স্পেস ।।।।।পুলক বড়ুয়া
ভালো-মন্দ যাই হোক, সেখানে স্পেস থাকবেই। ভালো হলে ভালো, খারাপ হলে খারাপ। ঘটনা ঘটে এই স্পেসে। তাই, সবসময় স্পেস দরকার। পেলেই সে বিকশিত হয়ে ওঠে। বেড়ে ওঠে। তাই, কিছুর জন্যে চাই, এই স্পেস। ঐ কিছুটাই তাই হয়ে ওঠে তার ঘটনা বা ক্রিয়াকান্ডের জায়গা জমিন। স্পেসকে তাই বোঝা দরকার। সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কী তার ভূমিকা? কতটা। কেমন।
১
কিন্তু, মুশকিল হলো, দুর্ভাগ্যজনক কিছু নিয়ে। আমরা দেখতে পাই, নেতিবাচক, ক্ষতিকারক কিছু আমাদের মধ্যে জায়গা নেয়। যেমন ধরুন : মনের মধ্যে অতিরিক্ত রাগ-দ্বেষ-ঘৃণা-অহমিকা-লোভ-চাহি দা। প্রভৃতি। সরাসরি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত হানে। তিলে তিলে মানসিকতা নষ্ট করে। যার প্রভাব পড়ে শরীরেও। আমরা নানাভাবে পীড়িত হই। নানাবিধ ব্যধি ভারাক্রান্ত হই। অতিরিক্ত মানসিক চাপকেও যদি স্থান দিই, তারও ফলশ্রুতি একই। শারীরিকভাবে মাত্রাতিরিক্ত মন্দ-ভালো গ্রহণ—দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। হুমকি হয়ে ওঠে। কোনোটিই ঠিক নয়। যাকে তাকে তো জায়গা ছেড়ে দেয়া যায় না। আরও মজার বিষয় হলো, একটার সমস্যা হলে আরেকটার ওপর প্রভাব পড়ে। তার মানে হলো, আমাদের মধ্যে স্পেস আছে বলে, তার ক্ষতি না-হয় মতো, তাকে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
২
যেমন ধরুন, অনেক ক্ষেত্রে দেখি, জায়গা-জমি দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। আগে হয়ত মুক্ত মাঠ ছিল। খোলা খাল-বিল-জলা ছিল বেশ। এখন নেই। ওই জায়গাগুলি এখন কোথায়? নেই। নানাভাবে বেহাত হয়েছে। দখল বেদখল হয়েছে। নাশ হয়েছে। ভরাট হয়েছে। এখন ওখানে অন্য কিছু। গাছপালাগুলো কেটে নেওয়া হয়েছে। পুকুর ছিল চুরি হয়ে গেছে। ভরাট করে ফেলা হয়েছে। প্রথমত এসব শহরাঞ্চলে বেশি ঘটছে। ঘটেছে। আর বোধ হয় ঘটার জায়গাও নেই। অধুনা, গ্রামগুলোও এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সেখানেও তার চিত্রায়ন হচ্ছে।
৩
স্বাভাবিক বা সহজাত ব্যাপ্তিগুলো না-থাকার ফলে, অসুবিধা বা ক্ষতিটা কী? স্থানিক বা বৈশ্বিক জলবায়ু ক্রমশ এখন উষ্ণভাবাপন্ন। বৃষ্টিপাত হ্রাস, মরুময়তা বৃদ্ধি, পথ থেকে পথে ঠান্ডা ছায়ার হাহাকার, ভূগর্ভে পানির স্তর তলিয়ে যাওয়া। এখন হরহামেশাই অনেক কিছু টের পাচ্ছি। এক আদর্শ গ্রহের উপরি কাঠামো, অবকাঠামো, ভেতর কাঠামো কিভাবে আমাদের হাতে বেপথু-আদর্শচ্যুত হলো? আমাদের এই বাসযোগ্য বসুন্ধরা আমাদের চোখের সামনে অন্যরকম হয়ে গেল! এতটাই এখন নেতিবাচক পরিবেশ এই পৃথিবীর। পৃথিবী যদি আদর্শহীন হয়ে যায়, তাকে কেমন লাগবে? আমাদের মস্তিষ্কের যে শুভবুদ্ধির জায়গা রয়েছে, তার জাগরণ দরকার। পৃথিবীর ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত। আল্ট্রা ভায়োলেট রে ঠেকাবে কে? মহাশূন্যে একেকটি গ্রহ- নক্ষত্র একেকটি ব্যাপ্তি। অস্তিত্ব মাত্রই তাই। সে জীবিত বা মৃতই যাইহোক।
৪
