ফিচার্ড লেখালেখি

মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী! আপনাকেই বলছি!!

মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী! আপনাকেই বলছি!!  

মোঃ মাহমুদ হাসান  । ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসবের কাল। সাগরসম ত্যাগ আর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্যবোধ আর চেতনাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন দেশ বিরোধীরা, জাতীয় পতাকা নিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেরিয়েছেন সেই সব ঘৃণিত পৈশাচিকের দল যারা রাজাকার, আলবদর আর আল শামস্ প্রতিষ্ঠিত করে ১৯৭১ এ স্বাধীনতাকামী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে, আর মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক লাখো লাখো পরিবারের মা-বোনদের কে পাক হানাদারদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে তুলে দিয়েছিল। নিকটজন হারানো দুঃসহ বেদনায় ভারাক্রান্ত পরিবারের সদস্যরা একুশ টি বছর নিকৃষ্টদের এই আস্ফালন প্রত্যক্ষ করেছে, স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার সুফল হারিয়ে দিনরাত হাহাকার করেছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে আশায় বুক বেঁধে স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকে নির্যাতিত, নিপীড়িত স্বজন হারানো লাখো লাখো পরিবার। ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিষ্ঠা, তাদের এই প্রত্যাশা কে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার শাসনামলে আপনার মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্তি এ যেন প্রত্যাশার মাঝে আলোর ঝলকানি। জননেত্রীর নেতৃত্বে আপনার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও ১৯৭১ এ স্বজন হারানো বহু মানুষ এখনো আকাশ পানে চেয়ে হ্রদয়ের দহনে কাতর হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শত বার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ও তাদের হাহাকার দেখার আজও যেন কেউ নেই। এমন কিছু মানুষদের গল্প নিয়েই আপনার সমীপে আজ আমার বিনীত আর্জি মাননীয় মন্ত্রী!!   

প্রায় দু’ লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা তাদের বীরত্বের জন্য আজ সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সরকারি সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে দেশ সেবায় অবদান রাখছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ কে এগিয়ে নিতে এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি কি জানেন পাক হানাদারদের হাতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যাওয়া অনেক বীর বাঙালির সন্তানরা আজও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি? বেয়োনেটের খোঁচায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে প্রাণ হারানো মুক্তি পাগল এই বীর সন্তানদের উত্তরসূরী অনেক অসহায় সন্তান যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার শাসনামলেও শুধুমাত্র শহীদ পরিবারের স্বীকৃতির দাবিতে আহাজারি করে বেড়ায়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এমন ঘটনা কি আপনি ও বঙ্গবন্ধু কন্যার জন্য স্বস্তিদায়ক মাননীয় মন্ত্রী?

মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বীরত্ব গাঁথায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া নামক স্থানটি ইতিহাসের ই অংশ। ১৯৭১ এর ৪ঠা এপ্রিল কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা, বেসামরিক ও বেসামরিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এখানে মুক্তিযুদ্ধের রনকৌশল নির্ধারণের প্রথম সামরিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, পুরোদেশটিকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সামরিক বেসামরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে জনযুদ্ধ কে সফল পরিসমাপ্তির পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল। আর এ বৈঠকটি কে সফল করতে স্থানীয় রাজনীতিকদের পাশাপাশি এলাকার মুক্তি পাগল জনগোষ্ঠী সেই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল, যার কারণে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল এলাকার মানুষ কে।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের তেলিয়াপাড়া সংশ্লিষ্ট গ্রামটির নাম গোয়াছনগর। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তি সংগ্রামের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। যার জন্য রাজাকার আলবদর আর পাক-হানাদারদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় গ্রামটি। ১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষার্ধের কোন একদিনে আসরের নামাজ শেষে মসজিদের ভিতরে বসে এ গ্রামের একদল মুক্তিকামী মানুষ ভারত যাত্রাসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে শলা পরামর্শ করছিল। গোপনসূত্রে খবর পেয়ে ঢাকা- সিলেট মহাসড়ক নিকটবর্তী এই মসজিদ টি তাৎক্ষনিক ঘিরে ফেলে পাক হানাদার নরপিশাচের দল। মুহুর্মুহ গুলি আর ষ্টেনগানের ফায়ারে আতঙ্ক সৃষ্টি করে মসজিদ থেকে আটারো জন মুক্তিকামী মানুষ কে ধরে নিয়ে একটি ছনের ছাউনি দেয়া ঘরে সবাই কে তালাবদ্ধ করে পেট্রোলের আগুন দিয়ে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করে। কয়েকজন জানালা ভেঙে পালানোর চেষ্টা করলে সেদিন তাদের কে পাখির মতো গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্মীভূত হয়েছিল পুরো গ্রাম। দিন মজুর গরীব কৃষকের এই গ্রামটিতে স্বজন আর সহায় সম্পদ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল মহিলা, বয়োবৃদ্ধ আর শিশু সন্তানেরা। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি জেনে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হবেন স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ডক্টর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীনের প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর দেয়া প্রতি শহীদ পরিবারকে এক হাজার টাকা অনুদান দেয়া ছাড়া আজ অবধি তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি!!

প্রিয় দেশ টি আজ দক্ষিণ এশিয়ায় ইমারজিং টাইগার। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সক্ষমতায় ও বিস্ময়কর অর্জন দুনিয়াব্যাপি প্রশংসিত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সদা তৎপর, সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী হিসেবে আপনার সমীপে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের গোয়াছনগর গ্রামের আয়ুব আলী, আশ্রব আলী, গফুর আলী, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী, আবদুল আলী সহ ১৮ জন শহীদ বীর বাঙালির উত্তরসুরীদের জন্য শহীদ পরিবারের স্বীকৃতির দাবি করা কি খুবই অপ্রত্যাশিত অন্যায় হবে?

গেল সপ্তাহে শনিবার ১৫ ই মে, ২০২১ তারিখে কানাডার একটি বাংলা টেলিভিশনে গোয়াছনগর ট্রাজেডিতে নিহত ১৮ জন বীর বাঙালি স্মরণে তিন ঘন্টার একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। স্থানীয় শাহজাহানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল হোসেন খান ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে হৃদয় বিদারক মর্মস্পর্শী এ অনুষ্ঠানে শহীদ গফুর আলীর সন্তানের বিনীত আর্জি ছিল, ” অর্থনৈতিক সহযোগিতা না হলেও, জাতীয় দিবস সমুহে সরকার অথবা স্থানীয় প্রশাসন কতৃক একটি সহানুভূতি পত্র পেলেও তো দেশের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া বাবাদের হারিয়ে এতিম সন্তান হিসেবে আমরা সান্তনার বাণী খুঁজে পাই”।

মাননীয় মন্ত্রী, একাত্তরের সকল বীর সন্তানদের স্বীকৃতি না দিতে পারা হবে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় দীনতা। আপনাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অনুপস্থিতিতে এই দৈন্যতা একদিন জাতীয় দৈন্যতায় রুপ নিতে পারে। তাই মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে অর্থনৈতিক সহযোগীতার মাধ্যমে যে পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর ই কন্যার শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে আপনি কি সেই পিতৃহারা সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়ে, পরিবারগুলোকে শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দিয়ে অগ্নিদগ্ধ, গুলিবিদ্ধ শহীদদের আত্মার প্রশান্তি হয়ে উঠতে পারেন?

মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী! আপনাকেই বলছি!!  লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষকই-মেইলঃ [email protected]


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 4 =