শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাবর্ষ: ভাবনায় কুইবেকের শিক্ষাব্যবস্থা
রিয়েল্টর শিহাব উদ্দিন: এ সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে কুইবেকের নতুন শিক্ষাবর্ষ। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে অভিভাবকদের মধ্যে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। এক দিকে আছে শিক্ষক স্বপ্লতা এবং শিক্ষা খাতে বাজেট সংকোচন নিয়ে উদ্বেগ, অন্যদিকে আছে মাধ্যমিক স্তরে মোবাইল ফোনে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞায় স্বস্তি। সব মিলিয়ে কুইবেকের শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখী।
প্রাথমিক স্তরের মত মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলিতেও এবছর থেকে মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে গঠিত বিশেষ কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায় এবং সহপাঠীদের মধ্যে সংঘাত বাড়ায়। শ্রেণিকক্ষে যখন মোবাইল ফোন থাকবেনা, তখন শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলবে, পারস্পরিক ইন্টারেকশন বৃদ্ধি পাবে। ফলে স্কুলগুলিতে সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করবে।
এদিকে নতুন এই নিষেধাজ্ঞার আরোপের ফলে শিক্ষার্থীরদের মনোভাব, আচরণ এবং ডিসিপ্লিনারি কার্যক্রমে জড়িত Technicien en éducation spécialisée(TES) রা বলেছেন মোবাইল ফোনে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাবে। আগে যেসব শিক্ষার্থীরা লাঞ্চ কিংবা খেলাধুলার সময়ে ডিভাইসে ব্যস্ত থাকতো, তাদের মধ্যে থেকে কিছু শিক্ষার্থী বিরক্ত হয়ে তাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় উৎপাত সৃষ্টিতে উদ্যত থাকবে।
ফ্রাঙ্কোফোন স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে, অথচ শিক্ষক ও সহায়ক কর্মী কমছে। ২০২৫–২০২৬ শিক্ষাবর্ষে কুইবেক সরকার প্রভিন্সের ৪৮টি CGEP এর নেটওয়ার্ক থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেট কমাচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে ছাত্রসেবা, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার মানে। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বাজেট কাটছাঁটের প্রভাব তীব্রভাবে পড়ছে। ইংলিশ মন্ট্রিয়ল স্কুল বোর্ড (EMSB) ইতিমধ্যেই এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এদিকে অনেক শিক্ষক উন্নত সুযোগ-সুবিধার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন। ফলে সরকারি ব্যবস্থায় শিক্ষক ধরে রাখা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
প্রভিন্স জুড়ে শিক্ষক সংকট এখনো বড় একটি সমস্যা। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রাক্কালে ৪% শিক্ষক পদ এখনও খালি রয়েছে। তদুপরি, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় ১০% এর শিক্ষকতার কোনো আনুষ্ঠানিক সনদ নেই।
উচ্চশিক্ষামন্ত্রী পাসকাল দেরি অবশ্য দাবি করেছেন যে, মূল বাজেটে ভারসাম্য আনার জন্য এবার শিক্ষা বাজেটে কাঁটছাঁট করা হয়েছে। তার মতে, ২০১৮ সাল থেকে CGEP এ অর্থায়ন ৫০% বাড়ানো হয়েছে, যা শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। শিক্ষক শূন্যতা প্রসঙ্গে পাসকাল বলেন এতে একটু উন্নতি হয়েছে। গত বছর খালি পদ ছিল ৬% এবং এর আগের বছর ছিল ১০%।
এদিকে কানাডা সফর করে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষনা প্রতিনিধিদলের সাম্প্রতিক রিপোর্ট কুইবেকের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রয়োগ করার লক্ষ্য নিয়ে কানাডার শিক্ষা পদ্বতি স্টাডি করার জন্য গত বছর এখানে এসেছিল এ প্রতিনিধি দল। তাদের রিপোর্ট “Lessons from Canada: An Equitable Education System Is Possible “এ বলা হয়েছে, কানাডার অন্টারিও প্রদেশ সমতা ভিত্তিক শিক্ষার একটি মডেল হলেও কুইবেকের তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা বৈষম্য তৈরি করছে। রিপোর্টে অন্টারিওর পাবলিক স্কুল এবং সরকারি অর্থায়নবিহীন প্রাইভেট স্কুলের প্রশংসা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কুইবেকের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে “বিভাজনমূলক” আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে যে, এতে অনেক তরুণ পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কুইবেকের প্রাইভেট স্কুলগুলির প্রোগ্রামকে অন্যায্য আখ্যা দেয়া হয়েছে। তবে কুইবেকের L’École ensemble নামের নাগরিক আন্দোলন তথা প্রভিন্সের রাজনৈতিক দল Quebec Solidaire এর প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হয়েছে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, পাবলিক ও প্রাইভেট স্কুলকে একীভূত করে সবার জন্য উন্মুক্ত একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং বিশেষ প্রোগ্রামগুলো সকল শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। প্রভিন্সের প্রাইভেট স্কুল ফেডারেশন FEEP অবশ্য, অস্ট্রেলিয়ার গবেষনা প্রতিনিধিদলের রিপোর্টটির সমালোচনা করেছে। FEEP সভাপতি দাবি করেছেন, কুইবেকের শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী, কারণ এখানে অভিভাবকদের সন্তানের স্কুল বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে যার ফলে কুইবেকের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক এক্সপোজারে ভাল করছে।
সমস্যা এবং নেতিবাচক দিক যাই হোক, এ মুহূর্তে প্রভিন্সের স্পট’লাইট ক্লাসরুমে সেলুলার ফোনের নিষেধাজ্ঞার দিকে। একে একটি ইতিবাচক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে অভিভাবক মহল। এর ফলে ক্লাসরুমের ভেতর ও বাইরের পরিবেশ আরও সুস্থ, প্রাণবন্ত ও শিক্ষাবান্ধব হয়ে উঠবে, এমনটাই প্রত্যাশা প্রভিন্স জুড়ে।
লিখেছেন রিয়েল্টর প্রকৌশলী শিহাব উদ্দিন, সাবেক শিক্ষক, চট্রগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট




