যেভাবে লাদেনের সাক্ষাৎকার নেন আবদেল
আল কায়দা নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সন্ত্রাসী হামলার হোতা ওসামা বিন লাদেনকে ২০১১ সালের মে মাসে মার্কিন সৈন্যরা হত্যা করে। বিন লাদেনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল যে, এই ব্যক্তি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের পেছনে অর্থের জোগান দিচ্ছে। কিন্তু তখনো লোকজন তার সম্পর্কে খুব কমই জানতো। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কারণেই সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
হামলার আগে সৌদি বংশোদ্ভূত এই ধনকুবের বছরের পর বছর কাটিয়েছেন আফগানিস্তানে। সে সময় তার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ফিলিস্তিনি এক সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান। ওসামা বিন লাদেনের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণেই তার সঙ্গে দেখা করতে লন্ডন থেকে আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি গুহায় ছুটে গিয়েছিলেন তিনি।
সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান বলছেন, লন্ডনের অফিসে বসে কাজ করছিলেন তিনি। এমন সময় এক ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
তখনো তিনি জানতেন না যে লোকটি তার কাছে ওসামা বিন লাদেনের আমন্ত্রণ নিয়ে এসেছেন। তিনি তখন বৃটেনভিত্তিক প্যান আরব দৈনিক পত্রিকা আল কুদস আল আরাবির প্রধান সম্পাদক।
আবদেল বারি আতওয়ান বলেন, ‘বিশালাকৃতির একজন মানুষ। পরনে ছিল সৌদি পোশাক। মাথায় পাগড়ি। মুখে বড় বড় দাড়ি। বেশ মোটা। তিনি আমার অফিসে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কি ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান?’ ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে তার পক্ষে ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। তিনি বলেন, ‘এরকম একটি আমন্ত্রণ পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ভাবলাম আমি কি যাবো? সেখানে যাওয়া তো বেশ বিপজ্জনক হতে পারে। আমার বয়স তখন চল্লিশের ঘরে। আবার যদি তাকে না করে দেই তাহলে মনে হবে যে আমি ভীতু। তখন আমি তাকে হ্যাঁ বলার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে সেটা ছিল খুব নরমভাবে হ্যাঁ বলা। আমি যে খুব স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে হ্যাঁ বলেছি ঠিক তা নয়।’
এর পরপরই তিনি আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। ব্যাগের ভেতরে নিলেন কিছু গরম কাপড়। কারণ ওসামা বিন লাদেন জানতেন তিনি যাচ্ছেন আফগান-পাকিস্তান সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায়।
দুর্গম গুহার পথে
পাকিস্তানের যে ব্যক্তির সঙ্গে আবদেল বারি আতওয়ানের যোগাযোগ ছিল তিনি তাকে কিছু আফগান কাপড় দিলেন। চোরাপথে সীমান্ত পার হয়ে তিনি একটি গাড়িতে গিয়ে উঠলেন যাতে অপরিচিত বেশকিছু লোক বসে ছিলেন। তাদের হাতে ছিল কালাশনিকভ রাইফেল। এর পর তারা অগ্রসর হতে লাগলেন দক্ষিণের তোরাবোরা পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ি আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে গাড়ি যতই উপরে উঠতে লাগলো আবদেল বারি আতওয়ান ততই নার্ভাস হয়ে গেলেন।
‘আমরা যখন পাহাড়ের ওপরে উঠলাম, মনে হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার মিটার ওপরে, তখন হঠাৎ করেই দেখলাম বড় বড় পাথর পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। তারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেল। শুধু আমি ছিলাম গাড়িতে। তারা রাস্তার ওপর থেকে ভারি ভারি পাথর সরাতে শুরু করলো। আমি শুনতে পেলাম তারা বলাবলি করছে যে, উপর থেকে হয়তো আরও পাথর গড়িয়ে পড়তে পারে।’
‘আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম কী হয়েছে। তারা বললেন, এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি জানো গত সপ্তাহে আবু ওমর, আবু মোহাম্মদ, আবু হাফস- তারা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন হঠাৎ করেই উপর থেকে গড়িয়ে পড়া একটা পাথর এসে তাদের গাড়িতে ধাক্কা মারলো এবং তাদের সবাই মারা গেল।’
‘তারা শহীদ হয়েছেন। এখন তারা বেহেশতে। আমাদের জীবনেও যদি এরকম কিছু ঘটে আমরাও খুব খুশি হবো। আমরাও তাদের পথ ধরে বেহেশতে যেতে পারবো। কিন্তু আমি তো তখনো তরুণ। আমার সন্তানদের ফেলে আমি এখনই স্বর্গে যেতে চাই না। যেতে চাই, কিন্তু এখন না, আরও পরে যেতে চাই। আমি তো তাদেরকে আমার মনের কথা বলতে পারিনি। তবে সত্যিই আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই,’ বলেন মি. আতওয়ান।
আবদেল বারি আতওয়ানকে নিয়ে তারা যখন গুহায় গিয়ে পৌঁছাল তখন মাঝরাত। সেখানে পৌঁছে খুব লম্বা এক ব্যক্তির দেখা পেলেন তিনি। তার মুখে দাড়ি। তিনি ওসামা বিন লাদেন।’
‘আরব সংস্কৃতি অনুসারে তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন গুহার ভেতরে যেতে। গুহাটি বেশ গরম ছিল। দুটো ঘর। একটা বসার। সেখানে ছিল প্রচুর ইসলামি গ্রন্থ, কোরআনের ব্যাখ্যা দেয়া বই। লোকজন বসেছিল মেঝের ওপর। ওসামা বিন লাদেনও সেখানে বসলেন। একটা বন্দুক ছিল তার কোলের ওপর। তারা আমাকে খুব মিষ্টি চা খেতে দিলেন।’
‘হঠাৎ করেই গুহার বাইরে প্রচুর গুলির শব্দ হতে লাগলো- রকেট পড়ার শব্দ, বিমান বিধ্বংসী বন্দুক দিয়ে গুলি করার শব্দ। মনে হচ্ছিল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সবাই তার কালাশনিকভটি ধরলো এবং গুহার বাইরে চলে গেল। ওসামা বিন লাদেনও তাদের সঙ্গে বাইরে চলে গেলেন। আমি তখন গুহার ভেতরে একা।’ প্রায় ২০ মিনিট পর তারা সবাই গুহায় ফিরে এলেন। ভেতরে প্রচণ্ড নীরবতা। আবদেল বারি আতওয়ান তখন ভয় পেয়ে গেছেন। ওসামা বিন লাদেন তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘আমাদের এটা করতে হয়েছে, কারণ কেউ যদি আপনাকে অনুসরণ করে থাকে। তিনি বললেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের সময়, যখন আপনি তার অংশ ছিলেন, তখনকার দিনগুলো যেরকম ছিল সেটা আমরা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি।’ আবদেল বারি আতওয়ান বললেন ‘আমি তাকে বললাম, আমি তো কখনো পিএলওর হয়ে যুদ্ধ করিনি। অন্য কোনো ফিলিস্তিনি সংগঠনের সঙ্গেও আমি কখনো জড়িত ছিলাম না। আমি একজন ফাইভ স্টার সাংবাদিক- হিলটন, শেরাটন হোটেলে থেকেছি। আমরা মনে হয় আপনারা একজন ভুল মানুষকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি হাসলেন। তারপর আমরা কিছুক্ষণ গল্প করলাম।’
এর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর আবার একই ঘটনা ঘটলো। তখন সবাই গুহা ছেড়ে চলে যেতে চাইলো। সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান তাদেরকে বললেন, কেউ একজন তার সঙ্গে থাকার জন্য। ওসামা বিন লাদেন তখন তার সঙ্গে গুহার ভেতরে থেকে গেলেন। ‘আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু আমার প্রতি তিনি বেশ দয়া প্রদর্শন করেছেন। তিনি বেশ আতিথ্য দেখিয়েছেন। আমি যে একটি সশস্ত্র সংগঠনের খুব নিষ্ঠুর এক নেতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটা তিনি আমাকে একটুও বুঝতে দেননি। তিনি খুব মৃদুভাষী ছিলেন। বেশ বিনয়ী। একেবারে সাধারণ মানুষের মতো।’
রাতের আহারে যা ছিল
এরপর তাদেরকে রাতের খাবার পরিবেশন করা হলো। কিন্তু একজন সৌদি ধনকুবেরের সঙ্গে তিনি কী ধরনের খাবার খেতে পারেন সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। ‘আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। খাবার হিসেবে যা দেয়া হলো তার মধ্যে ছিল পচে যাওয়া চিজ- বেশ লবণাক্ত। পচা গন্ধ আসছিল। সঙ্গে ডিম ভাজা। আলু ভাজা। আলুগুলো ছিল নরম। তেল ছিল না। ভেবে দেখুন- লন্ডন থেকে যাওয়া একজন সাংবাদিক, যে তার ব্লাডপ্রেসার এবং কোলেস্টরেল নিয়ে চিন্তিত তাকে কিনা এসব খাবার খেতে দেয়া হয়েছে!’ সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু হয় রাত ২টায়। তিনি সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা নিষেধ করলেন। বললেন, রেকর্ড করা যাবে না। লেখা যাবে। ‘আমার জন্য এটা খুব বোরিং ছিল- যেন একটা শিশুকে ক্লাসে কেউ ডিকটেশন দিচ্ছে আর আমি লিখে যাচ্ছি। তিনি যে উত্তর দিচ্ছিলেন সেটাই লিখে রাখছিলাম। আমি তাদের কথা শুনছিলাম। আমি কোনো সমস্যা তৈরি করতে চাইনি। কারণ তারা তো আমার সঙ্গে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারতো।’
সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষ হলে আবদেল বারি আতওয়ান বিছানায় চলে গেলেন। কিন্তু ঘুমাতে পারলেন না। ‘তারা আমাকে একজন অতিথির সম্মান দিচ্ছিলেন। সেখানে ওসামা বিন লাদেনও ঘুমাচ্ছিলেন। দুটো বিছানা ছিল। তিনি একটাতে ঘুমাচ্ছিলেন। আমি অন্যটাতে। এটা ঠিক বিছানা ছিল না। ছিল গাছের কিছু ডালপালা দিয়ে বানানো একটা বিছানার মতো। একটা ম্যাট্রেসও ছিল। মনে হচ্ছিল হাজার হাজার বছর ধরে ওটা ব্যবহার করা হচ্ছে। যখনই আমি বিছানায় পাশ ফিরছিলাম টের পাচ্ছিলাম যে আমার পিঠে কিছু একটা লাগছে।’ তিনি বলেন, ‘কাঠির মতো কিছু একটা। হাত দিয়ে টেনে দেখলাম সেটা একটা বন্দুক। তার পর দেখলাম একটা বাকশো। সেটা ভর্তি ছিল হ্যান্ড গ্রেনেড। আমি অস্ত্রশস্ত্রের ওপর শুয়েছিলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। যদি ঘুমিয়েও থাকি, আমি হয়তো আধাঘণ্টা বা ৪০ মিনিটের মতো ঘুমিয়েছিলাম।’ আবদেল বারি আতওয়ান খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেলেন। ফজরের নামাজে ইমামতি করলেন ওসামা বিন লাদেন। সাংবাদিক আবদেল বারি দাঁড়িয়েছিলেন পেছনের একটি কাতারে। এক সময় তার সেখান থেকে চলে আসার সময় হলো। তিনি লন্ডনে ফিরে এলেন এবং সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। এর পাঁচ বছর পর ২০০১ সালের মে ও অক্টোবর মাসে তাকে আবারো ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দু’বারই তিনি সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সূত্র: বিবিসি
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান