মত-মতান্তর

একটি সেতুর আত্মহনন  |||||  বিশ্বজিৎ মানিক

একটি সেতুর আত্মহনন  |||||  বিশ্বজিৎ মানিক


সুনামগঞ্জের ডাবর পয়েন্ট থেকে পাগলা-জগন্নাথপুর-আউশকান্দি সড়কে তের কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মান ৫০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটারের বেশি প্রস্ত বিশিষ্ট কোন্দানালা সেতুটি গত রোববার রাতে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রবীণ সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় জনাব সৈয়দ আমিন তাঁর ফেসবুক স্টেটাসে উল্লেখ করেন। এই অপমৃত্যুর খবর প্রায় সমস্ত জাতীয় পত্রিকা সহ সব-কটি স্থানীয় পত্রিকার প্রথম পাতায় সচিত্র শীর্ষ খবরের স্থান করে নিয়েছে। 

কেন এই আত্মহত্যা কিংবা অপমৃত্যু ? তবে কি সেতুটি তার জীবন নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছিলো? যার ফলশ্রুতিতে আত্মহননের পথ বেঁচে নেয়া! সেতুটি ভেবেছিলো হয়তো মৃত্যুতেই মুক্তি। সে ভেবেছিলো হয়তো গাড়ি ভর্তি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা মহাপাপ! আমি নিজে একাই মরি! অকাল মৃত্যুর পর সবাই আফসোস করে আমার ক্ষেত্রেও তাই করবে!
একশত দশ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও যে ছয়টি সেতু একই সড়কে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারুকাজে নির্মিত হচ্ছে তারা যমজ সহোদর বিধায় হয়তো কিছুদিন আমার জন্য কান্নাকাটি করবে তারপর ভুলে যাবে! আনন্দ আহ্লাদ আত্মীয়তা  জীবদ্দশায় যতটুকু থাকে মৃত্যুর পর তা অনেকটাই বিসৃত হয়ে যায়। হোক না আমার ক্ষেত্রেও তাই! এই ক্ষীণ দেহ ক্ষয়িষ্ণু হাড় অবসাচ্ছন্ন ধমনী আর দুর্বল হৃৎপিণ্ড নিয়ে যখন আমি মানুষ পশু এবং যানবাহনের ভার বহন করতে পারবোনা তখন এ মুখ দেখিয়ে কি লাভ? এর থেকে আত্মঘাতী হয়ে জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়াই তো শ্রেয়! প্রতিটি আত্মহত্যার পিছনে কোন না কোন কারণ বর্তমান থাকে। এমনতো হতে পারে যে আমি অভিশপ্ত!
সুনামগঞ্জ জেলা বাসী আমরা সাত ভাইয়ের একত্রে জন্ম সংবাদে আহ্লাদিত হয়েছিল। ভেবেছিলো প্রায় ষাট কিলোমিটার রাস্তা ফাঁকি দিয়ে আমাদের ব্যবহার করে রাজধানী পৌঁছে যাবে। তাতে কোন আপত্তি ছিলোনা কিন্তু জন্মকাল থেকেই পুষ্টিহীনতা আমার শারীরিক এবং মানসিক দৌর্বল্য দিন দিন বৃদ্ধি করতে থাকে। কোনদিন শক্তিবর্ধক খাদ্য গ্রহণের সৌভাগ্য হয়নি আমার। প্রতিদিন অযত্ন অবহেলা অনাদর অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে থাকি। নিয়মিত তৈল সাবান ব্যবহারের সৌভাগ্যও আমার হতো না। এ জীবন আমার রেখে কি লাভ? হতশ্রী মুখ আমি কাউকে আর দেখাতে চাই না।
আমার প্রতি এহেন অবহেলা সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন কেহই প্রতিকারের ব্যবস্থা নেননি। দেখেও না দেখার ভান করেছেন। তাই এ মুখ আমি আর কাউকে দেখাতে চাই না। গাড়ি ভর্তি মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে পারবোনা। এ পাপের বোঝা আমি বইতে পারবো না। তাই তিলে তিলে না মরে এক্ষনি নিজের জীবন শেষ করে দেবো। আজ রোববার আমার জীবনের শেষ দিন। আমি চললাম। হায় জীবন এখানেই তোমার ইতি। কতো চেষ্টা করলাম ফাঁসিতে ঝুলবো – রশি জোগাড় করতে পারলাম না , ভাবলাম এনড্রিন খাবো – দুর্বল শরীর নিয়ে বাজারে যেতে পারলাম না। অবশেষে উপর থেকে পড়ে জীবনের ইতি টানলাম। আমার দুর্বল হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেল। আমি অক্কা পেলাম। শান্তি। আমাকে ক্ষমা করে দিও।  জানিনা আমার অপর ছয়টি ভাইয়ের কি অবস্থা হবে!
হে সেতু, হে কোন্দানালা সেতু, হে পাগলা – আউশকান্দি সড়কের সংযোগ সেতু, হে আকাংকিত সুনামগঞ্জ – হবিগঞ্জ মহা যোগাযোগের প্রত্যাশিত সেতু – তোমার অকাল মৃত্যুতে আমরা সুনামগঞ্জবাসী মর্মাহত ব্যথিত এবং লজ্জিত। তোমার অপর ছয়টি ভাইয়ের জীবন নিয়ে আমরা শঙ্কিত।  তুমি কার প্ররোচনায় আত্মহননের পথ বেঁচে নিলে আমরা তা খুঁজে বের করবোই। প্রয়োজনে তোমার ফরেনসিক টেস্ট করাবো, লাশ তুলে পোস্ট মর্টেম করাবো, তোমার মৃত্যুর পিছনে কারো কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা ও খুঁজব। তোমার জন্য খুব করুণা হয় তুমি এভাবে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে না নিলেও পারতে। আর কবে কখন কিভাবে আমরা তোমার উত্তরসূরী খুঁজে পাবো জানিনা। জানো তুমি তোমার জীবন নিজ হাতে শেষ করে দিয়ে পাপ করেছ। তবুও তোমার জন্য প্রার্থনা করি পরপারে শান্তিতে থেকো। তোমার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তারা যেন দোষী সাব্যস্থ হয়।

০২/০৩/২০২১ খ্রিস্টাব্দ।

একটি সেতুর আত্মহনন  |||||  বিশ্বজিৎ মানিক লেখক ছড়াকার। মৌলভীবাজার।

সংবাদটি শেয়ার করুন