ঘর-বাহির একাই সামলাচ্ছেন শেখ হাসিনা
এফ এম শাহীন ।। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীবিধৌত টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের ঘর আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। রাজপথে বাবার আন্দোলন-লড়াইয়ের জীবন আর নেপথ্যে বাবার সকল লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকা মায়ের সংগ্রাম দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা সেই সন্তান নিজেও বেছে নিয়েছেন পিতা-মাতার পদাঙ্ক। বাবা বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে উচ্চকণ্ঠ। সেই পথ অনুসরণ করছেন তার প্রথম সন্তানও। আবার বঙ্গবন্ধু যেমন পরিণত বয়সে এসে দেশের মানুষের মুক্তি এনে দিয়ে পরিণত হয়েছিলেন বিশ্বরাজনীতির বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে, ঠিক তেমনি তার প্রথম সন্তানও পরিণত বয়সে এসে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তি আর উন্নয়নের লড়াইয়ের মাধ্যমে পরিণত হয়েছেন বিশ্বনেতা। কারো কাছে শান্তির দূত, কারো কাছে বিশ্ব নেতা, কারো কাছে মানবতার নেতা হিসেবে পরিণত হওয়া তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশ। দেশের ভেতরে নিজের দল, পরিবার, আগ্রাসী আমলাদের সামলিয়ে যেমন বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করছেন- তেমনি দেশের বাইরের আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির কঠিন সমীকরণ এবং ষড়যন্ত্র একাই মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাকে। কঠিন এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে যে সহযোগী তার পাশে থাকা দরকার- তাদের ভূমিকা আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। শেখ হাসিনার নিরন্তর প্রচেষ্টায় আজকের বাংলাদেশের সকল অর্জনকে কেউ কেউ মাড়িয়ে-গুড়িয়ে দিতে চাইছে! শেখ হাসিনা আজ দশভুজা মাতৃরূপে একাই লড়াই করে চলেছেন এক নতুন বাংলাদেশের আশায়- পিতার স্বপ্ন পূরণের জন্য। বিশ্ব রাজনীতিতে শেখ হাসিনা যে কতটা সাহসী উচ্চারণ- তা আমরা বাঙালি হয়ে বুঝতে পারছি না। ক্ষমতাবান বিশ্ব মোড়লদের এভাবে ধমক দেয়া যায় বা আমরাও পারি- সেটি একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাই করে দেখিয়েছেন।
পিতাসহ পরিবার-পরিজন হারিয়ে দুই বোন তখনও দেশে ফিরতে পারেননি। ১৯৭৫ থেকে পরের আরও পাঁচ বছর অবস্থান করেছেন ভারতে। ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ড থেকেই তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তেমন একটি সময়ে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তার কাধে তুলে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব- নির্বাচিত করা হয় সভাপতি। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ওই বছর ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তিনি, শুরু করেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। আর সে কারণেই ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন তিনি। বারবার কারান্তরীণ করা হয় তাকে, হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা চালানো হয়।
শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা, হত্যার হুমকি উপেক্ষা করেও শেখ হাসিনা ভাত-ভোট ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তারই ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগকে এনে দিয়েছেন বিজয়, গঠন করেছেন সরকার। তার নেতৃত্বে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ। ২০০৮ থেকে একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে যে বাংলাদেশের ছবি তিনি পৃথিবীর মানচিত্রে একেছেন- তা আজ বিশ্বে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার এটাও ঠিক একটানা ক্ষমতায় থাকার ফলে তার সহযোদ্ধা, দল কিংবা পরিবারের স্বজন পরিচয় দেয়া চরিত্রগুলোও তিনি আবিস্কার করে চলেছেন। তাই তাকে বারবার বলতে শোনা যায়, আমি নীলকণ্ঠী, বিষ পান করেও হজম করি।
মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শেখ হাসিনা সবসময়ই আপসহীন। ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে তার সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় স্থাপিত ট্রাইবুনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে এবং রায় কার্যকর করা হচ্ছে।
কেবল স্বপ্ন দেখানোই নয়, স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, তার পথও দেখিয়েই চলেছেন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি। এরই মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অবস্থান গোটা বিশ্বে ঈর্ষণীয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্থনীতিতে বিশ্বের শীর্ষ ২৬টি দেশের তালিকায় উঠে আসবে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকরাও বলছেন, বাংলাদেশ যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত হতে এই দেশকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। যার কল্যাণে উন্নয়ন আর উত্তরণের পথে বাংলাদেশের এই পথচলা, তিনি শেখ হাসিনা।
অনেক ষড়যন্ত্রের জাল আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে পেরেছি। স্বপ্নের এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। আশা করা হচ্ছে, এই সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে অবদান রাখবে। চালু হওয়া মেট্রোরেল রাজধানী ঢাকার পরিবহন খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আগামী অক্টোবরে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিট আগামী বছরের এপ্রিল নাগাদ চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। ২০০৯ সালে এই সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির কথা সবারই মনে আছে। কী ভয়ংকার সময় অতিবাহিত করেছে দেশের মানুষ। তখন সাকুল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। আজ খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মেট্রিক টন।
মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় বীর হিসেবে মর্যাদা প্রদান, বীর নিবাস, আশ্রয়ণ প্রকল্প, শিক্ষায় উন্নতি, যোগাযোগের অবকাঠামো অভূতপূর্ব উন্নয়ন, নারীর শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ, সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত- অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুরক্ষার সোশ্যাল সেফটিনেস সাপোর্ট, সর্বজনীন পেনশন স্কিম, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের সহযোগিতা, অটিজমসহ শেখ হাসিনা সরকারের প্রধান উদ্যোগসমূহকে বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মহল।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস।
কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উদ্ভাবন। যেখান থেকে দেশের প্রান্তিক সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে ৩০ ধরনেরও বেশি ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার দ্রুত কমাতে সাহায্য করেছে। এই উদ্যোগের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে বাংলাদেশকে। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসন ক্ষমতার সাফল্যের অন্যতম নিদর্শন এই স্যাটেলাইট। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একদিনে একশো সেতু ও সড়ক উদ্বোধনের বিরল নজির স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, সকল বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো নেতৃত্ব প্রয়োজন।
আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা এখন সর্বজনবিদিত। বিশ্বনেতৃত্ব আজ শেখ হাসিনাকে বলছেন বিশ্বের দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা। তাদের চোখে শেখ হাসিনা উন্নয়নের ম্যাজিশিয়ান আর বেস্ট ক্রাইসিস ম্যানেজার। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি একজন মানবিক রাষ্ট্রনায়কও বটে। ১৫ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় তার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে বিশ্বের বুকে।
একটি রাষ্ট্র কতদূর এগিয়ে যাবে, কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করে একজন রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বের ওপর। শত ষড়যন্ত্রকে অতিক্রম করে শোষণ-বঞ্চনার অবসান, অর্থনৈতিক মুক্তির অভিপ্রায়ে সৃষ্ট বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের দূরদর্শী ও সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল প্রেক্ষাপট রচনা করে সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের। তথ্য-প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা সাধারণ মানুষের মধ্যেও দারুণ সাড়া ফেলেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে স্বাভাবিকভাবে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ তথা নাগরিক হয়রানিবিহীন একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া- যেখানে ভোগান্তি ছাড়া প্রত্যেক নাগরিক পাবে অধিকারের নিশ্চয়তা এবং কর্তব্য পালনের সুবর্ণ সুযোগ। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকনোমি, স্মার্ট গর্ভনেন্স ও স্মার্ট সোসাইটি নির্মাণের মধ্য দিয়েই তৈরি হবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ।
আজ জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন, অকৃত্রিম শুভকামনা। সুস্থ থাকুন, শতায়ু হোন বঙ্গবন্ধুকন্যা। প্রজন্মের প্রত্যাশা— পিতার অসমাপ্ত কাজ আপনাকেই সমাপ্ত করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দুর্নীতিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল স্মার্ট বাংলাদেশ। জয় বাংলা।
লেখক: নির্মাতা ও সংগঠক, প্রধান সম্পাদক, জাগরণ টিভি