বই পর্যালোচনা: প্রাচ্য-প্রতীচীর কোভিডকাল
ড. রুমানা নাহিদ সোবহান ।। প্রাচ্য-প্রতীচীর কোভিডকাল বইটি লিখেছেন কানাডা অভিবাসী কলামিস্ট/অনুজীব বিজ্ঞানী ড. শোয়েব সাঈদ, প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য প্রকাশক জনাব মফিদুল হকের প্রকাশনী সংস্থা সাহিত্য প্রকাশ। বইটিকে এক কথায় বলা যায় করোনা সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত, জাতীয় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা, মানবিক সংবেদনশীলতার একটি প্রামাণ্য দলিল, কালের সাক্ষী।
২০২০ এর সূচনালগ্ন থেকেই আমরা একটি ভয়াবহ রোগের কথা শুনছিলাম যা কিছুদিন যেতে না যেতেই বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধি কোভিড নামে হানা দেয়। আমরা হতচকিত হয়ে যাই, পৃথিবী থমকে যায়। নতুন নতুন শব্দ আমাদের পরিচিত শব্দ ভূবনে দ্রুত স্থান করে নেয়। মাস্ক, স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেসান, ভ্যারিয়েন্ট, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ, কোভেক্স, এন্টিবডি, পিসিআর, র্যাপিড টেস্ট, হার্ড ইমিউনিটি, প্লাজমা শব্দগুলি শুধু শব্দ নয়, আতংকের দোসর। পৃথিবী প্রবেশ করলো এক নতুন পর্বে, কোভিড ছড়িয়ে পড়লো অতিমারী রূপে। অনির্দিষ্টকালের জন্যে গৃহবন্দী হলো বিশ্ববাসী। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ায় কোভিড ছিনিয়ে নিল লক্ষ লক্ষ প্রাণ। এ যেন ভাইরাস নিয়ে চাঞ্চল্যকর মুভিগুলোর বাস্তব জীবনের এক ভয়ানক এপিসোড।
কিন্তু কি তার প্রতিকার? উদ্বিগ্ন বিশ্বে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্যচিন্তাবিদ, রাষ্ট্রনায়ক সহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ পথের সন্ধান শুরু করে। উন্নত বিশ্বে প্রতিরোধে সূচনা ঘটে গবেষণার, আলাপ আলোচনা শুরু হয় বৈশ্বিক সহযোগিতা নিয়ে। মানব জাতিকে এই অতিমারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চলে এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। এই সংগ্রাম বুদ্ধিবৃত্তিক, এই সংগ্রাম বিজ্ঞান মনস্কতার আর প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতার।
উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি আমাদের মত দেশগুলিও এই অতিমারী উত্তরণের চেষ্টায় ব্রতী হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত কুসংস্কার, সংকীর্ণ রাজনীতি, বাগাম্বর আর অব্যবস্থাপনায় তৈরি করে কিছু বাড়তি উপদ্রব। এই অবস্থায় চিন্তায় ও শিক্ষায় পশ্চাদপদ জনগনকে সচেতন করার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিশ্বায়নের আলোকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপাত্ত নিজ ভাষায় উপস্থাপনের। বাংলা ভাষায় এই অতিমারী নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য যার নাম অগ্রগন্য তিনি হলেন অনুজীব বিজ্ঞানী ড. শোয়েব সাঈদ।
কানাডার মন্ট্রিয়লে অণুজীব বিষয়ে একটি বহুজাতিক কর্পোরেটে তিনি কর্মরত টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদে। অতিমারী কালের প্রথম থেকেই তিনি বাংলা ভাষায় একটার পর একটা নিবন্ধ রচনা করেন বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাসমুহ আমাদের সময় ডট কম, আমাদের নতুন সময়, বিডিনিউজ ২৪ ডট কম আর কানাডা থেকে সিবিএনএ ২৪ ডট কম, ভোরের আলো ইত্যাদিতে। অংশ নেন দেশ বিদেশের বিভিন্ন টিভি টকশোতে; প্রায় নিয়মিত কোভিড নিয়ে কথা বলছেন বাংলাদেশের এনটিভি আর এশিয়ান টিভিতে।
বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা সাধারণ জনতার কাছে কঠিন বিষয়। বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা বা কোড বোঝা কোনো সহজ কাজ নয়। কোভিড ভাইরাস, অতিমারী ও ভাইরাস প্রতিরোধকারী টিকার বিভিন্ন বিষয় ড. শোয়েব আমাদের মাতৃভাষায় অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোভিডের উপর তাঁর লেখাগুলি পড়েছি আস্থা আর বিশ্বাসযোগ্যতার মুগ্ধতায়। তথ্য, তত্ত্ব উপাত্ত ও বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ প্রতিটি নিবন্ধ। বড় কথা, বিষয়গুলি সহজে অনুধাবন করতে পেরেছি। আমার নিজের ভাষায় যেহেতু এই নিবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছে তাই তার গভীরতা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করাও সহজতর হয়েছে। পুরো কোভিডকালে উনার এই প্রচেষ্টা বাংলাদেশে কোভিডের জটিল বিষয়ে বাংলায় বিজ্ঞানমনস্ক একটি পাঠক সমাজ সৃষ্টি করেছেন।
অতিসম্প্রতি ড. শোয়েব সাঈদের নিবন্ধগুলি নিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচীর কোভিডকাল নামে সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটি বাংলা ভাষীদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের কঠিনতম বিষয়গুলি ড. সাঈদের লেখনীতে এক বিশেষ রূপ নিয়েছে। সূচীপত্রের দিকে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায় এই অনুজীব বিজ্ঞানী কি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন নিজ দেশবাসীকে সচেতনতার শিক্ষা দিতে, অবৈজ্ঞানিক ধ্যাণ ধারণা, কুসংস্কার ও মনগড়া বক্তব্য থেকে দূরে থাকতে।
তিনি শুরু করেছেন চীনের উহানে ভাইরাসটি উত্থান থেকে। তারপর নানা পরিক্রমায় শেষ পর্যায়ে অবতরণ করেছেন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপর বিশদ আলোচনায়। কোভিড ব্যবস্থাপনায় কানাডা, জাপান, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেছেন, কথা বলেছেন তথাকথিত এলকোহল থেরাপি সহ ভ্রান্ত চিকিৎসার উপর। সমালোচনা করেছেন এন্টিবডি কিট নিয়ে বাংলাদেশে হৈচৈ নিয়ে, ব্যাখ্যা করেছেন আরটিপিসিআর সহ বিভিন্ন টেস্ট পদ্ধতি, বুঝিয়ে বলেছেন কখন কোন পদ্ধতি কার্যকর। আলোচনা করেছেন চিকিৎসা পদ্ধতি, ভ্যাকসিন উদ্ভাবন প্রক্রিয়া/মেকানিজম সহ বিস্তারিত। ভ্যারিয়েন্টের জটিল কারিগরি বিষয়ে ব্যাখা করেছেন সহজবোধ্য ঝরঝরে বাংলায়। কোভিড বিষণ্ণতায় মানবতা, স্বজন হারানোর বেদনা, মানসিক স্বাস্থ্যের মত বিষয়গুলো উঠে এসেছে উনার প্রবন্ধে। কোভিডকালে ভ্রমন বিষয়ক জটিলতা ফুটে উঠেছে অভিজ্ঞতালব্ধ নান্দনিক বর্ণনায়। ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশ, বৈশ্বিক পরিস্থিতির আলোচনার পাশাপাশি কোভিড স্নাতক, কোভিড গার্ডেন আর মাস্কের ইতিকথার মত জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন চমৎকারভাবে। টিকা নিয়ে রাজনীতি, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ আর ভ্যাকসিন হেজিটেন্সীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলো যেন কোভিড যুদ্ধে এক কলম সেনানীর নিরলস সংগ্রাম।
অতিমারী অবরুদ্ধ পৃথিবীতে এই বইটিকে আমার মনে হয়েছে আমাদের জন্য এক আলোক শিখা আর ভবিষ্যতের জন্যে বৈশ্বিক আর বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে করোনাকালের সাক্ষী।
বিদগ্ধ পাঠক সমাজ বইটি পাঠ করে শুধু উপকৃত হবেন না, উপরন্তু কোভিড বিজ্ঞানকে বস্তুনিষ্ঠটায় অনুধাবন করে নেবার প্রয়াস পাবেন। ড. শোয়েবের কাছ থেকে এই ধরনের প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য লেখা আরো আশা করি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টিতে এই বই পাথেয় হোক।
ড. রুমানা নাহিদ সোবহান আন্তর্জাতিক বিষয়ক গবেষক, সমাজকর্মী এবং লেখক
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান
