ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইনে স্বস্তি
একের পর এক ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসছে সারা দেশ। সবারই দাবি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে হবে। এ দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল। মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ, মিছিল, মিটিং ও বিবৃতিতে সবারই একই দাবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আগামী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে আইনজ্ঞ, সুধীসমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের অনেকেই বলছে, শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমবে, দেশবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে।
তবে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বলছেন, শুধু মৃত্যুদণ্ডের আইন করলেই হবে না, এই আইনের সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে। ‘ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরোধী বাংলাদেশ’ ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনরত নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু মৃত্যুদণ্ড নয়, সামাজিক প্রতিরোধ ও জাগরণ প্রয়োজন। সমাবেশ থেকে ধর্ষণ ও নিপীড়ন বন্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতসহ ৯ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি জনগোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইন পরিবর্তনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। আগামী সোমবার ক্যাবিনেটে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন রাষ্ট্রের নবনিযুক্ত প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে ও একজন আইনজীবী হিসেবে বলব, বর্বরতম এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হলে তা সময়োপযোগী হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘একজন মানুষকে হত্যা করা আর ধর্ষণ করা সমান অপরাধ। কারণ যিনি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন তাঁকে তো সামাজিকভাবে হত্যাই করা হচ্ছে। তাই সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা অবশ্যই প্রশংসনীয়।’
ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধর্ষণের কঠোরতম শাস্তির প্রয়োজন। কিন্তু আইন করলেই যে কমে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। আইনের প্রয়োগটাও জরুরি। সাধারণত দেখা যায়, প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ের কারণে, প্রভাবশালীদের রক্ষার জন্য আইনের প্রয়োগই হয় না। আমরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার একটা সংস্কৃতি এবং একই সঙ্গে দোষারোপের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছি। রাজনৈতিকভাবে দোষারোপ হচ্ছে, অথচ সব সরকারের আমলেই এই সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে মূল্যবোধে চরম অবক্ষয়। আমরা রাজনীতির দোষারোপ করছি, অথচ সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার প্রধান আসামি তো পালাচ্ছিল পরিবারের সহায়তায়। এ ব্যাপারেও আমাদের সচেতন হতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সাবেক বিচারপতি মুনসুরুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, সরকার ধর্ষণের বিচারের আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার উদ্যোগ নিয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন সংশোধন করা হবে, এটা স্বাভাবিক। তবে দেখতে হবে, সেই আইন যেন সংবিধান পরিপন্থী না হয়।’
তিনি বলেন, মানুষ হত্যায় শাস্তির বিধান আছে দণ্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারায়। এই ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ধর্ষণের শাস্তি এমনটাই হওয়া উচিত। তবে মনে রাখতে হবে, শুধুই মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে অপরাধ কমানো যাবে না। অপরাধ কমাতে হলে মাদক ও ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্মের মনে নৈতিক বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। সে জন্য অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরেক ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধর্ষণের অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত। সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ রকম কঠোর আইন করতে হবে এবং ওই আইন কার্যকর করতে হবে। জনগণের মধ্যে একটি বার্তা দিতে হবে যে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করে ছাড় পাওয়া যাবে না। এ অপরাধ করলে মৃত্যুদণ্ড হবে। তাহলে অপরাধ কিছুটা হলেও কমবে বলে মনে করি।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মৃত্যুদণ্ডের বিধান সঠিক প্রয়োগ যদি না হয়, তাহলে কোনো লাভ হবে না। সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর পর্যবেক্ষণ থাকতে হবে।’
নারী আন্দোলনের নেত্রী খুশী কবির বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড হলেই অপরাধ কমে যাবে, এমনটা না। যেটা দেখার বিষয়, তা হলো বিচারপ্রক্রিয়া। যেখানে দ্রুত হওয়ার কথা সেখানে দীর্ঘ হয়। তদন্ত কিভাবে হয় জানা যায় না। একটি প্রতিবেদনে দেখলাম মাত্র ৪ শতাংশ বিচার হয়েছে ধর্ষণের। আমরা যদি পুরো ব্যবস্থাকে বদলাতে না পারি, জবাবদিহির সংস্কৃতি না নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে না। নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইন যেটা হয়েছে, সেটার সমস্যাটা কোথায়—এ বিষয়ে সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।’
আন্দোলনকারীরা যা বলছে : ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার, এর পরও কেন আন্দোলন—এ প্রশ্নের জবাবে শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, ‘কেবল আইনের মাধ্যমে কিংবা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ধর্ষণ দমানো সম্ভব হবে না। এর সঙ্গে অনেক ব্যাপার জড়িত রয়েছে। সে কারণেই আমরা ৯ দফা দাবি উত্থাপন করেছি। ধর্ষণ দমানোর জন্য সামাজিক প্রতিরোধ ও জাগরণ প্রয়োজন। নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমেই কেবল ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব।’
মহাসমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় না এনে ফাঁসির দাবি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে আরো নৃশংস হতে আমরা উৎসাহিত করছি। ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি খুবই জরুরি, কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এ নিয়ে ভণ্ডামি হলে ফাঁসি কিংবা ক্রসফায়ার, সেটা আমার কিংবা আপনার ওপর প্রয়োগ হবে। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাদের বিপদে ফেলা হবে। এই অবস্থায় শুধু সরকার নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।’
কোন দেশে কী শাস্তি :
বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও প্রতিবেশী ভারত, ইরান, চীন, গ্রিস, রাশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আফগানিস্তানসহ এশিয়া-ইউরোপের বহু দেশেই ধর্ষণের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করে, গুলি করে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান প্রচলিত আছে।
ভারতে ২০১৩ সালে ধর্ষণের শাস্তি আগের চেয়ে কঠোর করা হয়েছে। দেশটিতে বিশেষ ক্ষেত্রে ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। তবে সচরাচর সাত বছর থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। চীনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় ধর্ষকের যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়া হয়। ইরানে সাধারণত ধর্ষককে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। গ্রিসে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় আগুনে পুড়িয়ে। মিসরে জনাকীর্ণ এলাকায় জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষককে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে মাথায় গুলি করে শাস্তি কার্যকর করা হয়। আফগানিস্তানে আদালতের রায়ের চার দিনের মধ্যে ধর্ষকের মাথায় গুলি করে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়। সৌদি আরবে জনসমক্ষে ধর্ষকের শিরশ্ছেদ করা হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
-সূত্রঃ কালের কন্ঠ
সিএ/এসএস
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন