দেশের সংবাদ ফিচার্ড

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণ ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণ ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা

নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ২ ছাত্র প্রতিনিধিসহ ১৩ উপদেষ্টার শপথ গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের তিনদিন পর বৃহস্পতিবার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রা শুরু করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ১৭ সদস্যের নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সবার প্রস্তাব অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁকেসহ তাঁর নেতৃত্বে যাত্রা করতে যাওয়া সরকারের বাকি ১৬ উপদেষ্টাদের মধ্যে ১৩ জনকে শপথ পাঠ করান রাষ্ট্রপতি। বাইরে অবস্থান করায় তিন উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম, চিকিৎসক বিধান রঞ্জন রায় ও সাবেক রাষ্ট্রপতি সুপ্রদীপ চাকমা বৃহস্পতিবার শপথ নিতে পারেননি। তাঁরা ঢাকায় এলেই রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণ করবেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করবেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে মোট ১৩ জন শপথ নিয়েছেন। এর মধ্যে দুজন ছাত্র প্রতিনিধিও রয়েছেন। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথগ্রহণকারীরা হলেনÑ সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান,  জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা- উবিনীগ-এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমির ও সুন্নি দেওবন্দি ইসলামী প-িত ড. আ ফ ম খালিদ হাসান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান বেগম এবং  নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ।

রাত সোয়া ৯টায় বঙ্গভবনে জনকীর্ণ দরবার হলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। শুরুতেই জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর গত কয়েকদিনের আন্দোলনে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। কুরআন তেলাওয়াতের পর শুরু হয় শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা।

দু’পর্বের অনুষ্ঠানে প্রথমেই রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শপথ গ্রহণ শেষে তিনি শপথনামা এবং শপথের গোপন অঙ্গীকারের নথিতে স্বাক্ষর করেন।
শপথ গ্রহণের পর নতুন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতির সঙ্গে করমর্দন করেন। হলভর্তি অতিথিরা হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। দ্বিতীয় পর্বে ১৬ উপদেষ্টাদের মধ্যে মোট ১৩ জন রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণ করেন। অবশিষ্ট তিন উপদেষ্টা ঢাকায় আসলেই রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণ করবেন।

সাড়ে ৯টায় শপথ গ্রহণপর্ব শেষ হলে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে অতিথিদের চা-চক্রে আপ্যায়িত করেন। বঙ্গভবনে যখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান চলছিল, তখন বাইরে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা হাততালি ও স্লোগান দিয়ে সবাইকে স্বাগত জানাতে দেখা যায়।
বঙ্গভবনের দরবার হলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চার শতাধিক প্রতিনিধি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, তিন বাহিনী প্রধান, সাংবাদিক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাড়াও সরকারি ও সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শপথ গ্রহণ শেষে গাড়িতে জাতীয় পতাকা নিয়ে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাগণ।

প্রধান উপদেষ্টা এবং বাকি ১৬ উপদেষ্টারা কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন তা খুব শীঘ্রই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানো হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের আগে বিএনপিসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারীগুলোর পক্ষ থেকে ক্যাবিনেট সচিবের কাছে একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে তারা কোনো তালিকা প্রকাশ করেননি। বিএনপির পক্ষ থেকে পাঠানো তালিকা থেকে কেউ উপদেষ্টা পদে স্থান পেয়েছেন কি না, তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ইরান, আর্জেন্টিনা, ফিলিস্তিন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, শামসুজ্জামান দুদু, আমান উল্লাহ আমান, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, খাইরুল কবীর খোকন, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, তাবিথ আউয়াল, মিজানুর রহমান মিনু, বামপন্থি দলের নেতাদের মধ্যে মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রুহিন হোসেন প্রিন্স, জোনায়েদ সাকি উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, জাসদের আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, ভিপি নুরুল হক নুরু, বিজেপির ব্যারিস্টার আন্দালিব পার্থ প্রমুখ। তবে আওয়ামী লীগের কাউকে দেখা যায়নি। অনুষ্ঠানে প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাড়াও সামরিক-বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ তাঁকে উঞ্চ সংবর্ধনা জানান। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। বিমানবন্দরে নেমে সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমে গুলশানে নিজ বাসভবনে যান। এরপর শপথ নিতে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে যান তিনি।
এর আগে দুপুরে শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তরুণ সমাজকে উদ্দেশ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এই দেশ তোমাদের, এটাকে তোমরা তোমাদের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। আজকে আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করল সেটাকে সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যারা এটাকে সম্ভব করেছেÑ তরুণ সমাজ তাদের প্রতি আমার সমস্ত প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

তারা আমার পাশে আছে। তারা এ দেশকে রক্ষা করেছে, এ দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে এবং এ পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশকে পেলাম সে বাংলাদেশ যেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে পারে, সেটাই আমাদের শপথ। সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই। সরকার বলে একটা জিনিস আছে। কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। নতুন সরকার মানুষের আস্থাভাজন হবে।’
এদিকে, প্যারিস থেকে ঢাকায় ফেরার আগে ব্রিটিশ দৈনিক ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সরকারের প্রতি দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা দরকার। দেশ পুনর্গঠনে আমরা একসঙ্গে কীভাবে কাজ করতে পারি, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে কথা বলব। নতুন নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হতে কাজ করা দরকার।’

প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত রবিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পদত্যাগের পর তিনি ও তাঁর বোন শেখ রেহানা প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্য মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ রবিবারই মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়েছে।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর রবিবার আওয়ামী লীগ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে মঙ্গলবার সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে মঙ্গলবার তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জন সমন্বয়কের চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীব উদ্দীনও উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম চূড়ান্ত করা হয়।
পরে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার দেশে আসবেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হবেন ১৫ জন। হয়তো আরও দু-একজন বাড়তে পারে।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার দাবিতে গত ১ জুলাই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন। ওই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া গুলি, গণগ্রেপ্তার ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের হামলার প্রেক্ষিতে আন্দোলন বেগবান হয় এবং এক পর্যায়ে তা সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায়  সোমবার কার্ফু ভেঙে গণভবন অভিমুখে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামলে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।


এসএস/সিএ
সংবাদটি শেয়ার করুন