সেই রোহিঙ্গা নবীর হাতে গ্রেনেডসহ ভারী অস্ত্র
মিয়ানমারের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ
আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের শক্তি বাড়াতে প্রতিযোগিতা করে অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে ছদ্মবেশে থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
সব সন্ত্রাসীর অত্যাধুনিক এম-১৬ ও একে-৪৭-এর মতো অস্ত্রের পর অত্যাধুনিক গ্রেনেড ব্যবহার নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নেতাদের। ক্যাম্পে গত চার মাসে ২৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা। এছাড়াও গেল চার মাসে শুধু উখিয়া থেকে ৩৭ জনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। অপহৃত বেশির ভাগ স্থানীয় বাসিন্দা।
এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা স্থানীয় ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, সম্প্রতি উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে আলোচিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনীর সক্রিয় কমান্ডার মো. নবীর বাড়ি থেকে একটি গ্রেনেড উদ্ধারের পর থেকে নড়েচড়ে বসেছেন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা। গ্রেনেড উদ্ধারের পর থেকে ক্যাম্পে আতঙ্ক বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, রোহিঙ্গার বসতিতে পাওয়া সবুজ রঙের গ্রেনেডটি আর্জেস গ্রেনেডের মতো। অনুসন্ধানে পুলিশ জানতে পেরেছে, গ্রেনেডটি নবী হোসেন বাহিনীর। ঘটনার সময় আহত অবস্থায় গ্রেফতার মো. নবী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের অন্যতম সহযোগী। তাই গ্রেনেডটি তার ঘরে কীভাবে এসেছে, তা জানতে মো. নবীকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান ওসি।
এদিকে গ্রেনেড উদ্ধারের পর অনুসন্ধান করতে গিয়ে পিলে চমকানো তথ্য পাওয়া গেছে। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, নবী হোসেনের ঘাঁটি হিসাবে আলোচিত সীমান্তের তোতারদিয়া গোপন আস্তানায় শতাধিক গ্রেনেড, বিপুলসংখ্যক অত্যাধুনিক অস্ত্রের চালান মজুত রয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে অস্ত্রগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেনেডগুলো মিয়ানমারের তৈরি বলে দাবি করা হচ্ছে। অস্ত্র সংগ্রহে পিছিয়ে নেই কথিত আরসা নামধারীরাও। তারাও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সীমান্তে ঘাঁটি করে অস্ত্র মজুত করেছে।
অভিযোগ আছে, বাংলাদেশকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে মাদকের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে তাদেরকে গ্রেনেডসহ ভারী অস্ত্রের জোগান দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী প্রমাণ করে প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে চায় মিয়ানমার।
রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ওপর নজর রাখা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য আছে, সম্প্রতি নবী হোসেন এবং কথিত আরসার কাছে মিয়ানমারের তৈরি বিপুলসংখ্যক গ্রেনেডের পাশাপাশি ভারী অস্ত্রের জোগান দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। শুধু আলোচিত এক নবী হোসেনের হাতে শতাধিক গ্রেনেড মজুত রয়েছে। এসব গ্রেনেড দিয়ে ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে বড় ধরনের হামলা চালাতে সক্ষম নবী হোসেন। বিষয়টি ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
গত বছরের ৩০ এপ্রিল যুগান্তরের প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সনে ‘হাজার কোটি টাকার অস্ত্র আনছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী’ শিরোনামে একটি তথ্যবহুল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ক্যাম্প থেকে এম-১৬ উদ্ধারের পাশাপাশি একে-৪৭, বিদেশি বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং চার লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময় নবী হোসেনের ইয়াবা সেক্টরের প্রধান ইলিয়াসসহ চার সদস্যকে গ্রেফতার করে র?্যাব-১৫। এখন যুগান্তরের সেই প্রতিবেদনটি শতভাগ সত্য বলে আলোচনা চলছে সর্বত্র। নবীকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে ৩৪ বিজিবির পক্ষ থেকে।
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির সদ্য বদলি হওয়া অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির যুগান্তরকে জানিয়েছেন, নবী হোসেন দেশের জন্য হুমকি। তার সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সুসম্পর্ক এবং যোগাযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরেক ত্রাস মাস্টার মুন্না নবী হোসেন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। দেশে ৫০ ভাগের বেশি মাদক তাদের হাত ধরে ঢুকছে।
রোহিঙ্গাদের একাধিক সূত্র তথ্য দিয়ে বলছে, একদিকে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে ক্যাম্পের সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পকে অশান্ত করে রাখছে। বিশেষ করে কথিত আরসা ও নবী হোসেন বাহিনীকে সরাসরি অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দুই গ্রুপের মধ্যে খুনাখুনির মাধ্যমে ক্যাম্পকে অশান্ত করে রাখা এবং রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে তুলে ধরা মিয়ানমার সরকারের প্রধান টার্গেট। এসব রোহিঙ্গাকে গুপ্তচর হিসাবে ব্যবহার করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা কোনো বাধা ছাড়াই মিয়ানমারে আসা-যাওয়া করতে পারে। একই তথ্য রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, চার মাসে উখিয়ার একাধিক আশ্রয়শিবিরে আরসার সঙ্গে নবী হোসেন বাহিনীর একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২৩ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১০ রোহিঙ্গা মাঝি এবং পাঁচজন আরসার সদস্য। বাকিরা সাধারণ রোহিঙ্গা। নিহত মাঝিরা নবী হোসেন গ্রুপের সমর্থক। এছাড়াও গেল চার মাসে শুধু উখিয়া থেকে ৩৭ জনকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ১১ জনকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকিরা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসেন। অপহরণের শিকার হওয়া ১৭ জন রোহিঙ্গা এবং ২০ জন স্থানীয়।
এ বিষয়ে ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি ফারুক আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের চরম শত্রুভাবাপন্ন গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তারে একে অপরের ওপর পারস্পরিক হামলায় ক্যাম্পে খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। আমরা ৮ এপিবিএন পুলিশ সব সময় কঠোরভাবে এসব সন্ত্রাসীকে দমন করেছি, আইনের আওতায় আনছি। প্রতিদিন ক্যাম্পে ইনটেনসিভ প্যাট্রোলিং ও ব্লক রেইড পরিচালনা করা হচ্ছে। নবী হোসেনের গ্রেনেড ও অস্ত্র মজুতের স্থানটি ক্যাম্পের বাইরে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি গ্রেনেড উদ্ধারের বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা হয়েছে।
নবী হোসেনের আস্তানায় গ্রেনেড ও অস্ত্রভান্ডারের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার-৩৪ ও টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক যুগান্তরকে বলেন, তোতারদিয়া দুই দেশের অংশ হওয়ায় আন্তর্জাতিক আইনের কারণে ইচ্ছা করলেও অভিযান চালাতে পারছে না বিজিবি। তবে নবী হোসেন ও অন্য সন্ত্রাসীদের বিষয়ে কাজ করছে বিজিবি। সীমান্তেও কঠোর অবস্থানের কথা জানান বিজিবির দুই অধিনায়ক।
রোহিঙ্গা দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি : বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা এবং ওই জনগোষ্ঠী সন্ত্রাসীরা স্থানীয় এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী বা আরসা নামধারী সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাবেশে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তারা মিয়ানমার সরকার এবং দেশটির সেনাবাহিনীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। তাই তাদের গ্রেনেড, অস্ত্র দিয়ে স্বাভাবিকভাবে সহযোগিতা করবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাছাড়া যারা আমাদের দেশের ভালো চায় না, সেসব দেশ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক বিষয়। তিনি আরও বলেন, আমি প্রথম থেকে বলে এসেছি, পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট কখনো সমাধান সম্ভব নয়। যেভাবে রোহিঙ্গারা এ দেশে ঢোকে, ঠিক সেভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। তাহলে অন্য রাষ্ট্র এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী ও আরসাকে গ্রেনেড ও অস্ত্র সহযোগিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ-সদস্য বেনজীর আহমদ বলেন, যেহেতু সীমান্তবর্তী এলাকা, তাই এমন অনেক ঘটনা হতেও পারে। আমরা ইতোমধ্যে সীমান্তের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছি। এবার বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকার চিন্তিত হলেও শান্তিপূর্ণভাবে কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল হাজির বাড়ি এলাকায় মাদক কারবারিদের আস্তানায় তল্লাশি চলাকালে বিজিবিকে লক্ষ্য করে দুই থেকে তিনশ রাউন্ড গুলি ছুড়ে মাদকসম্রাট ও সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী। আত্মরক্ষার্থে পালটা গুলি চালায় বিজিবিও। তবে এতে হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে বিজিবি।-যুগান্তর