছেঁড়া দেহো না তুমি!
– -হুন, তুই যদি রাজি থাকস তাইলে মাষ্টরের বাড়িতে তোরে কাম ঠিক কইরা দিতে পারি। মাষ্টর আর তার বৌ মেলা ভালা মানুষ। গায়ে গতরে খাটবি, তিন বেলা পেট ভইয়া খাওনও পাবি। মাষ্টরের দুই পোলাই তো ঢাকায় পড়ালেহা করে। বাড়িতে মাষ্টরের বৌ একলাই থাহে। তুই কইলে আমি আইজ বৈকালে তোরে লইয়া যাবার পারি। 
— ঠিক আছে খালা। তুমি যেইডা ভালা মনে করো,তাই করো।
      চাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে যায় বাজারের একটা কবিরাজি দোকানে। গ্রামের স্বল্প আয়ের লোকদের বেশি দাম দিয়ে ঔষধ কেনার সামর্থ নেই, তাই গ্রামের কবিরাজই তাদের ভরসা। মালতির বাকি তিন বোনেরা মায়ের খবরও নেয় না। যে যার মতো করে পেটের তাগিদে চলে গেছে নিজের মতো করে। শুধু মালতি পারেনি যেতে। দুঃখি মাকে রেখে কি করে স্বার্থপরের মতো চলে যাবে সে!  তাই সে রয়ে গেছে মায়ের পাশেই। বিকেল পেরিয়ে গেলেই রহিমা চলে আসে মালতিদের বাড়ি। সন্ধ্যের পূজা পাঠে ব্যস্ত ছিলো সে। সন্ধ্যের আরতি সেরে সে বেরিয়ে পড়লো মাস্টারের বাড়ির দিকে। মাস্টার বৌ রহিমাকে দেখে বসার জন্য পিঁড়ি এগিয়ে দিলো। মুড়ি বাতাসার সাথে দিলো এক খিলি পান। নানান কথায় মালতির কাজেরও ব্যবস্হা হয়ে গেলো। দু বেলা দু মুঠো ভাত জুটবে মা মেয়ের পেটে, গরীবের জন্য এর থেকে বড় আর কি হতে পারে মালতি তাই ভেবে চলেছে। সারাদিন কাজ করে যখন পেটে দু মুঠো ভাত পড়ে না তখন বোঝা যায় পেটের জ্বালা, কত জ্বালা। গরীব হয়ে জন্মানোটাই কি তবে পাপ?  হয়তো পাপ, নয়তো নয়। 
মাস্টারের বাড়িতে কাজ করে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিলো মালতিদের সংসার। মালতির রূপ যেনো আরো উপচে পড়ছিল। এক ফালি চাঁদের মতো স্নিগ্ধতায় ভরা একটা মায়াবী মুখ। 
একদিন দুপুর বেলায়, নাওয়া খাওয়া সেরে মাস্টার গিন্নি আধ শোয়া হয়ে মুখে পান গুঁজে পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাস। এমন সময় মালতি তা দেখে জানতে চাইলো –
– ওওও, মাসিমা, ঐ ডা কিয়ের বই গো তোমার হাতে। 
মাস্টার গিন্নী বললেন এটা উপন্যাস রে মালতি। রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছিস? 
– না তো! , কেডা উনি? 
রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে যাবে এমন সময় ডাক পিয়ন এসে কড়া নাড়লো দরজায়। 
বলছে – বাড়িতে আছো গো মা ঠাকুরণ। তোমার ছেলের চিঠি এসেছে ঢাকা থেকে। মাস্টার গিন্নী বইটা রেখে ছুটে গেলো দরজায়। ছেলের চিঠি। আজ এক মাস পর ছেলের চিঠির পেয়ে মাস্টার গিন্নির খুশি যে আর ধরে না। লিখেছে আগামী সপ্তাহে বাড়িতে আসছে গরমের ছুটিতে। এ বাড়িতে কাজ করতে এসে কোনোদিন মাস্টারের ছেলেদের দেখেনি সে। এবারই প্রথম দেখবে সে। শুনেছে এক ছেলে ডাক্তারি পড়ে। আরেক ছেলে ইন্জিনিয়ার। ছুটি কম পায় বিধায় তাদেরও আসা হয়ে উঠেনা গ্রামে।   দেখতে দেখতে সপ্তাহটি পার হয়ে গেলো। মাস্টারের বড় ছেলে সুভাস চলে এসেছে গ্রামে।
         সকালে আজ সূর্যটা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, মালতি মায়ের জন্য ডাল ভাত রান্না করে চলে গেলো কাজে। মলতির মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে এমন সময় বাড়িতে হাজির হলো পুব পাড়ার নগেন বোস। নগেন বোস গ্রামের বেশ প্রতাপ শালী লোক। শুধু তাই না একটা খারাপ মানুষ হিসেবেও তার জুড়ি মেলা ভার। পারতোপক্ষে গ্রামের কম থেকে বেশি বয়সের সকল নারী পুরুষ তাকে এড়িয়ে চলে। সেই নগেনের আজ হঠাৎ করে এখানে আসতে দেখে মালতির মা বেশ ভয় পেয়ে যায়। মাথায় এক হাত ঘোমটা টেনে সরে দাঁড়ায় মালতির মা। 
নগেন চারপাশটা বেশ ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয়। রংচঙা শার্টের পকেট থেকে একটা পানের খিলি বের করে মুখে পুরে নেয়। লম্বাদেহি স্বাস্হ্য ভালো, চুল গুলো কোকড়ানো, চোখ দুটো ছোট তবে তীক্ষ দৃষ্টি। একটি দৃষ্টিই যেনো ছোবল মেরে সব কিছু ছিনিয়ে নিতে পারে। 
মালতির মায়ের বুকের ভেতর কেমন এক অজানা ভয় দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দিচ্ছে। -কেমন আছো মালতির মা? ভালা আছো নি? 
— জে, ভালা আছি। আপনে আমগো বাড়ি কি মনে কইরা আইছেন? 
— কি যে কও, মালতির মা,তোমরা হইলা আমার প্রতিবেশী, তোমাগো খবর লওয়া তো আমার কর্তব্যেই পড়ে, না কি কও? 
এ কথার কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না মালতির মা, গত কয়েক বছর তো দূরে থাক কোনো দিন নগেন তার বাড়িতে উঁকিও দেয়নি। আর আজ এসেছে কিনা খবর নিতে?  নিশ্চয়ই ওর কেনো বদ মতলব রয়েছে। আজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠে তার। 
— তা তোমার মালতিরে দেখতাছিনা? 
— কামে গেছে। 
— ওওও, হুনছি মাস্টরের বাড়িতে কাম লইছে। তা মাইয়ার বিয়ার কতা কিছু ভাবছোনি? 
— মাইয়া জনম দিছি যহন,বিয়ার কতা তো ভাবনই লগবো। মাইয়ারে তো আার আমি সারাজীবন আমার বাড়ি রাখতে পারমুনা। 
— হহহ, তা ঠিকই, কইছো। 
বিয়ার কতা যহন ভাবতাছোই তাইলে আমার পোলা রঞ্জুর লগেই দাও। আমি তোমার কাছে আমার পোলার বিয়ার প্রস্তাব লইআইছি। 
তোমার মাইয়া সুখেই থাকবো। খাওন পরনের কোনো অসুবিধা হইবো না। বুঝলা। 
— কিন্তু, আপনার পোলা রঞ্জুতো গাজাখোর, হুনছি মেলা কয়বার জেলও খাটছে। মাইয়া মানুষের কারবারও নাকি করে। 
— ধুর, কেডা কইছে এই হক্কল কতা তোমারে। যুয়ান পোলা, এই বয়সে রক্ত তো একটু গরম হইবোই। বিয়া দিলে সব ঠিক হইয়া যাইবো। আমার পোলা তোমার মালতিরে মনে ধরছে। আমার একখান পোলার শখ তো আর বাদ রাখতে পারিনা, তাই আইছি তোমার এহানে। 
না, না, 
অহনই কিছু কইতে অইবো না, আমি কয়দিন পর আইয়া খবর লইয়া যামুনে। বিষয়ডা ভাইবা দেইহো কেমন। 
আর রাজি না অইলে তো বুজই। আমার পোলার জন্য আমি সব করতে পারি। 
যাবার সময় নগেন একটা নিরব হুমকি দিয়ে যায় তাকে। কি করবে ভেবে পায় না সে। শেষ কালে কি তবে এটাই লেখা ছিলো কপালে?  মালতির জীবনটা কি শেষে গিয়ে পড়বে ঐ পশুর হাতে। নিশ্চুম নিশ্চল ভাবে উঠোনে বসে পড়ে মালতির মা।
      একমনে কি যেনো লিখছিলো সুভাস।এমন সময় জলখাবার নিয়ে আসে মালতি। 
দাদা!  
মুখ তুলে চাইলো সুভাস।
–ওওওও,তুমি!  এসো ভেতরে এসো। 
টেবিলের একপাশে জল খাবার রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো মালতি, কি মনে করে থমকে দাঁড়ালো সে। সুভাসের কাছে এসে বলল-দাদা, আমরে তুমি বই পড়া শিখাইবা?  মাসি তো রোজ বই পড়ে, এই মোটা মোটা বই, একেক সময় তো পড়তে পড়তে বইয়ের মধ্যে হারায় যায়। আচ্ছা কি এমুন লেহা থাহে বই গুলাতে?  আমিও পড়তে চাই দাদা। দিবা আমারে শিখাইয়া? 
সুভাস ওর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলো একমনে। পরে বলল- ঠিক আছে, কাল তোমার জন্য আমি আদর্শলিপি কিনে এনে দিবো। আগে তো তোমায় অক্ষর শিখতে হবে। লেখা শিখতে হবে, তা না হলে তো ভালো করে পড়তে লিখতে পারবে না, বুঝলে?
— আইচ্ছা দাদা। 
পরদিন থেকে মালতির কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াটাও নিয়মিত হয়ে যায়। 
 
দিন যায়, রাত যায়, ভেতরে ভেতরে চিন্তার অন্ত থাকেনা মালতির মায়ের। নগেন যে খুব খারাপ মানুষ। যার দিকে একবার চোখ পড়ে সে ছারখার হয়ে যায়। আজ যদি মালতির বাপ পাশে থাকতো তবে মনে জোর পেতো। মানুষটা সেই যে ঝড়ের রাতে চলে গেলো কোথায়!  সে আর ফিরে এলো না। তবুও সিঁথিতে রোজ সিঁদুরের ছোঁয়ার উজ্জ্বল হয় স্বামীর মঙ্গল কামনায়। 
 
মালতির মাথা টা বেশ পরিস্কার। সঠিক ভাবে যত্ন নিলে পড়ালেখায় সে যে বেশ ভালো ফল করতে পারতো তা আর বলার অন্ত ছিলো না। 
এই অল্প ক দিনে সে বেশ কিছুটা লিখতে পড়তে শিখে গেছে। 
 
এদিকে নগেন আবার চলে আসে  মালতিদের বাড়ি। একেবারে দিন ক্ষন দিয়ে যায় বিয়ের। 
উপায় অন্ত না দেখে সে ছুঁটে যায় মাস্টারের বাড়ি। সব কিছু খুলে বলে তাদের। এসব কথা শুনে মাস্টার ও তার গিন্নী বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। নগেনের যা আধিপত্য তাতে বাধা দিলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। থানার সব দারোগা ওদের কথায় উঠে বসে। গ্রামের মানুষ যেমন নিরীহ তাতে কেউ আগ বাড়িয়ে প্রতিবাদ করবে সে মনের জোর বা সাহস কারো নেই। তাই সব দিক চিন্তা করে রাজি না হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা মালতির মায়ের। এক রকম নিরাশ হয়েই ফিরে আসে বাড়িতে। মালতি বুঝতে পারে সবটাই। কিন্তু একটা অসহায় মেয়ের কি বা করার থাকে। হয় মরো নয়তো সেচ্ছায় আগুনে ঝাপ দিয়ে বাকি জীবনটা রঞ্জুর বউ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেয়া। বৃদ্ধ মা টি তার কি বা করতে পারবে তার জন্য। হয়তো বিয়ে হলে তার সাথে তার মায়েরও দু মুঠো ভাত জুটবে কপালে। হায়রে ভাতের জ্বালা, হায়রে জীবন, হয়রে দরিদ্রতা। এখন মনে হয় গরীব হয়ে জন্মানোটাই বুঝি এক আজন্ম পাপ। 
 
ঠিক দুমাস পর সুভাস ডাক্তারি পাশ করে নিজ গ্রামে ফিরে এলো। গ্রামের হাসপাতালেই জয়েন করলো সে। এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে মালতির। গত অগ্রহায়ণ মাসেই বিয়ে হয়ে যায় মালতির। 
সুভাস এসেই তার মায়ের কাছে সবটা শুনতে পায়। মনে মনে এক গভীর কষ্ট অনুভব করে মালতির জন্য। না, সেটা প্রেম বা ভালোবাসা নয়। একটা স্নেহে যেনো সুভাস আটকে রেখেছিলো মালতিকে। মেয়েটি পড়ায় বেশ ভালো। ভেবেছিলো এবার তাকে পড়ার সুযোগ করে দিবে। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিবে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তা আর হতে দিলো না। 
 
কেমন আছে মালতি?  সে কি সুখি আছে?  বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে সুভাসের। ভাবছে একবার নগেনের বাড়ির দিকে যাবে। যদি কোন ভাবে দূর থেকে হলেও দেখা মেলে তার। 
যে কথা, সেই কাজ। সুভাস রওনা হয় নগেনের বাড়ির দিকে। বেশ বড় অট্টালিকা বলা চলে। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট।চারদিকে নানা রকম গাছ। ভালোই তবে আছে মালতি, মনে মনে বলে সুভাস। এতো বড় বাড়ির বউ যখন, তখন তো ভালো থাকবারই কথা। এটা ভেবেই সে ফিরে আসছিলো। এমন সময় একটি মেয়েকে দেখা গেলো পুকুর ঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে।কে মেয়েটা?  মালতি নয় তো?  সুভাস কিছুটা এগিয়ে যায় পুকুরের দিকে। একটি গাছের আড়াল হতে দেখতে থাকে। হ্যাঁ, মালতিই তো। একি হাল হয়েছে তার। পুষ্ট শরীর টা এতো রোগা কেনো লাগছে? তবে কি সে ভালো নেই?  দূর থেকে মালতিকে ডাকলো সুভাস। 
সুভাস কে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ  ঘোর লাগার মতো চেয়ে থাকলো কিন্তু কি মনে করে এক ছুঁটে সে দৌড়ে চলে গেলো অন্দরে। মালতির এমন আচরণ সুভাসের মনটাকে আরো চিন্তিত করে তুলল।বাড়ি ফিরে এসে সে তার মাকে সবটা খুলে বলল।
— বলিস কি খোকা!  তুই গেছিলি ওখানে? কি সর্বনেশে কান্ড। কেনো গেছিস ওখানে?  খবরদার আর যাবি না। নগেনের লোকজন যদি একবার টের পায় তুই গেছিলি তবে হেস্তনেস্ত কান্ড বাধিয়ে বসবে। ওরা লোক ভালো নয়। মেয়েটার জন্য মনটা আমারও যে পুড়ছে না, তা নয়, খারাপও লাগছে। একদম মেয়ের মতো আমাদের ঘরে ছিলো সে। বড্ড ভালো মেয়ে। তবে সব ভালো মেয়ের কপালও যে ভালো হবে তা তো নয়। যাক,  আমরা কেবল ওর জন্য আশির্বাদ টুকুই করতে পারি খোকা। এর থেকে বেশি কিছু তো করতে পারবো না বল!  
— হুম, ঠিক বলেছো মা। আশির্বাদ করো, মেয়েটি যেনো ভালো থাকে। 
 
    আরে ঐ বউ, কই গেছোস?  বাড়িতে ঢুকে জোর গলায় ডাকতে থাকে রঞ্জু। 
— এই যে আমি, আপনি বহেন আমি আপনার জন্য পানি নিয়া আসি। 
— আরে খাঁড়া, জানোস না আমার ঘরে ঢুইকাই পানি লাগে,রেডি কইরা রাখতে পারোস না। সারাদিন কি করস। এই বলে চুলের মুঠি ধরে মালতিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় মেঝেতে। মালতি উঠতে চায়, কিন্তু তার আগে কোমরের বেল্ট দিয়ে তাকে মারতে থাকে। মালতি মুখ বন্ধ করে সহ্য করে যায়। সে জানে তার চিৎকারে বাড়ির কেউ তাকে বাঁচাতে আসবেনা। এভাবেই ছোট খাটো বিষয়ে মালতির উপর অত্যাচার বেড়েই চলে দিনের পর দিন। শুধু তাই নয়। রঞ্জু যখন তার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে মদের আসর বাসায় তখন মালতিকেও থাকতে হয় সে আসরে। গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলে দেবার জন্য। রঞ্জুর মদখোর বন্ধুরা মালতিকে নিয়ে রঙ তামাশার কথা বলে। মালতির উপচে পড়া রূপ, কখনো শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কত অকথ্য বিশ্রি ভাষায় মালতির শরীরের প্রশংসা করে। রঞ্জু কোনো প্রতিবাদ করে না। 
মদের আসর যখন ভেঙে যায় তখন সবাই মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। 
মালতি চলে যায় ঘরে। নিজের প্রতি এক রকম ঘৃনা ধরে যায় তার। এটা কেমন তরো জীবন?  সে এমন জীবন চায়নি। সেও তো স্বপ্ন দেখেছিলো, ছোট্ট একটা ঘর হবে তার। সে ঘরে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি থাকবেনা। একা শুধু কেঁদেই চলে মালতি। তার সে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়ার জন্য কেউ যে নেই তার পাশে। সে যে একা, বড্ড বেশি একা। প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো দিক হতে খুব একা। 
মালতি বের হয়ে আসতে চায় এই অভিশপ্ত জীবন থেকে।পারে না, সে কেবল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু মৃত্যুও যে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ধরা দেয় না। 
সেদিন রাতেও বসেছিলো মদের আসর। তার সাথে চলছিলো জুয়া খেলা। প্রথম চারবার রঞ্জু জুয়ায় জিতে বেশ টাকা কামিয়ে নিলো। পঞ্চম বার হতে সে খেলায় হারতে থাকল।হারতে হারতে যখন সে নিঃস্ব হলো তখন তার মেজাজ গেলো খারাপ হয়ে। বোতলের পর বোতল সে মদ খেতে লাগলো। মরিয়া হয়ে উঠলো জেতার জন্য। শেষ বারের মাথায় সে জিতলো। এভাবেই শেষ হলো একটি মদের আসর। ঐ আসরে অন্যান্য লোকদের মাঝে একজন নতুন লোককে মালতি দেখতে পেলো। যে পা হতে মাথা অবধি মালতিকে দেখে যাচ্ছিলো। খুব অসস্তি হচ্ছিলো লোকটির চাহুনীতে কিন্তু কিছু করবার ছিলো না তাই নিরবেই সয়ে যাচ্ছিলো সে।
        তিন চার দিন পর লোকটিকে আবার দেখা গলো রঞ্জুর সাথে কথা বলতে। ওদের মধ্যে কি কথা হলো বুঝতে পারলো না মালতি তবে রঞ্জুকে বেশ খুশিতে গদগদ দেখাচ্ছিলো। বেশ কিছু টাকা রঞ্জুর হাতে ধরিয়ে লোকটি বিদায় নিলো। আবার কোন অপরাধের খেলায় লিপ্ত হলো রঞ্জু? কার ভাগ্যে নেমে আসবে কালো অন্ধকার। 
বিয়ের পর থেকে রঞ্জুর এমন কুকীর্তি দেখতে দেখতে মালতি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।আরো কত দিন, কত বছর এমন  করে ক্লান্ত হবে সে নিজেও জানেনা। 
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে রঞ্জু মালতিকে কাছ ডাকে। তার গাল দুটি, দু হাতের তালুতে চেপে ধরে বলে,
— দেহি তো আমার রাঙা বউ ডারে কেমন লাগতাছে। 
রঞ্জুর এমন ভালো ব্যবহারে মালতির মনে কেমন সংকোচ বোধ হচ্ছিলো। এই স্বামী নামক মানুষটির প্রতি তার মনে বিন্দু মাত্র ভালোবাসা আর বেঁচে নেই, যা আছে তা কেবল ঘৃণা আর ঘৃণা। 
আজকাল রঞ্জুর পাশে বসতেও তার ঘৃণা হয়। রঞ্জুর স্পর্শ গুলোতে তার শরীর গুলিয়ে উঠে। তবুও কিছু করার নেই, সংসার নামক এই বদ্ধ দেয়ালের মাঝে সে যে এক বন্ধি ডানাহীন পাখি। বুক ভরা নিঃস্বাস নিয়ে উড়তে চাইলেও যে সে উড়তে পারে না। 
মালতিকে বলে বউ তুই তো আমার লাখ টাকার ধন। হুন তুই  কাইল সক্কালে ভালা একখান শাড়ি পইরা গতরে গয়না পইরা ছুনো পাউডার দিয়া ভালা করইরা সাজবি। তোরে লইয়া কাইল বেড়াইবার যামু। বুঝছোস? 
কই যামু আমরা বেড়াইবার?  মালতির প্রশ্ন। 
হাতের অঙ্গুল দিয়ে জোরে মালতির মুখটা চেপে ধরে রঞ্জু। বলে – একটু ভালা ব্যবহার করছি দেইখ্যা তোর মুখে দেহি খই ফুটবার লাগতাছে!  তোরে যেমনে কইছি তেমনে কাম করবি বুঝছোস? আমার কথার উপরে কথা কবি না। মনে থাহে যেন। এক ধাক্কায় সে মালতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো খাটে। 
এই বলে রঞ্জু চলে গেলো তার বাবার ঘরে কথা বলতে। 
মালতি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। প্রতিটি মেয়ের মনের দুঃখগুলো এই বালিশ নামক বস্তুটি জানে। কত কান্না ঝরিয়ে মনের দুঃখগুলোকে বের করে আনতে চায় বালিশের বুকে মাথা রেখে, সে কেবল জানে ঐ বালিশ। 
    অজানা এক আতঙ্কে মালতির বুক কেঁপে উঠে। বিয়ের পর কোনো দিন তো রঞ্জু তাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে কিনা মনে পড়েনা। এই সংসারে বউ হয়ে আসার পর তার কপালে লাঠি ঝাটা ছাড়া আর যে কিছুই জোটেনি। সেদিন লোকটি রঞ্জুকে এতোগুলো টাকা দিয়ে কি বলেছিলো?  তবে কি তার জীবনেই ঘটতে যাচ্ছে কোনো অঘটন?  ভেবে কূল পায় না সে।
সে দৌড়ে যায় শ্বশুরের ঘরের দিকে। চুপি চুপি কান পেতে ওদের কথা গুলো শুনে নেয় মালতি। যা শুনতে পেলো তা যেনো বিশ্বাসই করতে মন চাইছিলো না তার। মানুষের দ্বারা এতো নিচু কাজ করাও কি সম্ভব?  যে স্বামীর সংসারে মুখ বুজে সহ্য করে গেছে তাদের সব অন্যায় অনাচার তারা কি করে করতে পারে তার সাথে এমনটা?  মনের মধ্যে হাজার প্রশ্নের বীজ বুনে চলেছে ঠিকই তবে কোন ফল পায় না  মালতি। এই অন্ধকার সংসার থেকে তবে কি তার কোনো মুক্তি নেই? 
এই সমগ্র পৃথিবীতে আজ মালতি নিজেকে সত্যিই খুব একা মনে হলো। সে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো তার ঘরে। ঠাঁই বসে রইলো মেঝেতে। সকাল হলেই যে তার জীবনটা অন্য আরেক অভিষাপে ঢেকে যাবে। সে জীবনটাতো হবে আরো দূর্বিষহ। জ্যান্ত লাশ হয়ে দিনের পর দিন বেঁচে থাকতে হবে।নাহ্,আর নয়, এভাবে জীবন পার করার চেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যে ঢের বেশি ভালো। 
      সারা ঘর তন্ন  তন্ন করে খুঁজে একটা কাগজ  পেলো মালতি। এরপর একমনে কি যেনো লিখলো সে কাজটিতে। কিছুক্ষণ পর রঞ্জু ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো। পুরুষত্বের হিংস্রতা দেখাতে লাগলো মালতির উপর। বড্ড ঘৃণায় সে রঞ্জুর সকল স্পর্শ সহ্য করে নিলো ঠিকই তবে মনের ভেতর আদালা একটা অনুভূতি তৈরী হলো মালতির। সে যেনো আর এই পৃথিবীর কেউ নয়। একটা জিন্দা লাশ। এক বোতল মদ খেয়ে রঞ্জু মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো মালতি। আলমারি খুলে বিয়ের বেনারসীটা পরল সে, নিজের মতোন করে সেজে নিলো সে, গা ভর্তি গয়না পরলো, সিঁথীতে দিলো গাঢ় সিঁদুর, কপালে পরলো কুমকুমের টিপ। সাজলে যে মালতিকে এতোটা সুন্দর দেখায় তা হয়তো সে নিজের জানতো না। কিছুটা সময় চেয়ে রইলো নিজের দিকে। একি সে!! নিজেকে নিজের কাছে সত্যিই অপূর্ব লাগছিলো মালতির। এর পর সে গরু বাঁধার এক গোছা দড়ি ঝুলিয়ে দিলো সিলিং ফ্যানের সাথে………। 
       সকালে লোকজনে ভরে গেলো মালতির ঘর।থানার দারোগা এলো, আস্তে আস্তে করে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দেয়া হলো মালতির শরীরটাকে। মেয়ের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারলো না মালতির মা। গ্রামের সবার কাছে খবরটা পৌছাতে দেরি হলো না। শুধু সুভাস হাসপাতালে থাকাতে মালতির মৃত্যুর খবরটা সে পেলো না। ময়না তদন্তের জন্য লাশটি হাসপাতালে পাঠানো হলো।
       কিছু রোগির চিকিৎসায় ব্যস্ত ছিলো সুভাস।ওয়ার্ডবয় এসে খবর দিলো সুভাসকে। 
— স্যার আপনাকে এখুনি একবার ডা.মহিতোশ স্যার তার চেম্বারে দেখা  করতে বলেছেন। 
— ঠিক আছে, তুমি যাও, আমি এই রুগিকে দেখেই যাচ্ছি কেমন। 
— ঠিক আছে। 
     ডা. মহিতোশের চেম্বারে যখন ঢুকলো সুভাস তখন থানার দারোগাবাবুকে দেখতে পেলো।
— স্যার, আমায় ডেকেছেন? 
–হুম ডা. সুবাস। একটা কেস আছে। সুইসাইড কেস। পোস্টমর্টাম করতে হবে। 
— আমাকে?? 
— আপনি ছাড়া এ হাসপাতালে আর কে আছে বলুন। বোঝেনই তো হাসপাতালে ডাক্তারের কত অভাব। আপনি এতো সিনসিয়ার আপনার কাজে তাই এই কেসটা আপনাকেই দেখতে হবে। 
— ঠিক আছে স্যার, আমি দেখছি। 
দারোগাবাবু সুভাস কে বললেন, ডাক্তার সাহেব একটু তাড়াতাড়ি করবেন কাজ টা। বেশি কিছু রিপোর্টে লেখার দরকার নাই,তেমন কোনো আলামত পাওয়া যায় নাই এইটুকুই রিপোর্টে দিলেই চলবে। 
সুভাসের একটু রাগই হলো, কথাটা শুনে। 
সে বলল- দারোগা সাহেব আপনিই যখন সব ঠিক করে দিলেন তখন আমিই বা কেনো খামখা রিপোর্ট লিখতে যাবো বলুন তো?আর কেনোই বা আমাকে এ কাজ করতে বলা হচ্ছে?  যাস্ট নিয়ম রক্ষা করার জন্য? 
দারোগা বাবু একটু ইসস্তত বোধ করে বললেন, 
— ডাক্তার সাহেব দেখি রাগ করছেন। আমি আসলে ওভাবে কিছু বলিনি। 
— তাহলে, দয়া করে আমাকে আমার কাজ করতে দিন আর আপনি আপনার কাজ করুন। এটাই বোধ হয় ভালো হয়। 
দারোগাবাবুর মুখটা শুকিয়ে গেলো তখন। 
     একটি সাদা কাপড়ে ঢাকা রয়েছে লাশটা। আস্তে আস্তে কাপড়টি সারাতেই সুভাসের চোখে পড়লো সে ই চেনা মুখটা। দেখেই আৎকে উঠলো সুভাস। 
মালতি!! 
এ যে মালতির দেহ। কেনো আত্নহত্যা করলো ও। 
সেদিন পুকুর পাড়ে ওকে দেখেই বুঝেছিলো ও ভালো নেই। সেদিন যদি ভয় না পেয়ে, মায়ের বারণ না শুনে ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতাম তবে আজ হয়তো মেয়েটি এই লাশ কাটা ঘরে শুয়ে থাকতো না। শুধু মাত্র সমাজের কিছু মানুষ রুপি পশুর ভয়ে আমরা কত নিরিহ  মানুষকে এভাবে অকালে চলে যেতে দিচ্ছি। নিজের প্রতি বড্ড রাগ হচ্ছিলো সুভাসের। কিন্তু, আর নয়, মেয়েটির এ অবস্হা কেনো হলো তা জানা দরকার। 
সুভাস, মালতির হাত পা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। হাতের তালুটি মুঠোবন্ধি। মুঠোটি খুলতেই বেরিয়ে এলো একটি ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটি খুলতেই চোখে পড়লো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কিছু কথা। 
কাগজটি লেখা আছে –
” ভাবিনাই মাইয়া হইয়া জন্মানোর কত জ্বালা। মায়ের পেট থেইক্যা  বের হইতে না হইতে বাপ হইলো নিরুদ্দ্যেশ। আমার মুখটাও দেখলো না এক বারের লাইগ্যা। সেই থেইক্যা বাপের প্রতি আমার বেজায় রাগ। যেই পুরুষ তার নিজের সন্তানের মৃত্যু চায় হে কেমন বাপ?  যহন একটু একটু কইরা বড় হইতে লাগলাম তখন বেটারা তাগো চোখ দিয়া গিলা খাইতো আমারে। পুরুষ মাইনষের এমন আচরণে হেগো প্রতি আমার কেমন ঘেন্নাই আইতো মনে। তয় সব পুরুষ যে এক না, হেইডা বুঝবার পারছি সুভাস দাদারে দেইখা। নিজের ছুডো বইনের মতো দেখতো আমারে। আইজ, আমার জীবনের এই শেষ রাইতে এই যে আমি লিখতাছি এইডাও সুভাস দাদার জন্য। হের প্রতি আমার ঋণের কমতি নাই। সে আমারে কইতো মালতি, তোমারে বড় হইতে হইবো, নিজের সম্মান লইয়া বাঁচার মতো বাঁচতে হইবো। কিন্তু পারলাম আর কই? বিয়া কইরা যে স্বামী আমারে নিয়া আসলো এই সংসারে। প্রত্যেকটা দিন যে আমারে অসম্মান করছে, মাইর ধোর করছে, বাজারের লোকের সামনে আমার অপমান করছে, যে কিনা নিজের বউয়ের অপমানের প্রতিবাদ করেনাই সেই স্বামীই যে আমারে পতিতাখানার দালালের কাছে বেইচ্চা দিসে। নিজের কানে যদি আমি এই কথা না শুনতাম তাইলে আমার দেহটা পড়তো নানা পুরুষের বিছানায়। স্বামীর অনেক অন্যায় অত্যাচার আমি সহ্য করছি মুখ বইজ্যা। তয় আইজ নিজের এই চরম অপমান আমি আর মাইনা লইতে পারিনাই। শুধু আমি একটা অসহায় মাইয়া বইলা আমার এতো অসম্মান?  আইজ বুঝতাছি আমার মতো মাইয়া গোর জন্মই যেন একখান আজন্ম পাপ। জানি এই অন্ধকার সংসার জগত থেইক্যা আমার মুক্তি মিলবো না কোনো দিন। আমার এই লেখা কাগজটাও কারো চোখে পড়বো না, তা তে কি বা আসে যায়। তাই তো নিজের মনের কাছেই লিখ্যা গেলাম এতো কথা। বাইচা থাইকা তো নিজের সম্মান টুকু রক্ষা করতে পারমু না তাই মইরা গিয়াই না হয় নিজেরে মুক্তি দেই। “
সুভাস পড়ে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাবে কতটা অসহায় হয়ে কতটা তীব্র কষ্ট বুকে চেপে রেখে মালতি চলে গেলো এই নির্মম পৃথিবীর বুক থেকে।
    সুভাসের মনের মধ্যে জেদ চেপে যায়। মালতি বেঁচে থাকতে তাকে বাঁচাতে পারেনি ঠিকই তবে আজ যদি মালতির সম্মান টুকু ফিরিয়ে দিতে না পারে তবে বাংলার ঘরে ঘরে নারীরা অসম্মানিত হবে, অত্যাচারিত হবে আর এমনি করে চাপা আর্তনাদ বুকে নিয়ে কত মালতি ঝরে যাবে অকালে তার হয়তো সন্ধান কেউ পাবে না। মালতির লেখা কাগজটি বুক পকেটে রেখে দেয় সুভাস। মনে মনে পণ করে মালতির সুবিচারের। নগেন ও তার ছেলেকে সমাজের সব অপকর্ম থেকে সাজা যদি না দিতে পারে তবে শিক্ষিত মানুষের মুখোশ পরে সমাজে মুখ দেখানো বড় লজ্জার, বড় লজ্জার……..। জানি এ পথ বড় কঠিন, হারবে হয়তো, তবে পরাজয়কে জয় করার জন্য সুভাস লড়বে। একটি মালতির জন্য নয়, বাংলার সকল মালতির জন্য লড়বে। নয়তো পরপারে দাদা হয়ে মালতিকে মুখ দেখাবে কি করে………।
 
সংবাদটি শেয়ার করুন