অনুবাদ বলল, “পাখির বাচ্চারা তিন দিন হলো বাসার এক দিক থেকে উড়ে বাসার অপর দিক গিয়ে বাসার মধ্যে ওড়ার অনুশীলন করছে। আশা করা যায়, আজ-কালের মধ্যে বাচ্চা দুটো আকাশে উড়বে।”
হারাধন বর্মন কোদাল কাঁধে নিয়ে আসছিল। হারাধন বর্মনের সাথে রাস্তার মধ্যে ওদের দেখা। অনুবাদ বলল, “কাকা, কোথায় চললেন?” হারাধন বর্মণ বলল, ” আমরা কৃষকরা ‘সুন্দর’-এর আয়োজন করি। আমরা সুদৃশ্য ফসল ফলাই, সেই চিত্তাকর্ষক ফসলে মনোরম ফুল ফোটে, সেই শোভাযুক্ত ফুলে মনোহারি প্রজাপতি বসে। আবার আগাছা বিনাশ করে আমরা প্রকৃতিকে সুশ্রী করে সাজিয়ে রাখি। আমি আমার জমিতে রূপের পরিচর্যা করতে যাচ্ছি।” কোদাল কাঁধে নিয়ে হারাধন বর্মণ জমির দিকে চলে গেল। ধানশ্রী বলল, ” অনুবাদ, সুন্দর মনের গ্রামের এই লোকগুলোকে আমাদের আসল পরিচয় দেওয়া উচিত।” অনুবাদ বলল,”হ্যাঁ, অবস্থা বুঝে অবশ্যই একদিন আমাদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করব।”
ধানশ্রী আর অনুবাদ আবার চলতে লাগল। যেতে যেতে অনুবাদ বলল,” ধানশ্রী, তোমার মনে পড়ে আমাদের প্রেমের শুরুর কথা। ধানশ্রী বলল, “হ্যাঁ,মনে পড়ে।” অনুবাদ বলল,” তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার পর তুমি ‘না’ বলায় আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আর সেই জন্য আমি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম।” ধানশ্রী বলল,” আমি তোমাকে প্রথম দিন দেখেই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।” অনুবাদ বলল,” আমি দোতলা শপিং-মল থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলাম। সিঁড়িতে তেমন ভিড় ছিল না। তুমি তোমার বান্ধবীর সাথে শপিং-মলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলে। তুমি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিলে। আমি তোমার চাহনিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। উথালপাথাল শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার মধ্যে। আমিও তোমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। চোখে চোখ রেখে আমি নিচে নামছিলাম আর তুমি চোখে চোখ রেখে ওপরে উঠছিলে। কাছাকাছি আসতে তুমি খিলখিল করে হেসে উঠেছিলে। তোমার হাসিতে আমার পা হড়কে গিয়েছিল। আমি সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পায়ে লেগেছিল। তুমি আমার কাছে এসে বলেছিল, “এই যে শুনুন, রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে মেয়েদের দিকে অমন তাকান কেন? মেয়েদের দিকে না তাকালে বুঝি ভাত হজম হয় না। চোখ দুটোকে সামলে রাখুন।” আমি তোমার কথার জবাব দিতে পারিনি। তোমার দিকে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম।”
অনুবাদ বলতে থাকল,” তারপর চুপিচুপি আমি তোমার পিছু নিয়েছিলাম। তোমার বাড়ি চিনেছিলাম। তারপর থেকে আমি প্রতিদিন তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বাইক নিয়ে যেতাম। তোমাদের বাড়ির দিকে আমি তাকাতাম। তুমি তোমাদের দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমাকে দেখে তুমি একটা ‘হাসি” দিতে। হাসি আর স্বপ্ন গভীর ভাবে জড়িত। মেয়েদের-হাসি দেখে ছেলেরা শুধু স্বপ্ন দেখে, কেবল স্বপ্ন বোনে। আমি তোমার স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
একদিন আমি তোমার সেই শপিং-মলের বান্ধবীর মারফত তোমার কাছে আমার প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। তুমি ‘না’ করে দিয়েছিলে।” ধানশ্রী বলল, “তুমি তোমার প্রেমের প্রস্তাব অন্য কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছিলে, তাই আমি তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কারণ, আমি মনে করতাম, যে-ব্যক্তি নিজের প্রেমের প্রস্তাব নিজে দিতে পারে না, সে ভীরু। সে প্রেম করার উপযুক্ত নয়। শহরে ‘পুষ্পমেলা’ চলছিল। পুষ্পমেলাতে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সেই পুষ্পমেলাতে তুমি একটি লাল-গোলাপ ফুল আমার দিকে এগিয়ে ধরে আমাকে বলেছিলে, “আবৃত্তি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।” তুমি তোমার প্রেমের প্রস্তাব নিজে দেওয়ায় আমি তোমার গোলাপ ফুলটি হাতে নিয়ে বলেছিলাম, “সংকলন, আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব খুব ভালোবাসি। ” আমরা দু’জনে গভীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।”
অনুবাদ বলল, “আমাদের প্রেমের কথা আমাদের দুই পরিবার জানতে পেরেছিল। তোমাদের পরিবারের আভিজাত্য আর আমাদের পরিবারের আভিজাত্য মিল খাচ্ছিল না। আভিজাত্যের অমিলের কারণে তোমার বাবা-মা ও আমার বাবা-মা কেউই আমাদের প্রেমকে মানতে চাইছিল না, আমাদের ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিচ্ছিল না।”
হাঁটতে হাঁটতে ধানশ্রী ও অনুবাদ শমিবৃক্ষের কাছে পৌঁছে গেল। শমিবৃক্ষের গাছের কোটরের দিকে তাকাল। অনুবাদ বলল, ” পাখি ও পাখির বাচ্চা দুটো বোধহয় এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ” ধানশ্রী বলল,” আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।” অনুবাদ বলল, “সূর্যের আলো ওদের বাসায় পড়লে রোদের স্পর্শে ওরা নিশ্চয় জেগে উঠবে। সূর্য এখনও ওঠেনি। সূর্য ওঠা অবধি অপেক্ষা করা যাক।” ধানশ্রী বলল, “ঠিক আছে।
আমি চাইছি সূর্য তাড়াতাড়ি উঠুক।”
অল্প সময়ের মধ্যে সূর্য উঠতে লাগল। গোলাকার সূর্যের লাল আভাতে ভরে গেল আকাশ। সূর্যের মায়াময়, নির্মল আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। চারদিক মনোমুগ্ধকর আলোতে ভরে গেল। সূর্য ওঠার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল ধানশ্রী ও অনুবাদের। বৈরহাট্টার মাটিতে অপুর্ব সূর্যোদয় দেখে মন ভরে গেল তাদের। সূর্যের আলোর স্পর্শে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল প্রকৃতি, জেগে উঠল পৃথিবী। সূর্যালোক এসে পড়ল শমিবৃক্ষের ওপর। সূর্যের আলো পড়ল শমিবৃক্ষের কোটরের ভেতরে থাকা পাখির বাসার ওপর। কোটরের দিকে তাকিয়ে অনুবাদ বলল, ” ধানশ্রী, দেখো, দেখো। রোদ্দুরের পরশে পাখি আর পাখির বাচ্চা দুটো ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। পাখি আর পাখির বাচ্চা দুটোর মুখ ও ঠোঁট দেখা যাচ্ছে। ধানশ্রী বলল, “আরে, তাই তো! তাই তো! ওদের ঘুম ভেঙেছে।”
তিন.
অনুবাদ ও ধানশ্রী বৈরহাট্টা বাসস্ট্যান্ডে সকাল আটটায় দু’জনে দুটো ব্যাগ হাতে নিয়ে বাস থেকে নেমেছিল। ধানশ্রীর পরনে লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ। সিঁথিতে ও কপালে লাল সিঁদুর। বব কাট ছোট চুল। চুলে বাদামি রং করা। অনুবাদের পরনে আকাশি রঙের জিন্সের প্যান্ট ও লাল রঙের জামা। স্কয়ার–ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। ক্লাসিক কাট চুল। দাড়ি ও চুলে বাদামি রং করা। অনুবাদের বয়স সাতাশ আঠাশ বছর হবে আর ধানশ্রীর বয়স হবে তেইশ–চব্বিশ বছর। অনুবাদ ও ধানশ্রী দু’জনে খুবই সুন্দর দেখতে।
বাস চলে গিয়েছিল। বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। অনুবাদ বলেছিল, “ধানশ্রী, চলো, একটু চা-বিস্কুট খাই।” ধানশ্রী বলেছিল, ” চলো, আমারও চা খেতে ইচ্ছে করছে।” বাস স্ট্যান্ড থেকে কিছুটা দূরে একটা চায়ের দোকান। অনুবাদ ও ধানুশ্রী ব্যাগ হাতে চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসেছিল। চা খেতে খেতে অনুবাদ চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছিল, “দাদা, এই স্থানটার নাম কী?” দোকানদার জানিয়েছিল, “বৈরহাট্টা।” “কোন জেলায় পড়ে?” ধানশ্রী জিজ্ঞেস করেছিল। দোকানদার জানিয়েছিল, “দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা।” অনুবাদ বলেছিল, “দাদা, আমার নাম অনুবাদ আর আমার স্ত্রীর নাম ধানশ্রী। আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা। বাড়ি থেকে পালিয়ে মন্দিরে বিয়ে করেছি। আমরা দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা বেশ কিছু বছর এই জায়গায় আত্মগোপন করে থাকব। দাদা, এখানে কি একটা ঘর-ভাড়া পাওয়া যাবে?”
