নিউইয়র্কে এপ্রিল ২০২৩–র শেষ সপ্তাহে একজন প্রগতিশীল লেখক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে ‘সৌদিও চাইনা, বৌদিও চাইনা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেন। ছন্দময় হেডিং, শুনতে ভালো লাগে, পাঠক খাবে। এতে কিছুটা সংগ্রাম, কিছুটা আপোষ সবই আছে। আমাদের দেশের প্রগতিশীলরা যেমনটা হ’ন, ‘নিজেদের লোকগুলোকে খুশি রাখা’ এবং তাতে ‘অন্যরা একটু অখুশি হলেও ক্ষতি নেই’-এটিও তাই! এটি আপোষ। দেশে এমনতর আপোষ করতে করতে সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে, প্রগতিশীলরা তাই এখন মুখ খুলে ‘টু-শব্দ’টি পর্যন্ত করতে পারছেন না? নিউইয়র্কে এঁরা ইনিয়ে-বিনিয়ে সত্য এড়িয়ে যান, কেউ ভয়ে, কেউবা পুরুস্কারের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকায়।
সৌদি আর বৌদি শব্দের সাথে বাঙালি পরিচিত। বৌদি শব্দটি পুরোপুরি তদ্ভব বাংলা শব্দ। মূলত: বাঙ্গালী হিন্দু এটি ব্যবহার করে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ধর্ম-নির্বিশেষে ‘ভাবী’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়, বাংলাদেশের মুসলমান ‘ভাবী’ ডাকে। ভাবী বাংলা শব্দ নয়, ‘বৌদি চাইনা’ না বলে ‘ভাবি চাইনা’ বলার সাহস কিন্তু কারো নেই? লেখকের ধর্মীয় পরিচয় তিনি মুসলমান, ‘ভাবী চাইনা তিনি লিখতে পারেন না, লেখা উচিতও নয়, ঠিক একই কারণে ‘বৌদি চাইনা’ লেখা ঠিক হয়নি। তবু তিনি লিখেছেন, কারণ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মুক্তমনা মুসলমান লেখকরা ‘ঈশ্বরের’ বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন, কিন্তু ঈশ্বরের পরিবর্তে ‘আল্লাহ’ শব্দটি ‘মাইরের’ ভয়ে ব্যবহার করেন না?
‘বৌদি চাইনা’ বললে অনেকে ‘হিন্দু চাইনা’ বুঝবে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এভাবে নাকচ করে দেয়াটা ঠিক হয়নি। হেডিং-এর ভেতর কি আছে অধিকাংশ পাঠক তা পড়েনা, বরং হেডিং দেখে মনে মনে একটি চিত্র এঁকে নেন। সৌদিও চাইনা, বৌদিও চাইনা’- হেডিং-র একটু ব্যাখ্যা দেয়া যাক? বাংলাদেশের আদ্র জলবায়ুতে কেউ চাইলেও তপ্ত সৌদি কালচার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, আগেও চেষ্টা হয়েছে, সম্ভব হয়নি, কারণ প্রকৃতি এর নিজস্ব নিয়মে সবকিছু ঠিকঠাক করে নেয়। তাই, মরু কালচার চাইলেও বঙ্গদেশে ওটি টেকানো বেশ কঠিন। পক্ষান্তরে বৌদিরা বঙ্গদেশের সম্পদ, ভুমিপুত্ৰী, তাঁদের বাদ দেয়া যাবেনা। বৌদি শব্দটি চমৎকার শ্রুতিমধুর, মিষ্টি, রসঘন এবং ভালবাসার।
একটি মেয়ের নাম ‘মোসাম্মৎ বিলকিস খানম চম্পা’, লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সবাই তাঁকে ‘চম্পা’ ডাকে। চম্পা নামের মধ্যে কেউ কেউ গন্ধ খুজবেন বটে, কিন্তু ওটি বাংলা শব্দ, সহজ ও শ্রুতিমধুর, তাই বেশি প্রচলিত। ভাষায় অনেক শব্দ আসে-যায়, সবকিছু টেকে না, ‘মোসাম্মৎ’ তাই টেকেনি? ৬/৭ দশক আগে অধিকাংশ মুসলিম বাড়ীতে ‘সালুন’ ও ‘মাছের রসা’ শব্দ দু’টি চালু ছিলো, এখন নেই, সেই স্থান দখল করেছে ‘তরকারী ও ঝোল’, এটি ভাষার নিয়ম, ধর্মের নয়। একইভাবে ‘মঙ্গল’ শব্দটিও বাংলা। নিউইয়র্কে এবার রমজানে ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন নিয়ে যা হলো, যারা বিরোধিতা করলো, তারা প্রায় সবাই ‘তথাকথিত’ প্রগতিশীল, এবং তাদের মূল আপত্তিটি ছিলো ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে!
প্রায়শ: শোনা যায়, ‘বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা’, কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়, এই কারণে সাধারণ মুসলমান এটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিতে পারছে না! যেহেতু বাংলা ভাষা ভারতীয় উপমহাদেশের সন্তান, যেহেতু ভারত একদা পুরোটাই হিন্দু ছিলো, তাই বাংলা ভাষায় হিন্দুদের আধিপত্য স্পষ্ট। ইংরেজি গ্রহণ না করে ভারতীয় মুসলমানরা ভুল করেছিলো, বাংলাভাষা নিয়ে কি একই ভুল হচ্ছেনা? ভাষার কি কোন ধর্ম হয়? সংস্কৃতির পরিধি বৃহৎ, ধর্ম এর একটি উপাদান। বঙ্গ সংস্কৃতি মানে বাংলার সংস্কৃতি। বাংলার জলবায়ু, মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্য, উৎসব নিয়েই এটি ভাস্বর। মাছেভাতে বাঙ্গালী, এটিই বঙ্গ-সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে দেয়া-নেয়া, আদান-প্রদান চলে।
বাঙ্গালী মুসলমানের বিয়েতে আগে ‘গায়ে-হলুদ’ ছিলোনা, এখন সেটি ঢুকেছে। এটি ধর্ম নয়, সংস্কৃতি, হিন্দু মুসলমান সবাই করে। এখন ঈদের আগের দিন ‘চাঁদনী রাত’ শুরু হয়েছে, এটি আগে ছিলোনা, এখন হচ্ছে। আগে পান্তা-ইলিশ ছিলোনা, এখন ঢুকছে। বঙ্গ সংস্কৃতি নাচে-গানে ভরপুর। মরু সংস্কৃতি’র সাথে গান-বাজনা যায়না, বঙ্গ সংস্কৃতি মানেই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। এর প্রাণ এখনো বৌদিরাই। দেশে যেদিন বৌদিরা (হিন্দুরা) বাদ হয়ে যাবে, সেদিন সংস্কৃতিও বাদ হয়ে যাবে? বাংলাদেশের কথা থাকুক, এই নিউইয়র্ক শহরে বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রাণ বৌদিরা। সাংস্কৃতিক স্কুলগুলোতে একটু ‘ঢু’ মারলে এটি স্পষ্ট হবে, দেখবেন বৌদিরা (হিন্দুরা) নাই তো বঙ্গ-সংস্কৃতি নাই!
দেশে কিন্তু ‘সৌদিও চাই, ভাবীও চাই’ ঘটনা ঘটে গেছে। তাইতো, ২০১২-তে রামু থেকে ২০২১-এ কুমিল্লা পর্যন্ত বা এখনো প্রতিদিন যতগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে, তাতে শুধু প্রতিক্রিয়াশীলরা নন, তথাকথিত প্রগতিশীলরা উৎসাহের সাথে অংশ নিয়েছেন, বহুস্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রতিবাদ করার তো কোন প্রশ্নই উঠেনা! আমাদের দেশের কম্যুনিষ্টদের মত প্রগতিশীলরাও আগে মুসলমান, তারপর বাঙ্গালী! তাই অন্য ধর্মের লোকজনের ওপর অত্যাচার হলে এঁরা এগিয়ে আসেন না, কথা বলেন না, চোখ বন্ধ করে থাকেন। বৌদিরা তা নয়, বৌদিরা বঙ্গবন্ধু’র মত আগে মানুষ, তারপর বাঙ্গালী, এরপর হিন্দু/মুসলমান।
সুতরাং, বৌদিদের (হিন্দুদের) বাদ দিতে চাইলেও বাদ দেয়া যাবেনা। মোঘল-পাঠানরা ৬শ’ বছর চেষ্টা করে পারেনি, পাকিস্তানীরা সিঁকি শতাব্দ চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী অর্ধ-শতাব্দী ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে, কাজ হচ্ছেনা। কারণ বৌদিদের সংস্কৃতিক শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত, এবং তা প্রাকৃতিক, চাইলেও ধ্বংস হয়না। আর যদি কখনো দৈব কারণে বৌদিদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পরে, তখন ‘আত্মপরিচয় সংকটে’ ভোগা আজকের তথাকথিত প্রগতিশীলরাও থাকবেন না। কারণ, মৌলবাদ বড়ই নির্মম, কাউকে ক্ষমা করেনা। তখন কিন্তু দাউদ হায়দার, তসলিমা’র মত ‘বৌদি জিন্দাবাদ’-ই একমাত্র ভরসা। সৌদি নয়, বৌদি ও ভাবীই ভবিষ্যৎ। [email protected];