এত যে প্রকৃতির উপর মানুষের অচিন্তনীয় আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণহীন জোরজবরদস্তি, সর্বনাশ—এটাই এখন কাল। সবার একটা জায়গা আছে। তার সেরকম থাকা চাই। কারো সহজাত কেড়ে নেয়া অপরাধ। তাকে ক্ষুন্ন করা যাবে না। যেমন, আদিবাসী বা উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যে নামেই ডাকুন, তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়া অনৈতিক, গর্হিত অন্যায়। মানবাধিকার লঙ্ঘন।অমানবিক। মানবতাবিরোধী অপরাধ। সর্বোপরি, তা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তো নস্যাৎ করেই। দেখুন , কী করে সদাচারের জায়গায় অনাচার ঢুকে পড়ে। কখনো কোনো স্বতন্ত্র মানুষকে, সম্মিলিতভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে দেশহীন করা হচ্ছে। যেমন, একটি বিশাল জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা আজ তাদের জন্মভূমি থেকে সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিতাড়িত। এই যে নিজ বাসভূমি থেকে পরবাসী—এটা কি স্থানচ্যুতি নয়?
৫
মনে করুন, রাস্তার বা অন্যত্র যে গাছটি বাঁচিয়ে তার গোঁড়া ঘেঁষে ইট-চুন-সুরকি লাগিয়ে এমন শ্বাসরোধ করে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হয়েছে, একদিন দেখব, বৃক্ষটি ধীরে ধীরে মরে গেছে। প্রয়োজনীয় পরিসরটুকু আমরা তাকে দিইনি। আমরা তাকে শ্বাসরোধ করেছি, আহত করেছি। ইচ্ছেমতো ঘরবাড়ি, রাস্তা গড়েছি। শুধু তাই নয়, তার গায়ে বিজ্ঞাপন, পোস্টার সেঁটে দিয়েছি। কোথাও কোথাও আমাদের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য তার নিম্নাঙ্গ বর্ণময় করেছি। পেরেকে, আঁটায়, রঙে একটা ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তার। বৃক্ষের কত প্রয়োজন, অথচ, তাকে কদর নয় কতল করছি। তার যথাস্থান আজ সংকুচিত। কত ঔষধি গাছ আগে যত্রতত্র পাওয়া যেত।
৬
এই বৃক্ষ, গাছপালাগুলি পাখিদের নীড় বাঁধবার ঠাঁই। বাবুই পাখির ওরকম নান্দনিক নীড়—তালগাছের মতো ওরকম উঁচু স্থান ছাড়া কি সম্ভব? বনবাদাড় পশু পাখিদের বিচরণক্ষেত্র। পর্বত মুনি-ঋষিদের সাধনার জায়গা। গিরি-গুহা-তপোবন হয়ে উঠে মহাধ্যানী।
৭
বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববি দ্যালয়গুলি আনুষ্ঠানিক পাঠদানের স্থান। শুধু পাঠক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তা আরও প্রসারিত সংস্কৃতি, ক্রীড়াচর্চা, সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে। অথচ, আজকাল যেন কিছুই প্রাণবন্ত নেই।এগুলি অনেক সীমিত হয়ে পড়েছে। ক্লাসরুম ছাড়া খোলা মাঠ, খেলার মাঠ-শূন্য শিক্ষাঙ্গন। ভাবা যায়?পোল্ট্রি ফার্মের মতো একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এভাবে আমরা যার যা প্রাপ্য, তাকে সেটা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।
৮
ফুটপাতে, রাস্তায় চলছে হরদম বিকিকিনি। মানুষের স্বচ্ছন্দে পা-ফেলার খালি জায়গায় সারি ব্যাক্তিগত ও গণপরিবহন দাঁড়িয়ে। পার্কিং! বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশে এই দুর্লভ দৃশ্য এত সুলভে দেখা যায় না। কী বিস্ময়কর তাই না! এগুলো ঠিক না হলেও, চলছে।
একটা চৌহদ্দি তো থাকতে হবে, তাই না? একদিন দুদিন নয়, এটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর। দশকের পর দশক। যুগ যুগ ধরে। বহাল তবিয়তে।
৯
মনে করুন, ভোরবেলা হাঁটছি। এখানেও সময় আপনাকে একটা স্পেস দিচ্ছে। ভোরবেলা। হোটেল-রেস্তোরাঁ-পার্ক-সমুদ্র সৈকত—আপনার জন্যে প্রতীক্ষা করছে। এই অপেক্ষা আপনার জন্যে একটি সুখময় স্পেস। কেউ ভালোবাসে—তার মনের কোণে আপনার জন্যে একটা জায়গা আছে। বন্ধু-বন্ধুনী-আড্ডা : হাত-পা ছড়িয়ে দেবার মতো চমৎকার ফুরসৎ, সবচে’ মজার এব অন্তরঙ্গ ভুবন। উৎসব-মেলা-অনুষ্ঠান—সাড়া জাগানো জায়গা। সভা মানে টানটান উত্তেজনা। আবার হাসপাতাল, ডাক্তার—এরা আপনার নিরাময় কেন্দ্র। আরোগ্য নিকেতন। কত বিচিত্র আমাদের স্পেস। আরো আছে, কত বিনোদন কেন্দ্র। মনোরঞ্জনের জন্যে। শুধু বাড়াবাড়িটুকু চোখে পড়ে। আর এই অনধিকারচর্চা বিপর্যয় ডেকে আনে।
১০
এই যে আমাদের মানবজীবন—এইটা একটা পরিসর। আমরা একে মানবজমিনও বলি। শৈশব থেকে বার্ধক্য অব্দি—তার একেকটি ক্ষেত্র। অস্তিত্ব। সত্তা। কোনো কিছুর শূন্যতা—আমাদের তার অনুভূতি এনে দেয়। একটা কিছুর সুযোগ দেয়, শূন্যতা, শূন্যস্থান।
এই যে আমাদের অনুভব, নানান চিন্তা-চেতনা, বোধ, উপলব্ধি—স্বপ্ন-কল্পনা-বাসনা, রাগ-অনুরাগ-প্রেম-ঈর্ষা -লড়াই-বড়াই-সখ্যতা, ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-বাণিজ্য -কৃষি-বিজ্ঞান-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সং স্কৃতি-রাজনীতি—অর্থাৎ, মানুষের ভাবগত ও বস্তুগত যাবতীয় বিচিত্র সৃষ্টি ও বিনির্মাণ—সবই তার একেকটি স্পেসের ফসল। মানুষের রকমারি সাধনা, চর্চা ও ধারণার মধ্যেও আপনি খুঁজে পাবেন, তার একেকটি স্পেস। বিভিন্ন মতামত, মতবাদ, আধ্যাত্মিকতা, দর্শনের মধ্যে রয়েছে এই স্পেস। এগুলোর মধ্যে মানুষ তার আপন জায়গা করে নিয়েছে। খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। এগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। আপনি তাকে অস্বীকার করতে পারেন না। যেকোনো সংখ্যক মানুষের—বেশি না-হোক—অল্পসংখ্যক হলেও তার ঠাঁই তার।
বহুমাত্রিক স্পেস নিয়ে এ বিশ্ব। বিপুলা এ ধরিত্রী। তার বিত্তবৈভব। বিষয় বৈচিত্র্য-সৌন্দর্য-বিস্তার। যেদিন থেকে তার এসব পরিসরের প্রতিবেশ নষ্ট হয়েছে, পরিবেশ ম্লান হয়েছে, ক্ষুণ্ন হয়েছে—সেদিন থেকে সভ্যতারও সংকট জমতে শুরু করেছে। প্রতিদিন একটু একটু করে পৃথিবীতে অস্থিরতা বেড়েছে। বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এবং তা সবধরনের । এর অর্থ আমাদের অস্তিত্ব এখন দেহের ভেতরে-বাইরে দুদিকেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত নয়। রীতিমত টানাপোড়েনের সম্মুখীন। এর আরো অর্থ, সামনে সবাই—নির্দ্বিধায় একবাক্যে বলতেও পারবেন না, যে, আমাদের এই পৃথিবী বিপন্ন! সেই সময়ের বদলে, আরেকটু এগিয়ে গিয়ে, অকস্মাৎ—একদিন শুনবেন, দিকে দিকে সবখানে ছড়িয়ে গেছে, ইসরাফিলের শেষ ফুঁ!—খেলা শেষের শেষবাঁশি—শিঙার শেষধ্বনি!!—ঐ ঐশী সুর!!!