চায়ের দোকানের প্রশ্ন করেছিল, “আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? চায়ে চুমুক দিতে দিতে অনুবাদ জানিয়েছিল, “আমরা দু’জনেই আলিপুরদুয়ার জেলা থেকে এসেছি। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি।”
এরপর ধানশ্রী বলেছিল, ” আমাদের দু’জনের বাবা-মা আমাদের ভালোবাসাতে ভীষণ অসম্মতি ছিল। অবশেষে আমরা দু’জনে বাড়ি থেকে পালিয়ে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেছি। তারপর বাস পরিবর্তন করে পালিয়ে পালিয়ে নানা জায়গায় যাওয়ার পর এই অচেনা, অজানা এই স্থানটার প্রকৃতি আমাদের পছন্দ হয়। কন্ডাক্টরকে বলেছিলাম, “দাদা, আমরা এই জায়গায় নামব।” কন্ডাক্টর ভাড়া কেটে নিয়ে আমাদের এখানকার বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়েছিল। শহর থেকে অনেকটা দূরে ভেতরের এই গ্রামে আমাদের কেউ সন্ধান পাবে না, খোঁজ পাবে না। ” ধানশ্রী দোকানদারকে বলেছিল, ” আমাদের দু”জনের বাবা-মা খুব প্রভাবশালী। প্রচুর ক্ষমতা। বহু বড় বড় লোকের সাথে তাদের পরিচয়। আমরা এই গ্রামে বেশ কিছু বছর লুকিয়ে কাটাব, এই স্থানে আমরা আত্মগোপন করে থাকব।”
চায়ের দোকানদার বাইরে চলে গিয়েছিল। অনুবাদ ও ধানশ্রী বেঞ্চিতে বসেছিল।
কিছুক্ষণ পর চায়ের দোকানদার কিছু যুবক ছেলেদের সাথে নিয়ে ফিরে এসেছিল। একটি যুবক ছেলে অনুবাদ এবং ধানশ্রীকে বলেছিল, ” আমি এখানকার একমাত্র ক্লাব ‘নবীন সংঘ’ এর সম্পাদক। আমরা আপনাদের প্রেমে আন্তরিকভাবে সাহায্য করব। আপনাদের বিনা ভাড়ায় যতদিন খুশি থাকার ব্যবস্থা করে দেব এবং আপনাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেব। আপনাদের সম্মতি ছাড়া কেউ আপনাদের এখান থেকে জোর করে নিয়ে যেতে পারবে না।”
যখন ধানশ্রী বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিল, তখন তার পরনে ছিল বেগুনি রঙের চুড়িদার ও গোলাপি রঙের ওড়না। আর অনুবাদ যে মুহূর্তে বাড়ি থেকে গোপনে বেরিয়েছিল, তখন তার গায়ে ছিল খুব সাধারন কমলা রঙের জামা ও খয়েরি রঙের প্যান্ট। মুখে ছিল একগাল দাড়ি। মাথা ভর্তি চুল। তাদের কাছে মোবাইল ছিল না। মোবাইলের মাধ্যমে তাদের অবস্থান কেউ যাতে শনাক্ত করতে না পারে, সেই জন্য তারা মোবাইল সাথে রাখেনি, মোবাইল নিয়ে আসেনি।
মন্দিরে বিয়ে করার পর ধানশ্রী পরেছিল নতুন কেনা লালশাড়ি ও লাল ব্লাউজ । রূপ পরিবর্তন করার জন্য বিউটি পার্লারে গিয়ে ধানশ্রী তার বেশ লম্বা মাথার চুল ছোট করে কেটে বব কাট করেছিল। চুলে বাদামি রং করেছিল। অনুবাদ পরেছিল নতুন কেনা আকাশি রঙের জিন্সের প্যান্ট ও লাল জামা। বিউটি পার্লারে স্কয়ার ফ্রেঞ্চ-কাট করে দাড়ি কেটেছিল। ক্লাসিক কাট চুল বানিয়েছিল। দাড়ি ও চুলে বাদামি রং করেছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার সময় গায়ে পরে-আসা পোশাকগুলো দু’জনে তাদের একটা ব্যাগে বেশ ভালো করে ভরেছিল। ধানশ্রীকে দেখে অনুবাদ বলেছিল, “ধানশ্রী, তোমাকে মোটেই চেনা যাচ্ছে না।” ধানশ্রী বলেছিল, “অনুবাদ, তোমাকেও একদম অচেনা লাগছে।”
দু’জনে নিজেদের নাম পালটে ফেলেছিল। ধানশ্রীর আসল নাম ছিল আবৃত্তি আর অনুবাদের প্রকৃত নাম ছিল সংকলন। ছদ্মবেশ নেওয়ার পর সংকলন হয়েছিল ‘অনুবাদ’ আর আবৃত্তি হয়েছিল ‘ধানশ্রী’। তাদের দু’জনেরই বাড়ি কোচবিহার জেলায় হলেও তারা লোককে বলবে যে, তাদের বাড়ি আলিপুরদুয়ার জেলায়।
এভাবে অনুবাদ এবং ধানশ্রী ছদ্মবেশ ও ছদ্মনাম নিয়ে বাইরে পালিয়ে পালিয়ে চলছিল এবং শেষে বৈরহাট্টার মাটিতে পালিয়ে এসে পা দিয়েছিল।
পাশাপাশি দুটো ঘর। একটি বড় শোওয়ার ঘর, অপরটি রান্নাঘর। ঘর দু’টির দেওয়াল পাকা। পাঁচ ইঞ্চির ইটের গাঁথনি। শোওয়ার ঘরটির ভেতরটা সাদা রং করা। বাইরের দিক বেগুনি রং করা। দু’টি ঘরের মেঝে পাকা। ওপরে টিনের চার চালা। টিনের নিচে বাঁশের চাটাই দেওয়া। ঘরের সামনে নীল রং করা পাকা বারান্দা। মাটির প্রশস্ত উঠোন। ঘরের চার পাশ ও উঠোন পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। একটি সদর দরজা।
এটি বিরেন সরকার নামে গ্রামের এক লোকের অতিরিক্ত একটি থাকার ঘর। পাশেই বিরেন সরকার এমন ধরনের এক পাকা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকে।বিরেন সরকারের অতিরিক্ত থাকার ঘরেই ধানশ্রী ও অনুবাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
বিরেন সরকার বলেছিল, “ঈশ্বর পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছিল মূলত তিনটি কারণে। এক, পৃথিবীতে প্রাণীজগত, উদ্ভিদ জগত, জড় জগতের দেখভাল করার জন্য। দুই, উন্নত মস্তিষ্কের মানুষের মারফত ঈশ্বরের অস্তিত্বের জানান দিতে। তিন, ‘প্রেম’-এর সাথে পৃথিবীর পরিচয় ঘটাতে, পৃথিবীতে ‘ভালোবাসা’-এর উপস্থিতি জানাতে । আপনারা আমার এই বাড়িতে যতদিন খুশি থাকুন। কোনও রকম ভাড়া দিতে হবে না। কোনও বিদ্যুত বিল দিতে হবে না। রান্নার জন্য গ্যাস-ওভেনের ব্যবস্থা করে দেব আমি। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।”
রাতের বেলা। ধানশ্রী ঘর গোছাচ্ছিল। ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করছিল। ব্যাগের একদম নিচ থেকে বের হয়ে এসেছিল তাদের বাড়ি থেকে পালানোর পোশাকগুলো। ধানশ্রী বলেছিল, “অনুবাদ, এই পোশাকগুলো আমাদের কাছে রাখা ঠিক হবে না। অন্য কারওর কাছে রাখাটাও সঠিক কাজ হবে না। আবার পুড়িয়ে ফেলা বা বাইরে কোথাও ঝোপঝাড়ে ফেলে দেওয়া হলে সেটা আমাদের প্রেমকে চরম অসম্মান জানানো হবে।”
কী করা যায়? কোথায় রাখা যায়? অনুবাদ বলে উঠেছিল, “আচ্ছা,পলিথিন ব্যাগে ভরে ভালো করে বেঁধে গাছের কোটরে রাখলে কেমন হয়? এতে কেউ এগুলো দেখতেও পাবে না আবার পোশাকগুলোও ভালো থাকবে।” ধানশ্রী বলে উঠেছিল, “ঠিক বলেছ। একদম ঠিক বলেছ।”
পরের দিন তারা কোটরের খোঁজে ঘুরতে বেরিয়েছিল। নজর রাখতে- রাখতে তারা একটি গাছের কোটরের সন্ধান পেয়েছিল। তাদের ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাছের কোটর। মাঝারি উচ্চতার গাছ। আশপাশে বাড়ি-ঘর নেই। ফাঁকা জায়গা। রাতের বেলা চুপিসারে দু’জনে এই গাছটির কাছে এসেছিল। অনুবাদ গাছটিতে উঠে পলিথিন ব্যাগে মোড়া তাদের পোশাকগুলো কোটরের ভেতর সযত্নে রেখেছিল। বাইরে থেকে পোশাকগুলো দেখা যাচ্ছিল না।
পরদিন তারা জানতে পেরেছিল, গাছটির নাম শমিবৃক্ষ। কোটরের অপর পাশে গাছটির সামনের দিকে এসে তারা দেখেছিল, গাছটির নিচে একটি ছোট্ট সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ছিল – ‘শমিবৃক্ষ’। পাশে একটি সিমেন্টের ফলকে ছিল শমিবৃক্ষটি সম্পর্কে কিছু লেখা।
পাঞ্জাবি পরে মাথায় ছাতা দিয়ে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর বয়সি একটি লোক কিছুটা দূর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। অনুবাদ লোকটিকে ডেকেছিল, “কাকা, আমাদের কাছে একটু আসবেন?” লোকটি অনুবাদ ও ধানশ্রীর কাছে এসেছিল। অনুবাদ জিজ্ঞেস করেছিল,”কাকা,আপনি কি খুব ব্যস্ত?”
লোকটি বলেছিল, “না, বলুন।” অনুবাদ বলেছিল, “কাকা, আপনি কি এই বৈরহাট্টা গ্রামের বাসিন্দা?” লোকটি বলেছিল,” হ্যাঁ। আমার নাম হারাধন বর্মণ। এ গ্রামেই আমার বাড়ি। কী ব্যাপার বলুন?” অনুবাদ জিজ্ঞেস করেছিল, “কাকা, এ গাছটির নিচে ছোট সাইন বোর্ডে ‘শমিবৃক্ষ’ কথাটি লেখা কেন? শমিবৃক্ষ কী?” হারাধন বর্মণ ছাতা বন্ধ করেছিল। পাশে ছিল সিমেন্টের তৈরি বসার বেঞ্চ। হারাধন বর্মণ বেঞ্চের এক দিকে বসেছিল। অপর দিকে বসেছিল অনুবাদ ও ধানশ্রী। হারাধন বর্মণ বলেছিল বিস্তারিতভাবে। হারাধন বর্মণের কাছে অনুবাদ ও ধানশ্রী জানতে পেরেছিল, এই ‘বৈরহাট্টা’ গ্রামটি মহাভারতের স্মৃতি জড়ানো গ্রাম। বিরাট রাজার রাজত্বে ছিল এই বৈরহাট্টা গ্রাম আর অশ্বত্থ গাছের পাতার মতো পাতা বিশিষ্ট এই গাছটি হলো মহাভারতের শমিবৃক্ষ। এখানকার সকলে মানে, মহাভারতের বিরাট রাজার ‘বিরাট’ শব্দ থেকে ‘বৈরহাট্টা’ কথাটি এসেছে। এই শমিবৃক্ষটি আনুমানিক পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। মূল শমিবৃক্ষ থেকে এখানেই একটি করে নতুন নতুন গাছের জন্ম নিতে নিতে বর্তমান শমিবৃক্ষের জন্ম হয়েছে। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের দিনে গাছটিকে ঘিরে মেলা বসে। এখানকার লোকেরা গাছটিকে পুজো করে। সারা ভারতের মধ্যে কেবলমাত্র একটিই এই গাছ আছে। গাছটি পর্ণমোচী গাছ। শীতের সময় গাছের পাতা ঝরে যায়, বসন্তকালে পাতা নতুন করে জন্মায়। ফুলগুলি খুবই সুগন্ধিযুক্ত।
মহাভারতে যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হেরে গেলে পঞ্চপান্ডবদের বারো বছরের বনবাস ও এক বছরে অজ্ঞাতবাস হয়। এক বছর অজ্ঞাতবাস চলাকালীন কৌরবরা যদি পঞ্চপান্ডবদের সন্ধান পায়, পান্ডবদের চিনে ফেলে, তাহলে পঞ্চপান্ডবদের আরও বারো বছর বনবাসে কাটাতে হবে। পাণ্ডবরা ঠিক করেছিল, তারা বিরাট রাজার রাজত্বে অজ্ঞতাবাস কাটাবে। বিরাট রাজার রাজত্ব কেউ যাতে তাদের শনাক্ত করতে না পারে, তাই পঞ্চপান্ডবরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র, গান্ডীব বিরাট রাজার রাজত্বে অবস্থিত শমিবৃক্ষ নামক গাছের কোটরে লুকিয়ে রেখেছিল। পান্ডবরা ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল এবং ছদ্মনাম নিয়ে তারা বিরাট রাজার রাজত্বে অজ্ঞাতবাস শুরু করেছিল। মহাভারতের পঞ্চপান্ডবদের গান্ডীব, অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা শমিবৃক্ষটি হলো সাইন বোর্ড লাগানো এই শমিবৃক্ষ।
শমিবৃক্ষের সামনের দিকে ছোট মন্দির দেখিয়ে হারাধন বর্মণ বলেছিল,”এই মন্দিরে রয়েছে পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর মূর্তি।
অনুবাদ ও ধানশ্রী প্রায়ই বিকেলের দিকে ঘুরতে-ঘুরতে এই শমিবৃক্ষের নিচে আসত। গাছটির নিচে বসত। দু’জনে গল্প করত। ধানশ্রীর কোলে মাথা দিয়ে অনুবাদ শুয়ে থাকত। একদিন অনুবাদ লক্ষ্য করেছিল, শমিবৃক্ষটির যে-কোটরে তারা তাদের পোশাক রেখেছিল, সেই কোটরে একটি পাখি বাসা করেছে। ভালোভাবে খেয়াল করে ধানশ্রী বুঝেছিল, গাছের কোটরটিতে একটি ঝুঁটি-শালিক বাসা বেঁধেছে। তাদের পোশাক রাখা কোটরটির ভেতর পাখির বাসা করা দেখে আনন্দে মন ভরে উঠেছিল ধানশ্রীর। খুশির জোয়ার বইছিল অনুবাদের শরীরের মধ্যেও।
