বিষাদে আচ্ছন্ন বিশ্ব
শাহজাহান কবির || খবরটা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই যে যার কাজ ফেলে ছুটেছেন। কেউ গেছেন বুয়েনস এইরেসের বিখ্যাত মনুমেন্টটার নিচে, কেউ সরাসরি বোকা জুনিয়র্সের বোম্বানেরা স্টেডিয়ামে, কেউ গেছেন আর্জেন্টিনোস জুনিয়রসের মাঠে—ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রথম ক্লাব সেটি। এই শতাব্দীতে তাদের স্টেডিয়ামটির নামকরণও হয়েছে ম্যারাডোনার নামে।
ভক্তরা কাঁদছেন, শোকে পাথর—আসলে তাও নয়। গোটা আর্জেন্টিনা মাতম করছে বুধবার থেকে। ‘ডিয়েগো’ ‘ডিয়েগো’ বলে চিৎকার করছেন কেউ, একদল বেদম ড্রাম পেটাচ্ছেন, উন্মাদের মতো পতাকা উড়াচ্ছেন কেউ, ১০ নম্বর জার্সি গায়ে কেউ স্রেফ স্তব্ধ। মা-বাবার কবরের পাশে সমাহিত করার আগে কাল সবার শেষবিদায় জানানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনে নেওয়া হয়েছিল তাঁর কফিন। তিনি শুয়ে, জড়িয়ে আর্জেন্টিনার পতাকা আর ১০ নম্বর জার্সি। বাইরে তখন দীর্ঘ লাইন। লাইন শুধু নয়, মাঝে মাঝে তা রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পুলিশের সঙ্গে ভক্তদের সংঘর্ষে, ডিয়েগোকে শেষ দেখা দেখতে তর সইছিল না যে কারো। এদিন থেকেই তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক শুরু হয়েছে আর্জেন্টিনায়। ইতালির নেপলসেও পরিবেশটা কমবেশি এক। ‘এল ডিয়েগো’-র না থাকার খবর রটতে নেপলসবাসীও আর ঘরে থাকতে পারেননি। নাপোলি স্টেডিয়াম চত্বরেই জড়ো হয়েছেন তাঁরা। নাপোলির মালিক অরেলিও ডি লরেন্তিস এদিনই খোলা চিঠি লিখেছেন সমর্থকদের উদ্দেশে, নাপোলি স্টেডিয়ামকে ম্যারাডোনার নামে নামকরণ করতে। নেপলসের মেয়রও সায় দিয়েছেন তাতে। একার দ্যুতিতে বিশ্বকাপ জিতে সারা বিশ্বকে যেমন মোহাবিষ্ট করেছেন ম্যারাডোনা, নেপলসকে তেমনি পীঠস্থান করেছেন ইতালির ফুটবল রাজত্ব এনে দিয়ে। ’৯০-এর বিশ্বকাপেও নেপলসবাসী সেই আবেশ থেকে বেরোতে পারেনি। আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য অসি আরদিলেস বলছিলেন, ‘ম্যারাডোনাকে নিয়ে গোটা বিশ্বে যে উন্মাদনা, এমনটা সত্যি বলতে আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।’
ম্যারাডোনা স্বপ্নই তো। সেই কবে, পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোন পাড়াগাঁয়ের টিভির সামনে বসে মানুষ এক জাদুকরের বাঁ পায়ের ফুটবলে আবিষ্ট হয়েছিল—সুদূর আর্জেন্টিনার ডিয়েগোর সঙ্গে সেই সম্পর্কটাকে অপার্থিব ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। তাঁকে কখনো সরাসরি দেখা হয়নি, ছোঁয়া হয়নি, অথচ তাঁর আবেগে ভেসেছে পৃথিবীর এপার-ওপার। বুয়েনস এইরেসে জড়ো হওয়া এক ভক্ত এপির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে খ্যাপাটের মতোই বলছিলেন, ‘ম্যারাডোনা মরেনি, ম্যারাডোনা মরেনি, ম্যারাডোনা আমাদের সবার মাঝে বেঁচে আছেন।’ কারো মৃত্যুতে অহরহই এমনটা শোনা যায়। কিন্তু ম্যারাডোনার ক্ষেত্রে এ শুধু কথার কথা না, এটাই আসল সত্য। ’৮৬-র ওই কীর্তির পরই তো তিনি অমর। ম্যারাডোনা অমৃতে এরপর যা যোগ হয়েছে তা স্বাদই বাড়িয়েছে কেবল। কোকেন আসক্তি, কর ফাঁকি, উচ্ছৃঙ্খলতা কোনো কিছুই তাই সেই অক্ষয় ছবি মাড়াতে পারেনি। মানুষ ম্যারাডোনাকে তা ভুগিয়েছে নিশ্চিত। মৃত্যুর সপ্তাহ কয়েক আগে আর্জেন্টিনার পত্রিকা ‘ক্লারিন’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাই স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ‘মাদকাসক্তি না থাকলে হয়তো ফুটবলেই আরো কিছু দিতে পারতাম।’ এর পরও জীবন নিয়ে শেষ পর্যন্ত তৃপ্তির কথা বলেছিলেন, ৯ বছর আগে স্বর্গে বসতি গড়া মা তাঁর ডিয়েগোর দিকে তাকিয়ে খুশিই—এই বিশ্বাস মনে ছিল তাঁর। বলেছিলেন মানুষের ভালোবাসা যতটা পেয়েছেন, তাতে কখনো কখনো নিজেই চমকে গেছেন। ডিয়েগো শেষ পর্যন্ত ফুটবলপ্রেমী নয় শুধু, মানুষের নায়ক হয়ে ছিলেন। আর্জেন্টিনাকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন—এমন প্রশ্নে তাই আরেকটা বিশ্বকাপ নয়, অনাহারি শিশুদের কথা বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে কষ্ট লাগে অভুক্ত শিশুদের যখন দেখি। ক্ষুধার কষ্ট কী আমি জানি। জানি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলে কেমন লাগে। আমার আর্জেন্টিনায় এমনটা থাকুক আমি চাই না। আমি চাই আর্জেন্টিনার মানুষ সুখে থাকুক, খেয়ে, কাজে বেঁচে থাকুক।’
উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ ম্যারাডোনার এ আরেক সত্তা। এই ম্যারাডোনাকে ভালো না বেসে তাই পারা যায় না। পৃথিবীর প্রতিটি কোণেই তাই এখন মাতম। তাঁর মৃত্যু দিনের পর দিন বয়ে বেড়ানো ভালোবাসার সেই বাঁধটাই ভেঙে দিয়েছে। তিনি শেষ পর্যন্ত তাই কোনো দলের, দেশেরও নয়। বোকায় খেলতেন, রিভার প্লেটের সঙ্গে যাদের আগুনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু কাল ম্যারাডোনার কফিনের পাশে রিভার প্লেট, রেসিং, হুরাকান, ইন্দিপেন্দিয়েন্তে, সার্সফিল্ড—সব ক্লাবের সমর্থকদের উপহার দেওয়া জার্সির স্তূপ হয়ে ছিল। পৃথিবীর যে প্রান্তেই এদিন খেলা হয়েছে তাঁর স্মরণে কিছু সময়ের জন্য থমকে গেছেন সবাই। বোকা জুনিয়র্সের কোপা লিবার্তাদোরেসের ম্যাচ ছিল, স্থগিত করা হয়েছে তা। শোকের মাঝে তা কী করে হয়! তবে এই শোকও নিশ্চিত সাময়িক। অক্ষয় নিশ্চিত ম্যারাডোনা-প্রেম। -সূত্রঃ কালেরকন্ঠ
-এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন