লেখালেখি

সৈয়দ আশরাফের চলে যাওয়ার এক বছর

সৈয়দ আশরাফের চলে যাওয়ার এক বছর

বাংলাদেশের শুদ্ধ রাজনীতির আইকন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই জানুয়ারি মাসেই তিনি জন্মেছিলেন, আবার এই জানুয়ারিতেই তিনি চলে গিয়েছিলেন চিরদিনের মতো। ময়মনসিংহ শহরে ১৯৫২ সালের পহেলা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। গত বছরের আজকের দিনে (৩রা জানুয়ারি) রাজধানীর ২১ বেইলি রোডের সরকারি বাসা খালি করে তিনি চলে যান চিরদিনের জন্য। এই সময়েই তিনি আস্তানা গাড়লেন বাংলার কোটি মানুষে বক্ষস্থলে; মানুষের বুকের যে অঞ্চলে অমর মানুষের বসবাস। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ছিলেন রাজনীতির এক অনন্য কবি। তাঁর কবিতার কারুকার্যে আজো মোহিত বাংলাদেশ।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।

প্রেসিডেন্টের ছেলে হয়েও রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধকালীন প্রেসিডেন্টের ছেলে হয়েও শুকনো রুটি খেয়েছেন, স্টেনগান হাতে মাটিতে বুকে ভর দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। ভারতীয় জেনারেল উবান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তার বইয়ে যে সাদামাটা, শান্ত আর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ যোদ্ধা আশরাফের কথা বলেছিলেন, তিনিই বাংলাদেশের সৈয়দ আশরাফ।

থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ছয় মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত বছরের ৩রা জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে সৈয়দ আশরাফ পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এর আগে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ২০১৮ সালের ৩রা জুলাই তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। কিশোরগঞ্জ সদর আসনের টানা পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের দুই বারের সাবেক সফল সাধারণ সম্পাদক, সাবেক এলজিআরডি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নেই আজ এক বছর। এই এক বছরে রাজনৈতিকভাবে যেমনি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছে কিশোরগঞ্জ, তেমনি বাংলাদেশ অনুভব করছে বিরল এই রাজনীতিকের শূন্যতাকে।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে আজো কাঁদে কিশোরগঞ্জ, কাঁদে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগের চরম বিরুদ্ধবাদীরাও বলছেন, এ এক অপূরণীয় মৃত্যু। দলের ভেতরে-বাইরে জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় এমন রাজনীতিবিদ কোন দলেই সামপ্রতিককালে দেখা যায়নি। সৈয়দ আশরাফের এই কারিশমার রহস্য আজো অজানাই রয়ে গেছে, যা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শারীরিক মৃত্যু সেখানে একেবারেই তুচ্ছ।