ঝুঁটি-শালিক পাখিটির বাসা দেখার জন্য তারা ঘনঘন আসত শমিবৃক্ষের তলায়। তাকিয়ে থাকত পাখিটির বাসার দিকে। প্রশান্তিতে ভরে উঠত তাদের চোখ-মুখ। ভীষণ তৃপ্তি অনুভব করত তারা।
একদিন ধানশ্রী খেয়াল করেছিল, কোটরের ঝুঁটি-শালিক পাখিটি কোঠরের মধ্যে বাচ্চা দিয়েছে। পাখিটির বাচ্চাগুলোর চিঁচিঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পাখিটি উড়ে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করে আনছিল আর সেই খাবার নিজের মুখে রেখে নরম করে বাচ্চাদের খাইয়ে দিচ্ছিল। তাদের পোশাক-রাখা কোটরের মধ্যে ঝুঁটি শালিক পাখির বাচ্চা হওয়ায় ধানশ্রীর মনে খুশি আর খুশি। আনন্দে মাতোয়ারা সে। ধানশ্রী নাচ জানত। ধানশ্রী খুবই আনন্দে শমিবৃক্ষের নিচে ‘কথাকলি’ নাচ নেচেছিল আর অনুবাদ তাল দিয়েছিল।
চার.
ধানশ্রী এবং অনুবাদ দেখল, ঝুঁটি-শালিকটি টুক করে একটি ছোট্ট লাফ দিয়ে বাসার কিনারায় এসে দাঁড়াল। ঝুঁটি-শালিকটি বাইরের দিকে দেখল। এদিক-ওদিক, ওপর -নিচ সব দিকে বেশ ভালো করে দেখল। তারপর আবার বাসায় নেমে গেল। অনুবাদ বলল,” বুঝলে ধানশ্রী, ঝুঁটি–শালিকটি বাইরের পরিবেশ সরজমিনে দেখল। আজকের পরিবেশ আকাশে ওড়ার পক্ষে নিরাপদ কিনা সেটা পুঙ্খানপুঙ্খভাবে বুঝল। ওড়াতে কোনও রকম ঝুঁকি আছে কিনা তা সুক্ষ্মরূপে মাপল। অল্পক্ষণের মধ্যে পাখির বাচ্চা দুটো উড়ান দেবে।”
ঝুঁটি-শালিকটি বাসা থেকে উড়ে বাইরে গেল। অল্প সময়ের মধ্যে খাবার সংগ্রহ করে বাসায় ফিরে এল। খাবারগুলো মুখে মধ্যে রেখে নরম করে বাচ্চাদের খাওয়াল। পাখিটি বেশ কয়েকবার বাইরে গেল, খাবার নিয়ে এসে বাচ্চাদের নরম করে খাওয়াল। বাচ্চারা দেহে শক্তি অনুভব করল। ডানা মেলে উড়তে গেলে দেহে শক্তি লাগে। শরীরে আকাশে ওড়ার শক্তি লাগে। ডানা দুটো সবল লাগে, সতেজ লাগে। ডানায় কোনও রকম দুর্বলতা থাকলে যে-কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
পাখির বাচ্চা দুটো ওড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। বাসার মধ্যে বাচ্চা দুটো ডানা মেলে ছোট্ট করে উড়ে এদিক থেকে ওদিক গেল। আবার টুক করে উড়ে বাসার ওপ্রান্ত থেকে এপ্রান্তে এল। এভাবে বাসার ভেতর একধার থেকে অপর ধার বেশ কিছুক্ষণ ওড়ার অনুশীলন করল তারা। তারপর বাচ্চা দুটো বাসার কিনারায় এসে দাঁড়াল। তাদের ডানা দুটো নাড়াল। বোধহয় তাদের ডানা দুটোর কার্যকারিতা ঠিক আছে কিনা পরখ করল। নিচের দিকে হেলল তারা। মনে হয়, নিচের দিকে তাকিয়ে উচ্চতা মাপল। ডানা মেলে সামনের দিকে ঝুঁকল দু’জনে। ওড়ার আগে পৃথিবীকে ভালোভাবে দেখছিল আর বুকে সাহস সঞ্চয় করছিল দু’জন।
পাখিটি আবার উড়ে বাইরে গেল। খাবার সংগ্রহ করে ফিরে এল। বাচ্চা দুটো বাসার মধ্যে গেল। বাচ্চাদের যথেষ্ট পরিমাণ খাবার খাওয়াতে পাখিটি আবার খাবারগুলো মুখের মধ্যে রেখে নরম করে তার বাচ্চাদের আদর করে সেই খাবার খাওয়াল।
পাখির বাচ্চা দু’টি আবার টুক করে লাফ দিয়ে বাসার কিনারায় এসে দাঁড়াল। বাইরের চারপাশ ভালো করে দেখতে লাগল। সম্পূর্ণ নিজের ভরসায় ডানার সাহায্যে জীবনের প্রথম আকাশে ওড়া অত সহজ কথা নয়। একটু অসতর্ক হলে মৃত্যূ। আকাশে উড়তে গিয়ে নানা রকম বিপদ আসতে পারে! বাসার মধ্যে গিয়ে আবার ওড়ার অনুশীলন করল বাচ্চা দু’টি।
বাসার মধ্যে পাখার সাহায্যে কিছুক্ষণ উড়ে বাচ্চা দু’টি বাসার কিনারায় এসে দাঁড়াল। কিনারায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল বাচ্চা দুটো। ধানশ্রী উত্তেজনায় বলে উঠল,” এবার উড়বে বোধহয় বাচ্চা দুটো।” অনুবাদ বলে উঠল,” আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।” বাচ্চা দুটো আবার বাসার মধ্যে নেমে গেল। আবার বাসার ধারে এসে দাঁড়াল। ধানশ্রী বলে উঠল, “আজ ওরা উড়বে। প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা।” অনুবাদ এবং ধানশ্রীর দৃষ্টি বাচ্চা দুটোর দিকে। চোখের পলক পড়ছিল না। জ্যোতির্বিদরা কোনও অজানা গ্রহের সন্ধান পেলে যেমন দূরবীন যন্ত্রে অপলক ভাবে তাকিয়ে তাকে, তেমনই তাকিয়ে ছিল ওরা দু’জন পাখিটার বাচ্চার দিকে। পাখিটা বাচ্চা আবার বাসার মধ্যে নেমে গেল। ঠোঁট দিয়ে ডানা দুটো চুলকাল। গা ঝাড়া দিল। বাসার কিনারায় এসে দাঁড়াল। ডানা দু’টি নাড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়।
পাঁচ.
লাফ দিল পাখির বাচ্চা দুটৌ। বাতাসে উড়তে লাগল। আনন্দে চিৎকার করে ধানশ্রী বলে উঠল, “ওই তো বাচ্চা দুটো উড়ছে। কি সুন্দর উড়ছে! নিজের ডানার সাহায্যে জীবনে প্রথম উড়ছে ওরা। উফ, কি সুখ! পাখির বাচ্চার প্রথম-ওড়া দেখতে পেলাম। কি সুন্দর! অপুর্ব! আমার দেহ-মন-প্রাণ ভরে গেল।” অনুবাদ বলল,” বাচ্চা দুটোর ওড়া শুরু হলো। ওরা এখন সারা জীবন ধরে উড়বে। স্বাধীনভাবে ওদের ওড়া দেখে আমার দু’চোখ জুড়িয়ে গেল, হৃদয় ভরে গেল।”
ডানায় ফড়ফড় শব্দ করে বাচ্চা দুটো প্রথমে কাছাকাছি ঘুরতে লাগল। তারপর আর একটু দূরে চলে গেল। উন্মুক্ত নীল আকাশ তার উদার হৃদয় খুলে দিয়ে রাখল ওদের জন্য। বাতাস তার মধুর স্পর্শ দিতে লাগল ওদের। গাছের সবুজ পাতা এদিক-ওদিক দুলে ওদের উৎসাহ দিতে লাগল। আকাশের সাদা-সাদা মেঘের মন থেকে বাচ্চা দুটোর জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা ঝরে পড়ছিল। বাচ্চা দুটো আর একটু দূর…আর একটু দূর.. দেখতে দেখতে বহু.. বহুদূর চলে গেল।
ডানা মেলে সারা আকাশ ঘুরে বেড়াতে লাগল বাচ্চা দুটো। উড়ন্ত বাচ্চা দুটোকে দেখে ধানশ্রী আর অনুবাদের মনে অফুরন্ত খুশি।
আনন্দে পাখির বাচ্চা দুটো মুক্ত আকাশে উড়তে-উড়তে এক সময় দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আকাশের বুকে প্রথম ওড়ার পরম খুশি নিয়ে ঝুঁটি–শালিক পাখির বাচ্চা দুটো দূরে কোথাও মিলিয়ে গেল, নিখোঁজ হয়ে গেল, নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
ছয়.
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অনুবাদ বলল,”ধানশ্রী, বাচ্চা দুটো ওড়ার আনন্দে মশগুল। ওরা কখন বাসায় ফিরবে বলা মুশকিল। ওরা এখন উড়বে। চলো,ঘরে ফিরে যাই।”
ধানশ্রী ও অনুবাদ ঘরে ফিরছিল। ধানশ্রীর পেট ব্যথায় টনটন করে উঠল। অনুবাদ বলল, “কী হলো ধানশ্রী?” ধানশ্রী বলল, ” আমার পেট-ব্যথা করছে।” অনুবাদ বলল, “ধানশ্রী, সকালে কিছু খাওনি। খালি পেট । পেট খালি থাকার জন্য পেট ব্যথা করছে। আমাদের তাড়তাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে। বাড়িতে গিয়ে তোমাকে কিছু খেতে হবে। খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিলে আশা করা যায় তোমার পেট ব্যথা সেরে যাবে। চলো, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো।”
ধানশ্রী বলল, ” অনুবাদ, আমার শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। একা একা আমি হাঁটতে পারব না।”
অনুবাদ বলল, ” না খাওয়ার জন্যই তোমার শরীর ক্লান্ত লাগছে। আসার সময় আমি তো খাওয়ার কথা তুলেছিলাম। তখন তুমি কিছু খেয়ে নিলে এমনটা হতো না। ” তারপর অনুবাদ বলল, “ঠিক আছে, আমি তোমাকে দু’হাত দিয়ে ভালোভাবে ধরছি। তোমাকে জোরে যেতে হবে না, ধীরে ধীরে হেঁটে চলো।”
অনুবাদ ধানশ্রীকে দু’হাতে শক্ত করে ধরল। ধানশ্রী পেট চেপে ধরে আস্তে–আস্তে হেঁটে চলল। কিছুটা দূর যাওয়ার পর ধানশ্রী বলল,” অনুবাদ, আমার বমি বমি পাচ্ছে।” বলার সাথে সাথে ধানশ্রী বমি করতে লাগল। খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ধানশ্রী অনুবাদের সহায়তায় ধীরে-ধীরে বাড়ির দিকে চলল।
সাত.
আস্তে হাঁটতে-হাঁটতে ধানশ্রী ও অনুবাদ বাড়ির কাছে পৌঁছল। পেট ব্যথায় ধানশ্রীর চোখ-মুখ লাল । হাত দিয়ে তার পেট ধরা। বমি-বমি ভাব করছিল তার। বাড়ির কাছে পৌঁছতেই আবার বমি করল ধানশ্রী। অনুবাদ ধানশ্রীকে ধরে আস্তে আস্তে খুব সাবধানে সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করাল। উঠোনে পা দিয়ে ধানশ্রী একটা খুঁটি ধরে ঘর খোলার জন্য তার কাছে থাকা চাবিটা অনুবাদকে দিল। অনুবাদ ঘর খোলার জন্য চাবি নিয়ে এগোতেই অনুবাদ ও ধানশ্রী দেখল, প্রথম আকাশে ওড়া শালিক পাখির বাচ্চা দুটো তাদের ঘরের বারান্দায় বসে আছে। ঝুঁটি শালিক পাখিটির বাচ্চা দু’টি তাদের ঘরের নীল রঙের বারান্দায় বসে রয়েছে।
-গোলোকেশ্বর সরকার, গল্পকার
বুনিয়াদপুর, জেলা :দক্ষিন দিনাজপুর,পশ্চিমবঙ্গ ,ভারত