বুধবার মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে সংবর্ধনার সময় বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে বিসিবি সভাপতির সঙ্গে আকবর ও তার সতীর্থরা – মাহবুব হোসেন নবীন
বাংলাদেশ বাংলাদেশ, চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন, অভিবাদন অভিবাদন। স্লোগানে মুখর পুরো পথ। মোটরবাইকে শোভাযাত্রা। লাল-সবুজ পতাকার ওড়াউড়ি। পথের ধারে জনসমুদ্র। মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার। মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হলো চ্যাম্পিয়নদের প্রাণ। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা যে উজ্জ্বল তারা হয়ে গেছেন, সে আলোয় আলোকিত হয়েছে ষোলো কোটি মানুষ, আকবর আলীরা দেখলেন দেশে ফিরে, ভালোবাসার স্লোগান শুনে। আবারও অভিবাদন বিশ্বজয়ী প্রিয় সন্তানেরা।
কখনও কখনও বাস্তবতা যে কল্পনাকেও হার মানায়, বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক আকবরের এ উপলব্ধি হলো গতকাল। বিমানবন্দর থেকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আসার পথে যে জনস্রোত দেখেছেন এবং ভালোবাসা পেয়েছেন, তা ছিল তার ও তাদের ধারণার বাইরে। পচেফস্ট্রুমে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তারা ভাবেননি, দেশে এত কিছু অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিমান অবতরণ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বীর ক্রিকেটারদের বরণ করে নিতে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল দেশ। লালগালিচায় পা রেখে ভিআইপি লাউঞ্জে আসেন ক্রিকেটাররা। ফুলের শুভেচ্ছায় সাদর সম্ভাষণ জানানো হয় আকবরদের। গাঁদা ফুলের বৃষ্টিবর্ষণ হয় ক্রিকেটারদের ওপর। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল মালা পরিয়ে ও ফুলের তোড়া দিয়ে তাদের বরণ করে নেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে সোজা বাসে চেপে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আসেন তারা। বিশাল মোটরবাইক শোভাযাত্রা দিয়ে নিয়ে আসা হয় তাদের।
শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সামনে জনতার ঢল নেমেছিল আগে থেকেই। সোনার ছেলেদের অভিবাদন জানান তারা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় বোর্ডরুমে। সেখানে খেলোয়াড়দের সংক্ষিপ্ত ব্রিফ দেন বিসিবি সভাপতি পাপন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মাঠে নামে পুরো দল। কেক কেটে বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করেন পাপন। শত শত দর্শক ভিআইপি গ্যালারি থেকে স্লোগান ধরেন- বাংলাদেশ বাংলাদেশ, চ্যাম্পিয়ন চ্যাম্পিয়ন বলে। অধিনায়ক আকবরকে কেক খাওয়ান বোর্ড সভাপতি। ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরেন তিনি। আনন্দ ধ্বনিতে উত্তাল করেন সমর্থকরা। আতশবাজি পুড়িয়ে উদযাপন শেষ করা হয়। খেলোয়াড়রা চলে যান বোর্ডরুমে। অধিনায়ককে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিসিবি সভাপতি পাপন ও বোর্ড কর্মকর্তারা।
জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে নাজমুল হাসান পাপন ঘোষণা দেন চ্যাম্পিয়নদের এগিয়ে নিতে অনূর্ধ্ব-২১ ইউনিট গড়ে তোলার। বিশ্বকাপ খেলা ১৬ ক্রিকেটারকে রাখা হবে এই বিশেষ ইউনিটে। দুই বছরের চুক্তি পাবেন তারা। যেখানে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, দেশে-বিদেশে সিরিজ খেলার সুযোগ করে দেওয়া হবে এবং মাসে এক লাখ টাকা করে বেতন পাবেন প্রত্যেকে। বিনিময়ে শুধুই ক্রিকেটে ফোকাস করতে হবে চ্যাম্পিয়নদের। পাপন বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক অর্জনই আছে, কোনো অর্জনই ছোট নয়। তবে বিশ্বকাপ জয় সবচেয়ে বড়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সর্বোচ্চ সাফল্য, হোক সেটা অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। চ্যাম্পিয়ন হওয়া যেমন কঠিন, তার চেয়ে বেশি কঠিন ধরে রাখা। এই দলটাকে আমরা ধরে রাখতে চাই। টাকাপয়সা নিয়ে ওদের চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। যত টাকা লাগে, বিসিবি দেবে। ওরা শুধু মনোযোগ দেবে খেলায়। আগামী দুই বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা যেন জাতীয় দলে ঢোকার পথ সহজ করতে পারে।’
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল কয়েক বছর ধরে ভালো ক্রিকেট খেলছে। ২০১৬ সালে দেশের মাটিতে সেমিফাইনাল খেলেছে তারা। তারও আগে কিছু সাফল্য আছে যুবাদের। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বহু ক্রিকেটারই জাতীয় দলে খেলেছেন, কিন্তু বেশিরভাগই ঝরে গেছেন অকালে। পরে আন্তর্জাতিক লেভেলে তারকা হতে পেরেছেন কেবল মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল ও মাহমুদুল্লাহ। মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ, লিটন কুমার দাসরা হতে পারেন আগামীর তারকা। আকবর আলীরাও দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। বিসিবি যেভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলে চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়রা হতে পারেন দেশের ক্রিকেটের মহাতারকা। আকবর প্রতিশ্রুতি দিলেন, সাকিব-তামিমদের পথ ধরে দেশের ক্রিকেট এগিয়ে নেবেন তারা।
বিশ্বকাপ জেতায় ১৬ ক্রিকেটারের ভাগ্য বদলে গেল বলতে হবে। মাশরাফি-সাকিবের মতো যুবারাও তারকা খ্যাতি পেয়ে গেছেন। সাকিবরা যেটা পাননি, তাও বিসিবি দিচ্ছে এই ক্রিকেটারদের আর্থিক নিশ্চয়তা। ভালো খেলতে পারলে, উন্নতির ধারায় থাকলে দুই বছর পর চুক্তি নবায়ন করা হবে বলে জানান বিসিবি সভাপতি। আর নিজেকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে পারলে জাতীয় দলের সিংহদ্বার খোলা থাকছে। জাতীয় দল ও এনসিএলের ক্রিকেটার ছাড়া বিসিবির চুক্তি পাওয়া ক্রিকেটার আকবররাই প্রথম। সেদিক থেকে সৌভাগ্যবান বলতে হবে চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দের।
চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারদের জন্য হয়তো আবারও বড় কিছু অপেক্ষা করছে। সরকারের পক্ষ থেকেও দেওয়া হতে পারে আর্থিক প্রণোদনা। আগামী সপ্তাহে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসংবর্ধনায় ঘোষণা করা হতে পারে নতুন কিছু। যদিও গতকাল পাপন গণসংবর্ধনার তারিখ নিশ্চিত করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় পাওয়ার ওপর তারিখ ঠিক করা হবে। এই ফাঁকে পরিবারের কাছ থেকে ঘুরে আসার সুযোগ পাচ্ছেন চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়রা। ঢাকায় যাদের বাসা, তারা গতকালই চলে গেছেন পরিবারের কাছে। বাকিরা আজ বাড়ি ফিরবেন। শিকড়ে অপেক্ষায় আছে তাদের পরিবার-আত্মীয়-পরিজন। সেখানেও হয়তো সংবর্ধনা দেওয়া হতে পারে চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারদের। অভিবাদন প্রিয় সন্তানেরা অভিবাদন!