আরও পড়ুনঃ স্ত্রী সন্তান ও মাকে নিউইয়র্কে রাখার সিদ্ধান্ত ব্যারিস্টার সুমনের!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারে বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা পূরণ করেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এক-এগারোতে সেনা সমর্থিত সরকার আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করলে সৈয়দ আশরাফ উনার শূন্যতা পূরণ করেছিলেন। রাজনীতিতে দুই প্রজন্মে এমন অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়ার মতো সৌভাগ্য কেবল আওয়ামী লীগেরই হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম একজন নির্লোভ, দেশপ্রেমিক ও আত্মত্যাগী নেতা হিসেবে আমৃত্যু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত স্বজন ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন খুনি মোশতাক চক্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করায় তাঁকে কারাজীবন বেছে নিতে হয়। আরো তিন জন সতীর্থের সঙ্গে জেলহত্যাকাণ্ডে নৃশংসতার শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়।
যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান হিসেবে যুক্তরাজ্যের মূলধারার রাজনীতিতে জায়গা করে নেওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ডাকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলেন। দেশে ফেরার পর অংশ নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ১৯৯১ সালে বিএনপির কাছে হারানো কিশোরগঞ্জ সদর (তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-৩) আসনটি ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় প্রত্যাবর্তন হয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের। এই প্রত্যাবর্তনের পর একজন ভদ্র, বিনয়ী ও অজাতশত্রু রাজনীতিবিদ হিসেবে দলের সবার শ্রদ্ধা ও স্নেহ কুড়াতে বেশি সময় নেননি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চরম ভরাডুবি ঘটলেও সৈয়দ আশরাফ বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৭তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এক-এগারোতে সেনা সমর্থিত সরকার রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার নীল-নকশা নিয়ে যখন এগোচ্ছিল, বয়সের ভারে ন্যূব্জ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান একা সব কিছু সামাল দিয়ে পেরে উঠছিলেন না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল কারাগারে থাকায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন ‘মিস্টার ক্রাইসিস ম্যান’ খ্যাত সৈয়দ আশরাফ। সেই ক্রান্তিলগ্নে দৃঢ়চিত্ত আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনাকে মুক্ত ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দল ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৪শে জুলাই অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৮তম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৯তম জাতীয় কাউন্সিলে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে তিনি জায়গা পান প্রেসিডিয়ামে। তখন আরেক দফা তাঁর প্রতি নেতাকর্মীদের আবেগ অনুভূতি ও সমর্থন দৃশ্যমান হয়। তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। দলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তিনি কখনও কোন গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেননি। রোজ প্রেসবিফ্রিং করেননি। কিন্তু যখন যেটি প্রয়োজন সেটি সময়মতো ইতিবাচকভাবে বলতে ভুল করেননি। অতিকথন, ক্ষমতার দম্ভ যেমন তাকে স্পর্শ করেনি তেমনি গণমাধ্যমের সমালোচনায় ব্যক্তিগত আক্রোশ পোষেননি। একজন উদার পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদের মতোই তিনি নীরবে নিভৃতে পথ হেঁটেছেন। আমৃত্যু সেই পথ থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি। তদবিরবাজ, মতলববাজ, সুবিধাবাদীরা যেমন তাঁর কাছে ভিড়তে পারেননি তেমনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারে ন্যূনতম কলঙ্কের ছিটেফোটাও তাঁর গায়ে লাগেনি।

টানা পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সংসদে একবারই মাত্র বিরোধী দলের আসনে বসতে হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নেয়ার আগেই পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। বাকি তিনবারই তিনি বসেছেন সংসদের ট্রেজারি বেঞ্চে। এই তিন সরকারে মন্ত্রীত্ব ছাড়াও টানা দুই বার তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দফায় দফায় মন্ত্রী এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গড়ে তুলেননি সম্পদের পাহাড়। বরং তাঁর সম্পদ দিন দিনই কমেছে। পৈত্রিক বাড়ি ছাড়া তাঁর ব্যক্তিগত কোন বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট কিছুই ছিল না। এমনকি সরকারি সুবিধা পরিহার করে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি বিক্রি করেছিলেন উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া গুলশানের বাড়িটি। গুলশানে জাতীয় চার নেতার নামে বরাদ্দ করা প্লট থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে হিসেবে তিনি ২ শতাংশ জমি পেয়েছিলেন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি সেই জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদকের কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল ইউনিয়নের যশোদল বীরদামপাড়া গ্রামে ১৫ শতাংশ জমির উপরে একটি পৈত্রিক বাড়ি এবং ময়মনসিংহের কলেজ রোডে ৮ শতাংশ জমির উপরে একতলা একটি বাড়ি রয়েছে, যা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত সৈয়দ আশরাফ চিকিৎসার জন্য স্ত্রীকে লন্ডন থেকে জার্মানি নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় দু’বার প্লেনের টিকিটের তারিখও পরিবর্তন করেছিলেন।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী সৈয়দা শিলা ইসলাম ২০১৭ সালের ২৩শে অক্টোবর লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর থেকেই অন্তরালে চলে যান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২০১৮ সালের ৩রা জুলাই তাঁকে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২০তম জাতীয় সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সন্তান। আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যখন ব্যথা পায়, আমার হৃদয়েও ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের একটা কর্মী যদি ব্যথা পায়, সেই ব্যথা আমিও পাই।’

তাঁর এমন কালজয়ী বক্তব্য আজো মানুষকে সমানভাবে আলোড়িত করে। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অনুভূতি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা তাঁকে চেনেন একজন নির্লোভ, নীতিবান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আর্দশে গড়া একজন স্বল্পভাষী তবে লক্ষ্যে অটুট নেতা হিসেবে।

কিশোরগঞ্জে নানা আনুষ্ঠানিকতায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হবে। বাদ জুমা জেলার মসজিদে মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে 

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen − fourteen =