কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত ১২টি কবিতা ।।।। বিচিত্র কুমার
(০১)
বিদ্রোহের ঢেউ
তুমি এসেছিলে ঝড়ের মত—শব্দে শব্দে জাগিয়ে তুলেছিলে ঘুমন্ত জনপদ।
তোমার কলম ছিল বজ্রধ্বনির মতো—যা শব্দে নয়, রক্তে বিদ্যুৎ ছড়ায়।
তুমি লিখেছিলে অগ্নিগিরির ছায়ায় দাঁড়িয়ে—যেখানে কবিতা নয়, প্রতিটি চরণ ছিল অস্ত্র।
তুমি কেঁদেছিলে কিশোর মনের মত—যে ভালোবাসে, অথচ বিদ্রোহে জ্বলে।
তোমার চোখে ছিল মহাকাল—যেখানে প্রেম আর প্রতিবাদ পাশাপাশি হাঁটে।
তুমি ছিলে সময়ের সুর—যা বাঁশির মতো নয়, দামামার মত বেজে ওঠে।
তুমি গেয়েছিলে ধ্বংসের গান—যার ভিতর থেকেই উঠে আসে নতুন সৃষ্টির ধ্বনি।
তোমার কবিতা ছিল জ্যোৎস্নায় ভেজা বুলেট—যা প্রেম করে, তবু বিদ্রোহ ফোটায়।
তুমি আজো জেগে আছো, শব্দের ভিতরে আগুন হয়ে—শুধু কাগজে নয়, মানুষের হৃদয়ে।
(০২)
চিরকাল কবি
তুমি এসেছিলে নির্জনতা ভেঙে—যেমন প্রলয় নামে নিঃশব্দে, তবু সব কিছু বদলে দেয়।
তোমার প্রতিটি কবিতা ছিল নদীর মত—যা পাহাড় ভাঙে, আবার চারণেও গান হয়ে গায়।
তুমি তুলেছিলে স্বর—যা শ্রুতিমধুর হলেও অন্তরে গাঁথে বিদ্রোহের কাঁটা।
তোমার চোখে ছিল উপমার আগুন—যে ছুঁয়ে দেখে দারিদ্র্য, প্রেম আর প্রতিহিংসা একসাথে।
তুমি দাঁড়িয়েছিলে সত্যের মুখোমুখি—যেখানে মানুষ কাঁপে, তুমি লিখেছিলে।
তোমার রক্তে ছিল সাহস—যা কাঁপিয়ে দেয় সভ্যতার দেয়াল।
তুমি গেয়েছিলে এমন প্রেমের গান—যা ঈশ্বরকেও মানুষের কাছে নামিয়ে আনে।
তুমি কবিতা বানিয়েছিলে অস্ত্র—যা শাসক বুঝে না, আর শোষিত কাঁদতে কাঁদতে মুখস্থ করে।
তুমি চিরকাল কবি ছিলে না—তুমি চিরকাল ছিলে এক জাগ্রত চেতনা।
(০৩)
নজরুলের জোছনা
তুমি ছিলে সেই জোছনা—যে কেবল সুন্দর নয়, দ্রোহে ভেজা দীপ্তি।
তোমার কবিতা ছিল পাথরেও ফুটে ওঠা গোলাপ—কাঁটা দিয়ে জাগায়, রক্তে স্নান করে।
তুমি শিখিয়েছিলে—শব্দ দিয়ে কাঁদানো যায়, আবার হাসানোও যায়।
তোমার প্রেম ছিল না বুনো ফুলের মত—তোমার প্রেম ছিল বজ্রবিদ্যুতের মত আলো ও অস্থিরতা।
তুমি প্রেমে লিখেছিলে বিপ্লব—যেখানে চুম্বনের মধ্যেও বারুদের গন্ধ থাকে।
তোমার ছন্দ ছিল না স্রেফ ছন্দ—তা ছিল জনতার মিছিলের পায়ের শব্দ।
তুমি হেঁটেছিলে সেই পথ দিয়ে—যেখানে কেউ যায় না, তবু সবাই চায় পৌঁছাতে।
তুমি গড়েছিলে এক প্রেম, যা সময়ের সীমানা ভেঙে মানুষকে খুঁজে ফেরে।
তোমার শব্দে আজো জেগে থাকে জোছনার মত প্রতিবাদ—শান্ত, অথচ জ্বালাময়ী।
(০৪)
শিকলভাঙা সুর
তুমি ছিলে সেই বাঁশির মতো—যা কারাগারের অন্ধকারেও মুক্তির সুর বাজায়।
তোমার গলায় ছিল আগুনঝরা দোহার—যা ভাঙে রাজদরবারের স্তব্ধতা।
তোমার কণ্ঠে ছিল মোহরহীন মুদ্রার মত সাহস—যা ব্যাঙ্কে জমা পড়ে না, হৃদয়ে ছাপ রাখে।
তুমি ছিন্নমূলের প্রতিধ্বনি—যার রক্তে জমেছে ক্ষুধা, ঘামে ফুটেছে গীত।
তুমি দাঁড়িয়েছিলে শোষকের মুখোমুখি—নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছিলে অন্যায়ের গালে।
তোমার কলম ছিল বিদ্যুৎনির্ঝরার মতো—প্রতিটি শব্দে ফেটে পড়ে আলোর ধ্বনি।
তুমি অন্ধকারে জন্ম নেওয়া এক দুরন্ত তারা—যে পথ দেখায় অথচ নিজে জ্বলে মরে।
তোমার সৃষ্টি ছিল কাঁটার মালা—যা ফুল না হয়েও বুকের গহীন আলো হয়ে থাকে।
তুমি একা হয়েও ছিলে এক জনপদের চিৎকার—যা থামাতে পারে না কোনো সেনানী, কোনো মন্ত্রী।
তোমার চরণে বেজেছে দ্রোহের উলুধ্বনি—যা মন্দির ভাঙে না, কুসংস্কার চুরমার করে।
তুমি কবি হয়েও ছিলে বিপ্লবীর তলোয়ার—ধার ছিল শব্দে, ঘা ছিল সাহসের।
তুমি শেখালে কিভাবে বন্দিত্বের মধ্যে থেকেও আকাশের মতো মুক্ত হওয়া যায়।
(০৫)
আগুনপাখি
তুমি ছিলে গলিত সিসা—যা গায়ে ঢাললে পোড়ে, অথচ ভিতরে আগুন ছড়িয়ে দেয় জেগে ওঠার।
তোমার শৈশব ছিল বেদনার বাঁশির মতো—চোখের জলে বাঁধা, তবু সুরে পরিপূর্ণ।
তুমি হেঁটেছিলে নক্ষত্রহীন পথ—যেখানে জোছনা ছিল না, শুধু নিজের চোখের জ্বালা।
তোমার জীবন ছিল কুঁড়েমাছের ঝাঁকের মতো—পানিতে খেলেও জানত স্রোতের বিপরীতে যাওয়া মানে জীবন।
তুমি গেয়েছিলে এমন গান, যা রাজপথে না বাজলেও গ্রামের কান্নার ভিতরে ঢুকে যায়।
তোমার মুখে ছিল পেটের ক্ষুধা, কিন্তু কণ্ঠে ছিল সভ্যতার চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতি।
তুমি ছিলে উড়ন্ত ছাই—যা আগুনের সাক্ষী থেকেও বাতাসে রূপ নেয় স্বাধীনতার।
তুমি নিজের ভাঙন দিয়ে গড়েছিলে জাতির আত্মা—যেখানে কান্না থেকেও উঠে আসে অমল রাগ।
তোমার প্রতিটি চরণ ছিল কাফনের মতো—মৃত ভাষাকে মুড়িয়ে জীবন দেয়।
তুমি ইতিহাসের শোকরেখায় রঙধনুর মতো জেগেছিলে—যেখানে যুদ্ধ আর প্রেম পাশাপাশি হাঁটে।
তোমার কবিতার শিরা বেয়ে বইত সান্ত্বনার লোভ নয়, বরং বিপ্লবের অস্থিরতা।
তুমি শেষ অবধি থেকে গেলে এক গভীর নীরবতা—যার ভিতরে এখনো বাজে আগুনের গোপন গান।
(০৬)
শব্দসৈনিক
তুমি ছিলে এক অদৃশ্য ব্যারাকে দাঁড়িয়ে থাকা কণ্ঠসৈনিক—যার অস্ত্র কেবল চরণ, আর প্রতিরক্ষা তার দুঃখ।
তোমার প্রতিটি কবিতা ছিল তীরের মতো—যা প্রেমে বিঁধেও বিদ্রোহের রক্ত ঝরায়।
তুমি লিখেছিলে এমন এক শ্লোক, যা কোনো ধর্মের নয়, সব ধর্মের অভ্যন্তরের আর্তি।
তোমার শব্দ ছিল বৃষ্টির মতো—যা চাষা চায় ফসলের আশায়, কিন্তু খাল ভেঙে শহরও ডুবিয়ে দেয়।
তুমি নতজানু ছিলে কেবল গানের কাছে—মানুষের কাছে নয়, প্রভুর কাছে নয়, শব্দের কাছে।
তুমি গেয়েছিলে ‘চল চল’—যেখানে থেমে যাওয়া মানেই দাসত্ব, আর হাঁটলেই ছিন্ন হয় শিকল।
তোমার চোখ ছিল তালপাতার মতো—পাঠ্য নয়, কিন্তু পড়ে কেউ কেউ দিগন্ত দেখে।
তুমি শব্দে এক খণ্ড বিদ্যুৎ—যা না ছুঁয়ে বিশ্বাস করা যায় না, আর ছুঁলে কেঁপে উঠতে হয়।
তোমার সৃষ্টি ছিল কোরাসের মতো—একটা নয়, শত কণ্ঠে জেগে ওঠা একটি চেতনা।
তুমি আজো বেঁচে আছো ভাষার পরতে পরতে—যেখানে একেকটি উচ্চারণ জন্ম দেয় বিপ্লবের ব্যাকরণ।
তুমি শেষমেশ হয়ে গেলে বাংলার মগ্ন ধ্বনি—যা নিঃশব্দ থেকেও বহন করে কালের স্রোত।
তুমি কবি ছিলেন না শুধু—তুমি শব্দের সেই সেনানী, যার মৃত্যু মানেই শব্দহীনতা।
(০৭)
আগুনের পংক্তিমালা
তুমি কবিতা লেখো না—তুমি নিজেই এক আগুনের কবিতা,
যার প্রতিটি অক্ষরে আছে জ্বলে-পোড়া বিপ্লবের ধ্বনি।
তোমার নিঃশ্বাসে মিশে থাকে লেলিহান শিখার ব্যাকুলতা,
যেমন শুকনো পাতায় লাগে আগুন, আর বন ছারখার হয়ে ওঠে।
তোমার কলম যেন বিদ্রোহের বারুদ, কাগজে ছড়ায় বারুদের ঘ্রাণ,
যেখানে মিশে থাকে মাটির রক্ত আর লাঞ্ছিত মানুষের আর্তনাদ।
তুমি লেখো না, তুমি জাগাও—ঘুমন্ত বিবেককে চাবুকের ভাষায়,
যেমন উল্কার পতনে কেঁপে ওঠে মহাশূন্যের গম্ভীরতা।
তুমি আগুন, কিন্তু নিছক জ্বালানোর জন্য নয়—
তুমি পোড়াও শিকল, পোড়াও দাসত্বের চিহ্ন,
আর ছাইয়ের ভেতর থেকে জন্ম দেয় কোনো নতুন সকাল।
(০৮)
প্রেম যেখানে প্রলয়
তোমার ভালোবাসা যেন কেবল গোলাপের ঘ্রাণ নয়,
তার নিচে লুকিয়ে থাকা কাঁটার মতো এক অন্তর্গত বিদ্রোহ।
তুমি ভালোবাসো না কেবল মধুরতায়,
তুমি ভালোবাসো বিস্ফোরণে, যেমন প্রেমিক চাঁদের মুখে পড়ে রক্তিম আকাশ।
তোমার প্রেমে আছে অগ্নির আলিঙ্গন,
যা জ্বালায় প্রিয়তমার চোখে স্বপ্নের দীপ্তি, আবার ব্যথার রেখা।
তুমি চোখে চোখ রাখো, কিন্তু সেখানে থাকে বজ্রের চিহ্ন,
যেন ভালোবাসা যদি মুক্তি না দেয়, তবে সে শৃঙ্খল নয়—শাস্তি।
তুমি চাও না বন্দী ভালোবাসা,
তুমি চাও উড়ে যাওয়া ভালোবাসা—পাখির মতো, বজ্রের মতো,
যা ছিন্ন করে সমাজের সব মিথ্যা নিয়ম।
তুমি এমন প্রেমিক, যে ভালবাসার মধ্যেও বিপ্লবের রক্ত খোঁজে।
(০৯)
একাকী বিদ্রোহী
তুমি যখন চুপ ছিলে, তখনও শূন্যতা কথা বলেছে,
কারণ তোমার নীরবতা ছিল জ্বলন্ত অগ্নিস্নানের মতো পবিত্র।
তুমি যখন হেঁটেছো একা, তোমার ছায়াও পিছনে রণহুঙ্কার দিয়েছে,
যেন প্রতি ধাপে বজ্রনিনাদ হয়ে পৃথিবী কেঁপে উঠেছে।
তোমার নিঃসঙ্গতা ছিল না দুর্বলতা—
তা ছিল এক তীর্থভূমি, যেখানে তুমি নিজেকে গড়েছো নবপ্রতিমা করে।
তুমি শিখিয়েছো, কাঁধে কাঁধ না থাকলেও, কণ্ঠে থাকলে আগুন,
পাহাড়ও পথ ছাড়ে।
তুমি দাঁড়িয়েছিলে ইতিহাসের বিপরীতে,
আর সেই একাকীত্বই ছিল সূর্যোদয়ের গর্ভগৃহ।
তুমি ছিলে একাকী, কিন্তু কখনো একা নও,
তোমার মতো একাকীত্বে জন্মায় শত বিদ্রোহী।
(১০)
কলমের তরবারি
তোমার হাতে কলম ছিল না—ছিল তরবারি,
যা কাগজের বুক চিরে ফুটিয়ে তুলত সত্যের রক্তরেখা।
তুমি কালি দিয়ে লিখোনি, লিখেছো কষ্টের নির্যাসে,
যেমন নদী লেখে তার ইতিহাস পাথরে পাথরে ক্ষয় দিয়ে।
তোমার শব্দ ছিল ছুরির ধার,
যা মিথ্যাকে কাটে আবার আশার বীজ বপন করে শূন্য জমিতে।
তুমি বইয়ের পাতায় এঁকেছো বিদ্রোহের অগ্নিচিত্র,
যেখানে প্রতিটি বাক্য একেকটি বোমা—
চুপচাপ পড়ে থাকা কিন্তু ভিতরে বিস্ফোরণমুখী।
তোমার কবিতা ছিল না নিছক অলঙ্কার,
তা ছিল সংগ্রামের কাব্যিক স্লোগান—
যা ছেঁড়া জামায় জড়ানো মানুষের কণ্ঠে একদিন হয়ে উঠেছিল গর্জন।
তুমি প্রমাণ করেছো, কলম একাই যথেষ্ট,
যদি তার শিরায় থাকে আগুনের আত্মা।
(১১)
অগ্নিপুত্র
তুমি জন্ম নিয়েছো শিকলে বাঁধা পৃথিবীতে,
তবু জন্মসূত্রেই তুমি অগ্নিপুত্র।
তোমার শৈশব ছিল ক্ষুধার খাঁচা,
তবু তোমার চোখে ছিল পূর্ণিমার সাহস।
তুমি জানিয়ে দিলে, বংশ নয়—
মননই আসল পরিচয়।
তুমি ছিলে সেই লোহার মতো যোদ্ধা,
যার হৃদয় থেকে ঝরে পড়ে আগুনের ফোয়ারা।
তোমার পায়ে ছিল খড়ের বেড়া,
তবু তোমার মনের গগনে জ্বলে রেখেছিল স্বাধীনতার মশাল।
তুমি পথ চলেছো দুঃখের ধূলায়,
তবু তোমার রক্তেই ছিল মুক্তির গান।
তুমি করেছো জানলা-দরজা খুলে দেয়া,
যেখানে ঘর ছিল গণ্ডি আর হৃদয় ছিল সীমাহীন মুক্ত আকাশ।
(১২)
মৃত্যুহাসির যোদ্ধা
তুমি যখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলে,
তোমার চোখে ছিল না ভয়, ছিল এক নিষ্পাপ হেসে ওঠা—
যেমন বাঘ হাসে শিকারের সামনে দাঁড়িয়ে।
তোমার মৃত্যুভয় ছিল না, কারণ তুমি জীবিত থাকতেই মরেছিলে বহুবার—
দারিদ্র্যে, যন্ত্রণায়, অপমানের কঠিন চাবুকে।
তুমি মৃত্যুকে দেখেছো সহযাত্রী রূপে,
যার কাঁধে ভর দিয়েই তুমি গিয়েছো শব্দের সীমা ছাড়িয়ে।
তোমার অন্তিম নিশ্বাসে ছিল না বিলাপ,
ছিল যুদ্ধশেষে শান্তি, ছিল সন্তুষ্টির বিষাদের হাসি।
তুমি এমন যোদ্ধা, যার অস্ত্র শেষ হলেও চোখে থাকে আগুনের পলক,
যে জানে, মৃত্যু মানে শেষ নয়—
এক অন্য কবিতার সূচনা,
যেখানে আকাশ লেখে তোমার নাম,
আর পৃথিবীর প্রতিটি বিদ্রোহী শিশু তোমাকে বলে:
“আমার ভেতরেও নজরুল আছে।”
বিচিত্র কুমার, জেলাঃ বগুড়া, বাংলাদেশ