মৃত্যুর মিছিলে শব্দহীন বিশ্বযুদ্ধ পর্ব- এক
চার দিন ধরে আমার গাড়ীর চাকা ঘুরছেনা, তুষার ধোয়া রাস্তাগুলোতে আগের মতো যানজট-জনজট নেই। শীতের শেষান্তে কানাডায় এই সময়ে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের সমাগম একটু বেশী থাকার কথা থাকলেও আজ সব যেনো অজানা ভয়ে ফাকা। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কানাডায়। জীবন আর জীবিকার তাগিতে শুধুই দৌঁড়ছি সকালসন্ধ্যা। অনেক সময় পরিবার পরিজনকে নিয়ে কিছুটা অতিরিক্ত সময় কাটানোর অনেকটা কষ্টসাধ্য ছিলো। সময় মানেই ডলার, সময় মানেই দেশে থাকা স্বজনের সহযোগিতা করা। প্রবাসে আসার পর থেকে এই অপ্রতিরোধ্য জীবন সংগ্রামের মেট্রো ট্রেনটি যে চলতে শুরু করেছিলো তা চলছে নিরবধি। ভোর সাড়ে চারটায় দৈনন্দিন জীবনের চাকা যে ঘুরতে শুরু করে অনেক সময় ঘানির চাকাটি ঘুরতে ঘুরতে কখনোবা মধ্যরাত হয়ে যায়! অবিশ্বাস্য ক্লান্তি-কষ্ট আর মানষিক চিন্তায় প্রতিটি সময়, প্রতিটি ক্ষনে ভাবতাম, একটু সময় যদি অতিরিক্ত বিশ্রাম বা ছুটি নেওয়া যেতো! অনেক সময় রাগে কষ্টে কাজ ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা করেছি তারপরে কষ্টকে সঙ্গে ধারণ করেই কাজে গিয়েছি শুধু নিজের জন্য নয় সব কিছু ভেবেই।
আজ মেঘ না চাইতে জল পাওয়ার মতো। গত সোমবার থেকে ঘরে বন্দি হয়ে আছি। বলতে গেলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে। এমন নির্বাসন কিংবা বন্ধ পেলেও আমার মতো কেউই খুশি নেই। এ বন্ধ কেউ চায়নি। যে বন্ধ একটু আনন্দ দিতে পারছে না। স্বজন-বন্ধু, পরিবার পরিজন পরিচিতজন থেকে সরিয়ে রাখছে। যে বন্ধ কেউ-কাউকে বিন্দুমাত্র শান্তি আর বিশ্বাস করতে পারছেনা, প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহুর্ত শঙ্কা-উদ্বিগ্ন, উৎকন্ঠা-অবিশ্বাস আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি করছে। কেউ কারো সঙ্গে হাত মিলানোতো দূরের কথা একই বিল্ডিং একই এলাকায় স্বজনরা থাকছে , ঝগড়া মারামারি হানাহানি নেই কিন্তু কেউ কারো চোখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। না, এটা শুধু আমার গল্প নয় সারা কানাডা থেকে বিশ্বের অনেক দেশ আর শহরের দৃশ্য। এসব গল্প একজন মানুষ কিংবা একটি শহরের গল্প হলে মেনে নেওয়া যায়। গল্পটির নাম যখন সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মনে ভয় আর শংঙ্কায় প্রচ্ছদ হয়ে থাকে এবং শতাব্দির শ্রেষ্ঠ মোড়ক হয়ে বিশ্বে আঘাত হানে তাতো বিশ্ব ইতিহাসে বিগত শতাব্দির মতো মৃত্যুপুরির নতুন সংযোজন হয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে। দুনিয়া কাঁপানো যে মৃত্যুর মিছিলে রচিত হচ্ছে একই নামে গল্প, ট্রাজেডি, ইতিহাস, উপন্যাস, অমর কবিতা যাই বলিনা কেন ২০২০ সালের সেই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মলাটে বড় করে লেখা থাকবে COVID-19 করোনা ভাইরাস । চীনের একটি খুবই সাধারন ঘনবসতি প্রাণচাঞ্চল্য সাধারন মানুষের শহর হুপেই প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী উহান নগরীর থেকে এই নতুন ধরনের প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসটি সুন্দরী ডাইনি রানীর মতো তাবৎ বিশ্বের শহরে শহরে গ্রাম গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। যা বিশ্বকে ভয়ানক ভূমিকম্প কিংবা বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটাকেও ম্লান করে দিচ্ছে। দিনের পর দিন সারা বিশ্ব যেনো এক অজানা বিশ্বযুদ্ধে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে । দেশে দেশে বিশ্বযুদ্ধ হলেও মানুষ, সমাজ সংসার পরিবার পরিজনরা একত্রিত হয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করা হতো কিন্তু কি এমন অদৃশ্য বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো যেখানে কামানের শব্দ নেই বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জনপদ নেই, তবুও দেশে দেশে লাশের বহর, মানুষ ভয়ে স্তব্দ- আতঙ্কিত। এই ভয়ানক গল্প-উপন্যাস-অমরকাব্য যা-ই বলিনা কেন মানবতা আর সত্য সুন্দরের ধরনীকে বাঁচানোর জন্য মহানায়ক হিসেবে হাসপাতালের সেবকরাই যেনো জীবন্ত ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যে গল্পের ভিতরে শুধু সেল্ফ আইসোলেশন, হোম কোয়ারাইন্টাইন, গ্লফস, স্যানিটাইজার মাস্ক, লক ডাউন, শাট্ ডাউন শব্দগুলো হানা দিচ্ছে। এমন ভাইরাসযুদ্ধ বিশ্ব ভীতকে নাড়িয়ে দিচ্ছে, ধর্ম আর বিজ্ঞান ত্রস্ত-বিপর্যস্ত। ক্যানসারের মতো কঠিন রোগ হলেও একজন অন্যজনকে দেখতে পারতো , সেবা শুশ্রষা পরিচর্যা করার সুযোগ থাকতো কিন্তু করোনার ত্রাসের কাছে সব যেনো মিথ্যে, এমন রোগ যা বাপের সামনে সন্তান, সন্তানে সামনে জন্মদাতা বাবা-মা, স্বামীর সামনে প্রিয়তম স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর মৃত্যু হলে ভালোবাসার স্বামীকে শেষ দেখার সুযোগ নেই। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কেউ শ্রদ্ধা কিংবা ভালোবাসা দেখিয়ে একটি ফুলও দিতে পারছে না, যে লাশ হাসপাতালে রাখতে ভয় করে, যে শবদেহ দাহ কিংবা মাটি দিতে কেউ এগিয়ে আসেনা, ফিউনারেল সেন্টারের কর্মীরা ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকে, সবই যেনো ভাষাহীন ভয়ার্ত চোখের করুণ পলক পড়া সেই ভয়ানক মহামারী অদৃশ্য ঘাতকের নাম করোনার অকরুণায় এখন সারা বিশ্ব স্তব্দ। চলবে…
সদেরা সুজনঃ প্রধান নির্বাহী, কানাডা বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি- সিবিএনএ২৪.কম
মন্ট্রিয়ল.২১.০৩.২০২০