শ্রুতি নাটক – সংস্কার ।। -সুশীল কুমার পোদ্দার
(সুধী যাত্রীবৃন্দ, বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকে আপনাদের জানাচ্ছি সুস্বাগতম। আপনারা দাঁড়িয়ে না থেকে আপন-আপন আসনে বসে পড়ুন। আপনাদের প্রত্যেকের আসনের সামনে ড্যাশবোর্ড থেকে পছন্দ মতো অডিও-ভিডিও উপভোগ করুন। আমাদের সযত্ন আদর-আপ্যায়নে আপনাদের ভ্রমণ হোক আরামদায়ক ও নির্বিঘ্ন)
স্বামী:
এই সর তো! আমি আজ জানালার ধারে বসে বাংলাদেশ দেখব। অ্যা! কত দিন পর দেশে যাচ্ছি! দেশটা স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। মানুষ আজ মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অ্যা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
বউ:
কি গো, সৌজন্যটুকুও ভুলে গেছ? Ladies first! এই চিরন্তন সত্যটাকেও আজ সম্মান দিতে ভুলে যাচ্ছ?
স্বামী:
সময় বদলে গেছে। অনেক advantage নিয়েছো। ভুলে যাও পুরোনো জামানার কথা। Ladies first কথাটার একটা সংস্কার দরকার। দেখি, ট্রাম্পের সাথে কথা বলে একটা executive order pass করা যায় কি না!
বউ:
না, তুমি অনেক বদলে গেছ। তোমার সাথে কোথাও যেতে আজ বড় সমস্যা হচ্ছে। কী জানি বাবা, সারাদিন work from home আর social media তে হাবিজাবি দেখে দেখে তোমার আচরণ, রুচি দেখি দিন দিন তলানিতে ঠেকছে। ঠিক আছে, তুমিই জানালার ধারে বসো, আর আমি বসে বসে চোখ বুজে গান শুনি।
স্বামী:
তা কী গান শুনবে শুনি? নিশ্চয়ই রবীন্দ্র সঙ্গীত? যুগ বদলে গেছে। যা কিছু পুরাতন, তা হলো জীর্ণ। পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে তুমি বেঁচে থাক, আমি নই। কী সব গানরে বাবা-
“ওরে ভাই, আগুন লেগেছে বনে বনে…”
আরে ব্যাটা, আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কর, তা না করে উসকে দিচ্ছিস! কী জানি, লস অ্যাঞ্জেলসে যে আগুন লেগেছিল, তাতে কি ঐ বুড়ার হাত ছিল কিনা! ট্রাম্পের সাথে কথা বলে একটা executive order pass করতে হবে।
বউ:
এতে বেশ ভালো হবে। যারা ট্রাম্পকে দেখতে পারে না, তাদের কাছে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা শতগুণ বৃদ্ধি পাবে। পাকিস্তান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আইয়ুব খান যা করতে পারেনি, তা ট্রাম্প করে দেখাল বলে ওকে মাথায় তুলে নিয়ে নাচবে। ঠিক আছে, আমি না হয় দেশাত্মবোধক গান শুনি!
“এক সাগর রক্ত পেরিয়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা…”
স্বামী:
এই, তুমি কী গানের সাথে গুনগুন করছ— “এক সাগর রক্ত পেরিয়ে”? আচ্ছা, এই গানটা কোন ব্যাক্কল লিখেছে শুনি? এক সাগর রক্ত! আরে ব্যাটা, সাগর চিনিস? এত বাড়িয়ে বাড়িয়ে লিখে সঠিক ইতিহাস বদলে ফেলছিস! না, জাতিকে সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। এসব গানের সংস্কার দরকার, আর এইসব কবি-লেখকদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জেলে পুরা দরকার।
বউ:
তাহলে না হয় একটা লালনগীতি শুনি—
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি করে।।
স্বামী:
এই থাম থাম! কী অশ্লীল, কী অশ্লীল! এ ব্যাটাও তো দেখি বজ্জাত! উঁহ! এই গানটা শুনলেও পাপ!
বউ:
আচ্ছা, তোমার বাবা-মায়ের, মানে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির নাম মনে আছে?
স্বামী:
ইয়ার্কি করছ! বাবা-মায়ের নাম মনে থাকবে না ! বাপের নাম বগলা মিয়া, মা বাতাসী বেগম।
বউ:
বলতো, এগুলো কোনো নাম হলো? বড় বেশি জীর্ণ! বদলে ফেলো তাদের নাম। লজ্জায় যদি নাম বলতে বিব্রত হও, তবে না হয় বল তুমি স্বয়ম্ভূ! তোমার মনে হয় না— পূর্বপুরুষের নামের সংস্কার প্রয়োজন?
স্বামী:
বড় বেশি বাড় বেড়েছে তোর! কথায় কথায় আমার ভুল ধরিস! চল, আগে দেশে যাই।
বউ:
ব্যা, কথা মনে না ধরলেই তুই তোকারি! ঠিক আছে, আগে দেশে পৌঁছি তো! আসলে তোমার চিকিৎসা দরকার।
________________________________________
(সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ, আপনাদের জন্য বাংলাদেশের আসল ethnic cuisine serve করা হবে। Please enjoy!)
স্বামী:
এ কী খাবার দিছে রে? মাছটা কেমন চোখ উল্টে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে! ঐ বেটি না কইল— ethnic cuisine, এ যে দেখি তেলাপিয়া!
বউ:
জান না, বাঙালি ইলিশকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছে। চারিদিকে সংস্কার চলছে তো! এখন জাতীয় মাছ হলো তেলাপিয়া।
স্বামী:
সাব্বাস! তাই তো বলি, এত স্বাদ কেন? অনেক আগেই এ সংস্কার করা উচিত ছিল! আমার সোজা কথা— পাশের বাড়ির মানুষ যা খাবে, তা আমি খাব না। ইলিশের বড় বাড় বেড়েছিল! যাক, খাওয়াটা বেশ ভালোই হলো। এখন একটা ঘুম দেই, আমায় ডেকে দিস।
________________________________________
(সুধী যাত্রীবৃন্দ, আমাদের বিমান একটা টারবুলেন্সের মাঝে পড়েছে। আপনারা আপনাদের সিটবেল্ট বেঁধে ফেলুন। আমাদের দক্ষ পাইলট খুব শীঘ্র বাংলাদেশকে, সরি, বাংলাদেশ বিমানকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।)
বউ:
এই উঠ, দেখো বিমান কাঁপছে! আমার বড় ভয় হচ্ছে, বিমানটা ভেঙে পড়বে নাতো?
স্বামী:
আরে কাপতে দে, কতো কাপা দেখলাম। এই, আমার তো পাইলটকে নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। মনে হয়, ঐ ব্যাটা ২৬ লাখের মাঝে একজন নয়তো! ওর পরিচয়পত্র পরীক্ষা করা দরকার!
বউ:
Oh my God! সবকিছুতে তোমার সন্দেহ! আমি আর পারছি না!
________________________________________
(সুধী, বিমান বাংলাদেশে ভ্রমণের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আর অল্প কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের বিমান অবতরণ করবে।)
বউ:
এই ওঠো, দেশে চলে এসেছি!
স্বামী:
আগে জাগাবি তো? অ্যাঁ! দেশটাকে ভালো করে তো দেখতে পেলাম না!
বউ:
কতদিন পর দেশে আসলাম! হাজার হলেও দেশের মাটি—
“ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা…”
স্বামী:
ভাবছিলাম, দেশটার মনে হয় অনেক উন্নতি হয়েছে। এ তো দেখি একই যানজট!
বউ:
এই দেখো দেখো, কৃষ্ণচূড়া! আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
স্বামী:
কৃষ্ণচূড়া— বড় সাম্প্রদায়িক নাম! আর ওর রঙটা নিয়েও আমার আপত্তি! সংস্কার প্রয়োজন!
বউ:
ঐ দেখো দেখো, দোয়েল চত্বর!
স্বামী:
দোয়েল এখনো কি আমাদের জাতীয় পাখি? এতো পাখি থাকতে দোয়েল কেন? সংস্কার প্রয়োজন!
বউ:
তা কাকে বানানো দরকার জাতীয় পাখি— কাক না শকুনকে?
স্বামী:
না, সব বদলে ফেলা দরকার! এ জাতির, এ প্রকৃতির সংস্কার প্রয়োজন! বার মাসের নাম, ঋতুর নাম— সব কিছুর সংস্কার প্রয়োজন! সংস্কার ছাড়া এ জাতির মুক্তি নেই।
বউ:
আপনারা কেউ আমার স্বামীকে নিয়ে উপহাস করবেন না। ও ভীষণ অসুস্থ! সংস্কার নামক এক অলীক মানসিক রোগে আক্রান্ত! বাংলাদেশে নাকি এ রোগ মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে! ডাক্তার বলেছেন, তাকে নদীর কাছে নিয়ে যেতে , নিয়ে যেতে শিমুল পলাশের কাছে, নিয়ে যেতে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে, যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমাদের অতীত ইতিহাসের বীর সৈনিকেরা। আমি আমার স্বামীকে নিয়ে যাবো ছায়া ঢাকা আমার সবুজ গ্রামে। আমি ওকে ফিরে পেতে চাই…