আমি বাঁচবার জন্য লিখি / বিপ্লব ঘোষ
অনেকে জানতে চায়, আমি কেন এত দুঃখের কবিতা লিখি …আমি চুপ করে থাকি। আমার জীবনে যা ঘটেছে তারপরে আমার এতোদিন বেঁচে থাকার কথা নয় । মাত্র উনিশ ও উনত্রিশ বছরেই ছেলে ও মেয়ে চলে যাবার পর। তবু বেঁচে আছি কেন? এই প্রশ্ন নিজেকে করে যা বুঝেছি বলার আগে দেখি রাশিয়ার লেখক, নাট্যকার ও ছোট গল্পকার চেকভের সেই গল্প।
” ঘোড়াগাড়ির সহিসের ছেলের অকালমৃত্যুর কথা কোনোও সওয়ারি শুনতে চায়নি। তবে সহিসকে তো শোকগাথা বলতেই হবে। কী করে করা, দিনের শেষে বেতো ঘোড়াটাকেই বেচারি সহিস তার ঐকান্তিক দুঃখের কথা বলত। এক নিদারুণ শোকের অংশী পাওয়া গেল, গরিবের অনুভূতি যেন তার ইজ্জত পেল।অবলা শ্রোতার কাছে হারানোর প্রকাশটাই তো সম্মান, মরে যাওয়া ছেলের প্রতি অসহায় এক বাবার অর্ঘ্য “
সেই ২০০১ সাল থেকে বেশিরভাগ দুঃখের কবিতা লিখতে বাধ্য হয়েছি কারণ সেই আঘাত ভুলতে পারিনি। চোখের সামনে ছেলে সানি বকখালির সমুদ্রে ডুবে গেল। তীরে আসবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও।
২০০৭ সাল থেকে জেনে গেছি বড় মেয়ে প্রিয়াংকা চলে যাবে। তবু যদি কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে। যদি ওষুধ আবিষ্কার হয়। তারপরে শেষের দু বছর দেখেছি সন্তানের অসহনীয় যন্ত্রণায় প্রতি মুহুর্তে বেঁচে থাকার লড়াই। এসব কথা কাউকেই বলতে পারিনি। ডাক্তাররা বলেছিল আমায়, আপনি বাবা হয়ে ওই দৃশ্য সহ্য করতে পারবেন না। চব্বিশ ঘন্টা নাকে নল। নব্বইভাগ লাংস নষ্ট হয়ে যায়। মেয়ে শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছিল কারণ আমি কিছুদিন যদি বাঁচি। মেয়ে চলে গেল।
কিন্তু কাউকে তো বলতে হয়। কিভাবে এই শোক বয়ে চলব ! তখন কলম, খাতা নিয়ে বসেছি। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। অন্য কবিতা,গল্প যে লিখিনি তা নয়।
এই দুঃখের, আঘাতের, যন্ত্রণার কবিতা আমি কি লিখেছি ! কে যেন লিখিয়ে নিয়েছে। এই মহা শোকেও বলে যাই, যখন ভাবছি এই সৃষ্টির কথা তখন এক আনন্দ। যখন লিখছি তখন আরেক।আবার যেই শেষ হলো তখন আরেক আনন্দ। এই তিন আনন্দ আমাকে বাঁচিয়ে দিল। এই আয়ূ সেই জন্য। আর কে না জানে দুঃখের কবিতাই আসল প্রকৃত কবিতা। অন্তর থেকে শব্দের ঢেউ এসে ভিড় করে রক্তে স্নান সেরে। পৃথিবীতে যত কবিতা কালজয়ী হয়েছে তার বেশিরভাগ দুঃখের, শোকের কবিতাই। কারণ শব্দগুলি এমনি আসে জোয়ার হয়ে খনন না করেই। ছুতোর মিস্ত্রি ছাড়াই বেহালার সুর হয়ে বেজে উঠে। আমি যতদিন বাঁচব,আমার এই দুঃখের কবিতা থাকবে। আর থাকবে বলেই চোখের জলে লেখা হবে। কারণ এই শোক নিয়েই আমায় চিতায় যেতে হবে।হয়ত ছাই হয়ে আবার জন্ম নেব।
———-
সানি
( ২৪সেপ্টেম্বর১৯৮২-২৮ অক্টোবর ২০০১)
আছে জন্ম,আছে মৃত্যু
সে এখনও তো আসছে তীরে
আমরা দাঁড়িয়ে আছি চেয়ে
সমুদ্র ফিরিয়ে দেয় সব
তাই সে এল ফ্রেজারগঞ্জে ।
কখনও যাইনি সেখানে
যাবো কি যাবো, কে জানে মনে
তবু একবার, শেষবার
বকখালি যাবো ।
—–
প্রিয়াংকা
( ৩০ নভেম্বর ১৯৯১—২৮ নভেম্বর ২০২০)
আছে জন্ম, আছে মৃত্যু
আমার মেয়ে জন্মাবার দুদিন আগেই
চলে গেছে দুরে ….
শ্মশান থেকে এসে
একটু গুছিয়ে
জন্মদিন করি ।
সকালের আলো বারান্দায় শুয়ে আছে
নিজেই রোদ পোহাচ্ছে এসে ।
বুকসেল্ফের উপর মেয়ে
অঘ্রাণ তো এল, এক মাসে দুটো কাজ ।
আমার সময় বড় কম ।