ডাকাতের মুখে ডাকাতির গল্প ||| উম্মেসা খাতুন
যে কাজটা করে মানুষ খায় ওটাই হল তার পেশা। আক্রাম এখন ভিক্ষা করে খায়, সুতরাং ভিক্ষা করাটাই হল তার পেশা। তার আগে সে একটা দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল। নাম ছিল ‘আক্রাম ডাকাত’। তার নামের সঙ্গে চেহারার দারুণ মিল ছিল।
ওই নামে প্রায় দেড়শো-দুশো খানা গ্রামের মানুষ তাকে চিনত আর তার দৌরাত্ম্যে ওইসব গ্রামের মানুষ এতটাই উদ্বিগ্ন ছিল যে, তার নাম শুনলেই তাদের হৃদস্পন্দনের ধুকপুক বেড়ে যেত। কারণ, মুরগি কাটার মতো করে সে তখন মানুষ কাটতো। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো কাউকেই ছেড়ে কথা বলত না। যে তার সামনে এসে দাঁড়াত, তার কাজে বাধা সৃষ্টি করত তাকেই মেরে কাফাত করে দিত। তার কাছে সবসময় গুলি ভর্তি একটা পিস্তল আর ধারালো একটা ভোজালি থাকত। তার যে তখন ওটাই পেশা ছিল।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালের নিয়মে তার শরীরে যখন নানারকম পোকামাকড় ঢুকে গেল বিক্রম হারিয়ে ফেলে সে তখন ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষা করা ধরল। না হলে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে গিয়ে কবেই সে বেঘোরে মারা পড়ে যেতো।সেদিক থেকে এই কাজটা বেছে নিয়ে সে ভালোই করেছে বলা যায়। কারণ,এখানে নো রিস্ক নো পুলিশ।ঝোলাটা শুধু ঘাড়ে নিয়ে বেরোলেই হল, পেটের ভাত হয়ে যাবে।
যাইহোক, রাত্রি ন’টা বাজে এখন।তার বড় ছেলের ছেলে ধলু তার কাছে শুয়ে রয়েছে। শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই সে তার কাছে শুয়ে থাকে।মা-বাপের কাছে থাকেনা। কিন্তু অন্য ছেলের মতো সে আবার আপনি ঘুমায় না। ছেলে ভারি দুষ্টু।রোজ রাতে তাকে একটা করে নতুন গল্প শোনাতে হয়।গল্প না শুনলে তার নাকি ঘুমই আসেনা। গল্প শুনতে শুনতে চুপচাপ ঘুমিয়ে যায়।কোনো প্রশ্ন করে না। কিন্তু আজ তার স্টকে সেরকম নতুন কোনো গল্প না থাকায় আক্রাম তাকে বলল,”আজ তোকে একটা ডাকাতের গল্প শোনাব ধলু, শুনবি তো?”
ধলু এককথায় বলে দিল,”শুনব।”
“বেশ,চোখ বন্ধ কর তাহলে।”
ধলু চোখ বন্ধ করল।
আক্রাম তখন তার ডাকাতির একটা গল্প শুরু করল।গল্পটা হল—-
আক্রাম যখন ডাকাত ছিল তার তখন এই বড় বড় গোঁফ ছিল। আর তা পাক দিয়ে সে খাড়া করে রাখত। তার ওই গোঁফ দেখেই লোকে তাকে ভয় পেত। আর তার শরীরে ছিল জোড়া মোষের শক্তি। যে কারণে সে কোনো মানুষকে পরোয়া করত না। ফলে কত মানুষ যে সে জীবনে হত্যা করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেসব এখন মনে পড়লে তার নিজেরই কেমন লাগে!সে কী ছিল আর কী হল!এখন সে লাঠি ছাড়া চলতেই পারেনা।চোখেও ভালো দেখেনা।হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমাঝেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।
এরপর আক্রাম একটা ঢোঁক গিলে বলল যে,সে একদিন তার দল নিয়ে মাদলপুরে ডাকাতি করতে গিয়েছে।মাদলপুর হল নদী পারের একটা গ্রামের নাম। যে বাড়িটায় তারা ডাকাতি করতে গিয়েছে বাড়িটা দেখেই তারা থেমে গেল ।কারণ, বাড়িটা ছিল দোতলা আর বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। শুধু তাই-ই নয়,পুরো পাঁচিলটা আবার তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা ছিল।যা টপকে ভেতরে ঢোকা সব মানুষের পক্ষেই কঠিন ছিল। বাড়ির ভিতর ঢুকতে হলে সদর দরজা ভেঙে ঢুকতে হতো।কিন্তু কাজটা তখন মোটেও সোজা ছিল না। সদর দরজা ভাঙতে হলে যে কুড়ুল দরকার। অথচ তাদের কাছে তখন কোনো কুড়ুল বা ওই জাতীয় কিছু ছিল না।তাই, একরকম বাধ্য হয়েই তারা সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে এসেছিল এবং পরের দিন রাতে আবার গিয়েছিল। যাকে বলে একেবারে প্রস্তুত হয়ে।গিয়ে তারা এবার প্রথমেই কুড়ুল দিয়ে সদর দরজা ভেঙে ফেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। ঢুকে গিয়ে দেখেছিল, নীচের তলায় কোনো জনমানুষ নেই। একটা গোয়ালে শুধু কয়েকটা গরু আর ছাগল বাঁধা রয়েছে। তারা তো আর গরু বা ছাগল ডাকাতি করতে যায়নি। তারা গিয়েছে বাড়ি অলার অর্থ ভাণ্ডার লুঠ করতে। আর ওটা রয়েছে উপরে, ওই দোতলায়। তাদের খুঁজি এমনটাই তাদের বলে জানিয়েছে।খুঁজে খুঁজে কোনো গোপন সন্ধান ডাকাতদের যে এনে দেয় ডাকাতরা তাকে ‘খুঁজি’ বা ‘খুঁচি’ বলে। ওটা ডাকাতদের নিজস্ব ভাষা।যার ব্যাখ্যা হল ওটা।
অতএব সিঁড়ি বেয়ে তারা এবার দোতলায় উঠে গিয়েছিল। গিয়ে দোতলার সিঁড়িটা যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানে তাদের থামতে হয়েছিল। কারণ, ওখানেও একটা দরজা ভিতর থেকে লাগানো ছিল। ভিতরে ঢোকার জন্য পরে ওই দরজাটাও তাদের ভাঙতে হয়েছিল এবং দরজা ভাঙার শব্দে বাড়ির মানুষ সবাই জেগে গিয়েছিল। তাদের বাড়িতে যে ডাকাত পড়ছে সেটা তারা তখন বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছিল। পেরে প্রাণের ভয়ে তারা তারস্বরে চিৎকার আরম্ভ করেছিল,”ডাকাত! ডাকাত!ডাকাত!কে কোথায় আছো, তাড়াতাড়ি এসো। বাঁচাও! বাঁচাও!বাঁচাও!….”
তাদের ওই চিৎকারে বাইরের কুকুর গুলোও ডাকতে শুরু করেছিল,”ঘেউ….ঘেউ….ঘেউ….”
কুকুর আর মানুষের চিৎকারে গ্রামবাসীরা জেগে গিয়েছিল।ওই তো তারা ‘ধর ধর,মার মার’ করতে করতে তাদের দিকে তেড়ে আসছে।এক্ষুনি তাদের পালাতে হবে।না হলে তাদের হাতে ধরা পড়ে গেলে মারতে মারতে মেরে ফেলবে।যেমন,কিছুদিন আগে তারা একবার নয়নপুরে একটা বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে তাদের দলের রশিদ নামে একটা ডাকাত গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তারা তাকে মারতে মারতে মেরে ফেলেছিল।যেকারণে গ্রামবাসীরা এসে পৌঁছনোর আগেই তারা বোম বাস্ট করতে শুরু করেছিল।গ্রামবাসীরা যাতে ভয় পেয়ে গিয়ে তাদের ত্রিসীমানায় না আসে এবং বাড়ির মানুষদের বলেছিল,”তোদের যেখানে যা আছে এক্ষুনি আমাদের সব কিছু বের করে দে!না হলে তোদের কাউকে বাঁচিয়ে রাখবো না।সবাইকে…”
বাড়িতে তখন মোট পাঁচজন বড় মানুষ ছিল।তিন জন পুরুষ আর দু’জন মহিলা। এছাড়া একজন বাচ্চা ছিল।বাচ্চাটা তাদের দেখে ভয়ে খুব কাঁদছিল।যাকে বলে চিৎকার কান্না।তার ওই কান্না তাদের সহ্য হয়েছিল না।তার ওই কান্নাতেই তো আরো লোক জমে যাবে।ফলে তারা মুরগি জবাই করার মতো করে বাচ্চাটাকে জবাই করেছিল,”কেঁদে লোক জমাতে চাইছিলি না!”ও অন্যদের উদ্দেশ্যে ফের বলেছিল,”যেখানে যা আছে তাড়াতাড়ি তোরা বের কর এবার!”
“না,বের করব না।”
“বের কর এখনও বলছি!”
“না,বের করব না।”
দু’বার বলার পরও যখন তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল,ঘরের জিনিস বের করতে রাজি ছিল না,ঠিক তখনই তারা ধরে ধরে তাদেরও জবাই করেছিল,”বের করবি না!”
এরপর তাদের হাতে আর কোনো সময় ছিল না। আর একটু দেরি করলেই গ্রামবাসীদের হাতে তারা সবাই ধরা পড়ে গিয়ে মারা পড়ে যাবে।রশিদের মতো। সুতরাং,শুধু মানুষ মেরেই তারা সেদিন তাদের কাজে ছুটি দিয়েছিল।ডাকাতের মুখে ডাকাতির গল্প আপাতত এটুকুই।
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন