নজরুলে ধন্য ধর্ম, ধন্য অসাম্প্রদায়িকতা | ড. শোয়েব সাঈদ
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ”- এই গানটি ছাড়া কি বাঙালির ঈদ হয়?
রোজার ঈদে চাঁদ রাতের শুরুতেই এই গানটি আবেগাপ্লুত কিন্তু উৎসবমুখর ঈদের এক আবহ তৈরি করে দেয়। আজকাল ইউটিউব যুগে ঈদের চাঁদ রাতে পাইওনিয়ার শিল্পীগণ থেকে বর্তমান শিল্পীদের একক কিংবা দলীয় কণ্ঠে এই গানটি শুনার নেশা যেন পেয়ে বসে।
নব্বই বছর আগে ১৯৩১ সালে গানটি লেখার ৪ দিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় প্রথম রেকর্ড করা হয় কোলকাতায় গ্রামোফোনের ভগবতী বাবুর বদান্যে, তারপর ঈদের আগে আগে গানটির অবমুক্তি। অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল বাঙালি মুসলমানদের মননে।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে এই গানটি স্মরণ করা কারণটি হচ্ছে এবারের রোজার ঈদ আর কবির জন্মদিনটি খুব কাছাকাছি সময়ে, ফলে রোজার ঈদের রেশ কাটতে না কাটতেই ক্যালেন্ডার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় কবিকে। অবশ্য ঈদ আর জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকীর পাশাপাশি অবস্থানটি চলবে আগামী কয়েক বছর ধরে।
ঈদ উৎসবের সূরের মূর্ছনায় শুধুমাত্র কবি নজরুলকে খুঁজে পাবার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে স্বীয় ধর্মের মেলোডিটুকুর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েও অসাম্প্রদায়িক আর মানবিক চেতনার “শিখা অনির্বাণ” মনুষ্যত্বের কবি নজরুলকে হৃদয়ে আর কর্মে ধারণ করা হবে ধর্মীয় উগ্রতাশ্রয়ী সমসাময়িক সমাজের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জন।
কবিগুরু রবি ঠাকুর আর কাজী নজরুল; বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপাল বাঙালি, বাংলা ভাষার মর্যাদায় কাজ করেছেন কখনো একই লয়ে, কখনো দুটো ভিন্ন ফ্রন্টলাইনে। বাঙালি সমাজে, বাংলা সাহিত্যে নজরুলের ঘরোয়া জাগরণের পাশাপাশি রবি ঠাকুরের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত সমৃদ্ধ করেছে বাঙালি আর বাংলা ভাষাকে।
বাঙ্গালির হিন্দু আর মুসলিম এই দুই স্রোতের ধর্মীয় পরিচয়ের সেতুবন্ধনে নজরুলের অনবদ্য অবদানের বিশেষত্ব ছিল ভেতর থেকে উঠে আসা এক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবিক মাধুর্যটি। নজরুলের সাহিত্য কর্মের প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ধর্মকে বিবেকের বিরুদ্ধে, মানবিকতার বিরুদ্ধে, মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে ব্যবহারের কঠোর সমালোচনা, হুঁশিয়ারি।
একজন মানুষ চর্চা করুক না করুক, যে ধর্মের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন, তার একটি সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়েই বেঁড়ে উঠেন। চেতনে অবচেতনে, সময় অসময়ে সেই প্রভাবের একটি প্রকাশভঙ্গি তো থাকবেই। ধর্মীয় আচারে একেবারে নিস্ক্রিয় মানুষটিও কিন্তু ঐ ধর্মের সাংস্কৃতিক আচারে নিষ্ক্রিয় থাকেন না।
একজন পরহেজগার মুসলিমের তকমা না নিয়েও, ইসলাম বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও ইসলাম ধর্মের প্রতি নজরুলের অনুরাগের বিন্রম প্রকাশভঙ্গী বিস্ময়কর বটে। কালজয়ী ইসলামি গান, হামদ, নাতের অপূর্ব সব সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নজরুলের প্রকাশভঙ্গি বাঙালি মুসলিমদের জন্যে নব জাগরণ ছিল বটে।
“রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” এই গানটির শব্দ চয়ন লক্ষ্য করলে দেখবেন মানুষের প্রতি ভালবাসায় হাত বাড়িয়ে দেবার, ধনী-গরীবের সহমর্মিতা, আনন্দে সুখে মানবিকতার মিলন মেলায় একাকার হবার আকুতিতে স্রষ্টাকে খুঁজে পাবার নিরবচ্ছিন্ন এক তাগিদ।
ইসলামের মর্মবাণীতে তথাকথিত ধর্মীয় রিচ্যুয়ালের চাইতে মানুষ হয়ে উঠার যে তাগিদ নজরুল তাঁর সাহিত্যে খুব স্পষ্টভাবে সেটি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কোন গবেষণা প্রবন্ধে কিংবা প্রবন্ধের জার্নালের মান নির্ণয়ে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর থাকে তাতে শিক্ষা গবেষণা আর জনকল্যাণে এটির গুরুত্ব নির্ধারণ করে।
টাইটেলধারী হুজুরদের শত শত ওয়াজ মাহফিলের চাইতে নজরুলের সাহিত্য ইসলামী গণজাগরণে জন্যে অনেক অনেক বেশী ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের অধিকারি।
ইসলামী গণজাগরণের কথা শুনে আবার নজরুলকে নিয়ে আপনাদের সাম্প্রদায়িক গন্ধ খুঁজে বেড়ানোটা কিন্তু হবে অহেতুক। তৎকালীন মুসলিম গণজাগরণের নজরুল দুহাত ভরে লিখে গিয়েছেন ভজন আর শ্যামা সঙ্গীত; লেটো গানের দল থেকে আহরণ করেছেন রামায়ন, মহাভারত, গীতা আর পূরাণ সম্পর্কে জ্ঞান। বাংলা সাহিত্যে এমনকি বিশ্ব সাহিত্য জগতেও কোন কবির আন্তঃধর্মীয় জ্ঞান চর্চায় এই মুগ্ধতা কিন্তু বিরল।
নাস্তিকতাবাদ প্রগতিশীল ধারনায় বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা নির্ভর হলেও এর একটি অংশ হচ্ছে ফ্যাকালটেটিভ বা সুবিধাবাদী আচরণের দোষে দুষ্ট নব্য নাস্তিকতাবাদ। নির্মোহ আর নির্দোষ নাস্তিকতা অনেকটা “হু কেয়ারস” এর ভঙ্গিমায়, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা আছে কি নেই, এটি নিয়ে ওদের মোটেও মাথাব্যাথা নেই। নাস্তিকতায় এরা রুচিশীল, আচরণে মানবিক, অভ্যাসে সহনশীল, বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার স্তর-উত্তরণে এরা সুপিরিওর।
নব্য নাস্তিকতাবাদের রূপটা কিন্তু ভিন্ন, ধর্মভেদে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হতেও এদের আপত্তি নেই।
উপমহাদেশের নব্য নাস্তিকতাবাদীদের অনেকের আচরণের সাথে আস্তিকদের উগ্র অংশটির মিল খুঁজে পাবেন আর সেটি হচ্ছে মতবাদ প্রচারণায় উত্তাল উত্তেজনা। আস্তিকদের উগ্র অংশটির বিরুদ্ধে নজরুল লেখনীতে সোচ্চার থেকেছেন বরাবরই, কিন্তু নব্য নাস্তিকতাবাদীদের দেখা নজরুল পাননি বলে এদের বিষয়ে সতর্ক করা আর হয়ে উঠেনি।
যে বিশ্বাস করে “আছে” তাঁর ওই “আছে”র প্রতি একটা নিবেদন তো থাকতেই পারে। যে বিশ্বাস করে করে “নেই” তাঁর তো নির্মোহ থাকার কথা। ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় অর্থাৎ ধর্মে নির্মোহ থাকার অনেক নাস্তিকবাদীদের চাইতেও নজরুল ছিলেন অনেক বেশী অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি আর ভালবাসায় নজরুল ছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, মানুষে মানুষে ভেদাভেদবিহীন সমাজ নির্মাণের প্রাণ পুরুষ।
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন”- সৃষ্টিকর্তার বুকে পদচিহ্ন একে দেবার দুঃসাহসিক মানুষটি সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তন করে যে সব ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত রচনা করে গেছেন, বড় সাধ জাগে এই ক্ষ্যাপাটে বান্দাকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার ভালবাসাটি জানবার। সেটি কি অনেক সন্তানের মধ্যে একটু ভিন্ন ধরনটির প্রতি মায়ের অন্যরকম ভালবাসার মতো?
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির এই যুগে, করোনাকালেও আমরা দেখেছি বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে ধর্মের ভিলেন বানিয়ে দিতে। এই বক ধার্মিকরা রাজনৈতিক ধর্মের আড়ালে মানবতার কতবর শত্রু সেই বিষয়ে নজরুল বাংলা সাহিত্যে রীতিমত বিপ্লব করে গেছেন।
আস্তিক, নাস্তিক, ধার্মিকদের সম্মিলনে শান্তিপূর্ণ, সন্মানজনক সহঅবস্থানের সামাজিক সৌন্দর্যে বিশ্বাসী লোক ক্রমশই কমে যাচ্ছে। জঙ্গিবাদ তো আমাদের সর্বনাশ করছেই। তার পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন উপসর্গও ভাবিত করছে। নিজ ধর্মে প্রচণ্ড আস্তিক একজন মানুষ যখন একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে আঘাত করার জন্যে নাস্তিকের নাম ভূমিকার অভিনয় করেন কিংবা মঞ্চ কাঁপানো সেকুলার বিজ্ঞজন যখন ব্যক্তিগত জীবনে একজন অস্বাভাবিক রকমের সাম্প্রদায়িক মানুষ তখন সামাজিক সম্প্রীতিতে তাঁদের ভূমিকা কেবলই নেতিবাচক।
ধর্মীয় সংকীর্ণতার রাহু আমাদের পিছু ছাড়ছে না। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির মেরুকরণে উচ্চশিক্ষিত, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত জগতের অনেক তারকা মানুষজনও সঙ্কীর্ণতার গলিপথেই হাঁটছেন। একজন ধার্মিক মানুষও যে সামাজিক ভাবনায়, চিন্তা চেতনায় বিশুদ্ধ সেকুলার হতে পারেন, আমরাতো তা ভুলতেই বসেছি।
কবি নজরুলের সাহিত্যকর্মে আর ব্যক্তি নজরুলের হৃদয়ের গহীন থেকে উৎসরিত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনাবোধে ধন্য আর মহিমান্বিত হয়েছে হিন্দু মুসলমানের ধর্ম আর সমৃদ্ধ হয়েছে হিন্দু মুসলমানের বিবেকজাত পারস্পরিক সম্প্রীতি।
রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং জাতপাতের বহুরূপিতাক্লিষ্ট জীবনচক্রে ব্যক্তি নজরুল আর নজরুলের সাহিত্যকর্ম আমাদের প্রেরণা যোগায়, অনুপ্রাণিত করে সেই সত্যে বিলীন হয়ে যেতে “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।”
লেখকঃ কলামিস্ট এবং অণুজীব বিজ্ঞানী
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান