ফিচার্ড সাহিত্য ও কবিতা

কাঁদছে লালন |||||| সুমিত মোদক

কাঁদছে লালন |||||| সুমিত মোদক
 
ওরা ছেলেটাকে এক মুঠো খেতে দিল ,
আবার পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে দিল ;
ওরা লালনের গান গাইলো ,
আবার জন্ম ভুমিতেই পরবাসী করে দিল ;
ওরা লাজুক প্রেমিকাকে তুলে নিয়ে গেল
বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ;
 
এরা স্টেথোস্কোপটা ছিঁড়ে দিলো ,
খুবলে খুবলে খেলো মেয়েটাকে ;
এরা  ভেঙে দেয় , পুড়িয়ে দেয় প্রমাণ ,
বিবেক , বোধ মনুষ্যত্ব …
সব , শব …
এরাই আবার মোমবাতি  মিছিলে পা মেলায় রাত দখলের ;
এরাই লালনের কথা বলে ;
অথচ , চেনেনা লালন সাঁই , ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ;
 

প্রথম জীবনের লাজুক প্রেমিকা নিখোঁজ হয়ে গেল ;

নিখোঁজ হয়ে গেল গোটা একটা সমাজ ;
কেবল পড়ে থাকা জলের রেখা গুলো বহন করে চলেছে অস্থিরতার মুহুর্ত ;
একের পর এক ভেঙে পড়ছে প্রাচীন সভ্যতার
কারুকাজ করা স্তম্ভ গুলো ;
শব্দ উঠছে , বিকট শব্দ …
 
কোথাও কোনও মানুষ নেই যে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে ;
খুঁটে খুঁটে তুলে নেবে ভালবাসার আকর ;
এত চিৎকারে , এত কান্না , এত খুন , এত লজ্জা
এক জীবনে সহ্য করা সম্ভব নয় মানবতায় ;
যারা পথের বাইরে , তারা কি ভাবে জানবে
পথ কোথায় গিয়ে মিশেছে !
কোথায় নদীর উৎপত্তি স্থল তা কেবল জানে
সচেতন নাবিক ;
জানে মোহনা …
 
নদীতে এখন ভাঁটা চলছে ;
একের পর এক ভেসে উঠছে চরভূমি ;
অথচ , ইছামতি নদী জানে দু পাড়ের খবর ;
জানে কিভাবে জনপদ গড়ে উঠল ;
কি ভাবে শুরু হল প্রেম ;
কি ভাবে ভেঙে গেল সাজানো স্বপ্ন ;
 
চারি দিকে কেবল ভয় আর ভয় ;
শ্মশান ভূমি জুড়ে শুরু হয়েছে প্রেতাত্মাদের উল্লাস ;
সূর্যের আলোও সেখানে ঠিক মতো করে
পৌঁছতে পারছে না ;
কিসের এতো ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে !
ঠিক ঠাক বুঝতে পারছে না নরম হৃদয় গুলো ;
 
আগে এতো আগুন ছিল না পোড়া কাঠে ;
তা হলে কিসের জন্য এতো ধোঁয়া !
এতো শ্বাসকষ্ট , অধঃপতনের বিজয় উৎসব ;
ইছামতি বয়ে চলেছে সামনে ;
আরও সামনে ঠিক হৃদয়ের কাছাকাছি 
জীবনের কাছাকাছি ;
অথচ , জীবন দুই পাড়ে শূন্য , মহাশূন্য ;
একটা কৃষ্ণগহ্বর গিলে নিচ্ছে আলোর তরঙ্গ ;
 
যখন ফিরবে মানুষ মনুষত্বের কাছে ;
হয়তো সে সময়ে ফিরে আসতে পারে 
সেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া প্রেমিকা ;
যে কিনা হৃদয়ের গভীর থেকে আরও গভীর
বেঁচে থাকা ভালবাসাটুকু বার করে আনবে 
নতুন আরেক জনপদ গড়ে তোলার জন্য ;
 
মুখোশের কোনও জাত হয় না ;
পাত হয় না …
কারণ , মুখোশ আরেক মুখোশ গিলে খায় ;
শেষ হয়ে যায় এক সময় ;
মেরুদণ্ড ভাঙা জীব যেভাবে  হামাগুড়ি দিয়ে চলে ,
মাথা উঁচু করে বাঁচে না ;
ঠিক সে ভাবেই  বেঁচে থাকে একটা সীমারেখা ;
সেটাকে কে অতিক্রম করবে !
 
একটু একটু করে ভাঙা কাচ বার বার প্রতিবিম্ব
ছড়িয়ে দিচ্ছে বিক্ষিপ্ত হৃদয়ে ;
সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে শুকনো গাছ গুলো 
তার খসে খসে পড়া বাকল নিয়ে ;
এক সময় এখানে চু-কিৎ-কিৎ .… খেলতো কিশোরী মেয়েরা ;
আর একটু দূরে ছেলেদের হাডুডু খেলার মাঠ ;
আজ সবটাই পড়ে আছে বিবর্ণ রঙ নিয়ে ;
 
সবটাই চলে গেছে মেধার দখলে ;
যারা স্বপ্ন দেখালো আকাশ কুসুম , 
তারাই এখন রূপকথার রাজ্যে ডানা মেলে 
উড়ে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে ;
পথ জুড়ে উড়ছে ধুলো আর ধুলো ;
শ্বাস নিতে খুবই কষ্ট …
 
দেহাতি মানুষ গুলো মনে করে ছিল এবার হয়তো
আকাশ থেকে ঝরে ঝরে পড়বে জ্যোস্নার রেণু ,
ভালবাসার লাজুক সোহাগ ;
কিন্তু , একের পর এক আগুনের দাউ দাউ করে
পুড়ে গেল ঘর, সংসার , ভবিষ্যৎ ;
রক্তের দাগ উঠান জুড়ে ;
ঝোপের আড়াল থেকে  খুঁজে পাওয়া নাবালিকার ছেঁড়া জামা  ;
দেহাতি মানুষ গুলো চিতা কাঠের আগুনে 
সিঁকে নেয় দেশত্ববোধ ;
 
মিছিল দিন দিন লম্বা হচ্ছে ;
সমবেত চিৎকার দিন দিন শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি করছে ;
অথচ , লালন সাঁই কাঁদছে হাউ হাউ করে ;
একতারাটা যারা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলো
তারাই এখন প্রেমের গল্প শোনায় ;
সময়ে অসময়ে দিয়ে চলে মানবতার পাঠ ;
গিলে খাচ্ছে শতাব্দীর সকাল ;
 
একটা রাত আরেকটা রাতের মধ্যে ঢুকে পড়ছে
কাউকে কিছু না বলে ;
রাতও অসহায় হয়ে পড়ছে নিজের কাছে ;
ছায়া ছায়া মূর্তি গুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে 
এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ,
এক শহর থেকে আরেক শহরে , রাজপথে .…
 
অনাবাদি জমি জুড়ে শরতের কাশ ফুল দুলছে ;
মা আসছে আলতা রাঙা পায়ে ;
বদ্ধ জলাশয়ে ফুটছে নানারঙের শালুক 
উত্তরের বাতাস মুচকি হাসছে ;
দিকে দিকে বেজে উঠছে অকালবোধনের সুর ;
পটশিল্পী একটা একটা করে এঁকে চলেছি পট ;
সেই সঙ্গে বেঁধে নিচ্ছে গান ;
লালন সাঁই সেখানেই নীরবে চলে এসেছে
একতারার তারটি নিয়ে ;
তার পর !
তার পর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে উচ্চস্বরে গাইছে ;
এক পা এক পা করে মানুষ ও মনুষ্যত্ব 
হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাচ্ছে সেখানে ;
এক জন , দু জন  , তিন জন হতে হতে
শত সহস্র মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়েছে  চিত্ৰপটের কাছাকাছি ;
একে বারে গভীর অন্ধকারের মুখোমুখি ;
বাধ্য হয়ে অমাবস্যার রাত নতজানু হয়ে পড়ে ;
 
লাজুক প্রেমিকা আলতা রাঙা পায়ে 
সকলের আগে এগিয়ে চলেছে ভোরের আলোর দিকে ;
হাতে তার রঙবেরঙের শালুক ফুল ;
দু চোখে তার আনন্দ উৎসব ;

কণ্ঠ মেলায় লালনের কণ্ঠে, শান্তির পথে ।


সংবাদটি শেয়ার করুন