জানা অজানা ফিচার্ড সোশ্যাল মিডিয়া

ঢাকার মগবাজার ও মগদের বিস্ময়কর ইতিহাস 

ঢাকার মগবাজার ও মগদের বিস্ময়কর ইতিহাস 

ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত জনপদ মগবাজার। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই এলাকায় যাতায়াত করে, কিন্তু খুব কম মানুষই জানে—“মগবাজার” নামটা কিভাবে এলো, কবে থেকে এখানে বসতি শুরু হলো, আর এর ইতিহাস কতটা রোমাঞ্চকর!”
মগ কারা ছিল?
১৭শ শতকের দিকে আরাকান (বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল) থেকে একদল দস্যু ঢাকা শহরে প্রবেশ করেছিল। তাদের বলা হত “মগ দস্যু”। এরা ছিল সমুদ্রযোদ্ধা ও জলদস্যু।
তারা মূলত নদীপথে চলাফেরা করত, হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে মানুষকে বন্দী করে নিয়ে যেত।
ইতিহাসে এদেরকে “মগ” বা “আরাকানী দস্যু” বলা হয়।
মগদের ঢাকায় প্রবেশ
১৬০০ সালের পর থেকেই তারা বারবার নদীপথে ঢাকার কাছাকাছি গ্রামগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকে। বিশেষ করে তারা নারায়ণগঞ্জ, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা নদীসংলগ্ন গ্রামগুলোতে হামলা চালাতো।
মগরা মানুষ ধরে নিয়ে যেত দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য।
তারা লুণ্ঠন করত ধান, সোনা-রূপা, গৃহপালিত পশু।
মগবাজার নামকরণের ইতিহাস
বারবার আক্রমণের কারণে ঢাকার মানুষ এদের খুব ভয় পেত।
পরবর্তীতে যখন এরা ঢাকার পূর্ব অংশে বসতি গড়ে তোলে, তখন সেই জায়গাটাই পরিচিত হয় “মগ বাজার” নামে।
অর্থাৎ, মগ দস্যু-দের বসতি = মগবাজার।
আর সেই থেকেই ঢাকায় লোক মুখে ছড়িয়ে পড়ে
“মগের মুল্লুক”

মগদের আক্রমণ ও ঢাকা
ঢাকার ইতিহাসে মগ দস্যু-রা ছিল ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। তারা মূলত আরাকান (বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল) থেকে আসত। এরা পর্তুগিজ জলদ-স্যুদের সাথে যোগ দিয়ে নদীপথে বারবার ঢাকার আশেপাশের এলাকা আক্রমণ করত (১৬২০-১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে সক্রিয় ছিল)।
মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা মুঘল রাজধানী ঢাকা আক্রমণ করলে মুঘল সুবেদার ইসলাম খান (Subahdar Islam Khan Chishti, শাসনকাল ১৬০৮–১৬১৩ খ্রিঃ) তাদের মোকাবিলা করেন।
ইসলাম খান ঢাকার প্রতিরক্ষা জোরদার করেন।
বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে একাধিক দুর্গ নির্মাণ করেন (যেমন হাজীগঞ্জ দুর্গ, ইদ্রাকপুর কেল্লা, সোনাকান্দা দুর্গ)।
এই সুবেদারের সময় থেকেই মগদের শক্তি দুর্বল হতে থাকে।
এরপরের সুবেদাররা—শায়েস্তা খান (১৬৬৪–১৬৮৮ খ্রিঃ)— আরও কঠোর ব্যবস্থা নেন।
শায়েস্তা খান বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনী গড়ে তোলেন।
মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটি ধ্বংস করেন।
ফলে মগরা ধীরে ধীরে দমন হয় এবং ঢাকায় তারা আর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
ঢাকায় তারা কিভাবে বসবাস শুরু করে?
মগদের দমন করার পর ঢাকা শান্ত হতে থাকে এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস শুরু করে।
মুঘল আমল: আফগান, মুঘল সৈন্য, ব্যবসায়ী, ও কারিগররা বসতি গড়ে তোলে।
আরাকানী ও পর্তুগিজদের অবশিষ্টাংশ: অনেককে মুঘলরা পরাজিত করার পরও তারা ভাড়াটে সৈন্য বা নাবিক হিসেবে থেকে যায়, আর এদের বসতি থেকেই “মগবাজার” নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মগদের একটি অংশ আত্মসমর্পণ করে তারা ঢাকায় বসত স্থাপন করে বসবাস শুরু করে, এবং সেই জায়গাটি মগবাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে || স্থানীয় বাঙালি কৃষক ও কারিগররা তখন শহরের চারপাশে বসবাস শুরু করে।
মুঘল আমলে মগবাজার
মুঘলরা ঢাকাকে তখন সুবাহ বাংলার রাজধানী করে তুলেছিল। মগ দস্যুদের আক্রমণ ঠেকাতে মুঘল সেনারা একাধিক দুর্গ বানায় (যেমন ইদ্রাকপুর কেল্লা, হাজীগঞ্জ দুর্গ, সোনাকান্দা দুর্গ)।
তবুও মগরা একসময় ঢাকার পূর্বাঞ্চলে বসতি গড়ে ফেলে।
এই সময় থেকেই এলাকাটির নাম “মগবাজার” জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

 ব্রিটিশ আমলে মগবাজার
১৮শ শতকের শেষ থেকে ব্রিটিশরা শাসন শুরু করলে মগবাজার ধীরে ধীরে দস্যুদের আস্তানা থেকে শহরের আবাসিক এলাকায় রূপ নেয়। ইংরেজ শাসকরা মগদের সরিয়ে দিলেও, নামটা থেকে যায়। ব্রিটিশ আমলে এখানে ব্যবসায়ীদের ছোট ছোট বাজার গড়ে ওঠে।
পাকিস্তান আমলে মগবাজার
১৯৪৭ এর পর মগবাজার ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়। তখনকার দিনে মগবাজার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র। এখানে অনেক নামকরা ব্যক্তি বসবাস শুরু করেন। বিখ্যাত মগবাজার ওয়্যারলেস গেট পাকিস্তান আমলে স্থাপন করা হয়।
 বর্তমান মগবাজার
আজ মগবাজার ঢাকার সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্ত এলাকা। এখানে আছে বড় বড় ফ্লাইওভার, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই এলাকায় চলাচল করে, কিন্তু ইতিহাসের সেই ভয়ঙ্কর মগ দস্যুদের কথা হয়তো খুব কম লোকই জানে।

বন্ধুরা, আপনারা কি জানতেন মগবাজার নামটা এসেছে ভয়ঙ্কর এক দ-স্যু গোষ্ঠীর নাম থেকে?
আর কেনই বা বলা হয়ে থাকে – মগের মুল্লুক???
আপনারা কি মনে করেন, মগবাজারের নাম পরিবর্তন করে নতুন আধুনিক কোনো নাম দেওয়া উচিত, নাকি ইতিহাসের সাথে মিশে থাকা এই নামটিই রাখা উচিত?


লেখা-মোঃনাঈম ভুইয়া 
এডমিন-ঢাকার গণপরিবহন

এসএস/সিএ
সংবাদটি শেয়ার করুন