আজ ভাষাসৈনিক জননেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস এর জন্মবার্ষিকী
দীর্ঘ ৭১ বছরেও পাননি ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি
অনেকটা নিরবেই চলে যায় জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী ॥ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের দাবি এলাকাবাসীর
রাফিক, বরকত, জব্বার, সালামের সহযোদ্ধা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেপথ্য নায়ক, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গণতন্ত্র, ন্যায়-নীষ্ঠা, ত্যাগ সততা ও নিয়মানুবর্তিতার মানসপুত্র, মৌলভীবাজার জেলার গরীব দু:খী ও সাধারণ মানুষের অন্তরের প্রিয়পাত্র কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গলের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাবেক অন্যতম সদস্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী ছিলেন মোহাম্মদ ইলিয়াস। ভাষা সংগ্রামের দীর্ঘ ৭১ বছর পার হলেও ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি পাননি মোহাম্মদ ইলিয়াস।
“জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে”- এই জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যখানে মানুষের জীবন যাপন ও কর্মের উপরই নির্ভর করবে লোকায়িত ব্যাক্তিকে কতকাল স্মরনে রাখবে মানুষ। এই বিচারে মোহাম্মদ ইলিয়াসকে মনে রাখার কথা ছিল বহুকাল কিন্তু আজ অনেকটা নিরবে নিভৃতেই চলে যায় তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। যিনি সমস্ত জীবন শুধু দিয়েই গেছেন, নেননি কিছুই। ৩৫ বছর আগে তার অকাল প্রয়ানের পর সবাই কতইনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে কি প্রতিফলিত হয়েছে? আজও কেউ ভূলে, কেউ ভূলেনি ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষকে। যদিও স্থানীয় আওয়ামীলীগের কোন কোন সভা-সমাবেশে নেতাকর্মীরা তাঁকে মূহুর্তকাল স্মরণ করে।
জম্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার ছিল এক বর্ণাঢ্য জীবন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মহান ব্রত নিয়েই ছিল তার সুদীর্ঘ পথ চলা। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বীর সৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়ক, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেতা, শুষনমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় দেশ বরেন্য অকুতভয় সাহসী সংগঠক। মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯২৯ সালের ১লা অক্টোবর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কুশালপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়ায় অভাব-অনটন, সুখ-দুঃখ সবই সয়ে গেছেন নিরবে। যৌবনে সাহসী সৈনিক, সফল সংগঠক জননেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন।
তৎকালশীন বেঙ্গল মেডিকেল সার্ভিসের সদস্য খান বাহাদুর ডাঃ বজলুল হাসানের (১৮৮৮-১৯৫৩) ভ্রাতুস্পুত্র এবং মৌলভী মোহাম্মদ তাহির ও জোবায়দা খাতুনের পুত্র মোহাদ্মদ ইলিয়াস। তিনি শৈশবে যখন লেখাপড়া শুরু করেন তখন মফস্বলে লেখাপড়ার তেমন জোর ছিলনা, কিন্তু তাঁর পিতার আগ্রহে তান স্থানীয় কমলগঞ্জ প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হন। শৈশবে মোহাম্মদ ইলিয়াসের মাঝে লেখাপড়ার প্রবল ঝোঁক দেখা যায়। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রাইমারী উত্তীর্র্ণ হলে কমলগঞ্জ এম, ই, স্কুলে ভর্তি হন।
পরে মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুনাম অজর্ন করেন। ছাত্র জীবনে তিনি সমগ্র আসাম বেঙ্গল স্টার মার্কসহ ১ম বিভাগে (৪র্থ স্থানে) মেট্রিকুলেশন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্টার মার্কসহ ১ম বিভাগে (৬ষ্ট স্থানে) আই,এস,সি, পাস করে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংক ও পরিসংখ্যানে ডাবল অনার্স নিয়ে স্মাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। বায়ান্নোর ভাষাসৈনিক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তাঁর রাজনীতি শুরু।
মোহাম্মদ তোয়ারা, শহীদুল্লা কায়সার, নাদেরা বেগম, গাজীউল হকসহ আরও অনেকের সংস্পর্শে এসে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৫২সালে ভাষা আন্দোলনে ছিলেন ছালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের সহযোদ্ধা। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ায় প্রায় একদশক আত্মগোপনে থেকেও মেহনতী মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৫৪ সালে ৯২‘ক’ ধারায় এবং ১৯৫৮সালে আয়ুবের সাময়িক শাসন আইনে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে ৬২ সাল পর্যন্ত তাকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিল। ১৯৬৮সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে আওয়ামীলীগে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন।
৬৯’এর জাগরন ও ৭০’এর নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্থানের এম,এন,এ নির্বাচিত হন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছিল রাজনগর, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার ও কমলগঞ্জ। ১৯৭১সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সিলেট অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে তার ছিল বীরত্বপূর্ন ভূমিকা। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধেও পূর্বাঞ্চলীয় ৪নং সেক্টরের রাজনৈতীক সমন্বয়ক। তার আদর্শ, নিষ্টা ও সততার জন্য তিনি ১৯৭৩, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৬ সালে পর পর তিন বার বিপুল ভোটে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
শিক্ষানুরাগী হিসাবে ও তার রয়েছে অনেক অবদান। তিনি ছিলেন কমলগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। একজন দক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসাবে চা বাগান কর্মচারী ট্রেড ইনিয়নের সম্পাদক, সভাপতি ও উপদেষ্টা পদে যুক্ত ছিলেন বেশ কিছুদিন। ট্রেড ইউনিয়ন করতে গিয়ে চা শ্রমিকদের সুখে দুঃখে তিনি ছিলেন তাদের প্রাণ। বঙ্গবন্ধু আদর্শের ধারক ও বাহক হয়ে তিনি আদর্শের হাল ধরেছিলেন মুক্ত হাতে। তাইতো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের পার্লামেন্টারী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এমপি হয়েও তার জীবন যাপন ছিল আতি সাধারন। তিনি নিজ হাতে ব্যাগভর্ত্তি বাজার নিয়ে পায়ে হেটে বাসায় ফিরতেন। তখনকার দিনে আজকের মত রাজকীয়সব গাড়ি না থাকলেও শহরের রিকসা পাওয়া যেত। এলাকায় জনশ্রুতি আছে তিনি বাজার হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরিচিত জনকে বলতেন আমি এমপি হয়েছি খামখাই, আমার ডাকে একটি রিকসা ও আসেনা। ব্যক্তি জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দকে উপো করে জনতার কাতারে থেকে মেহনতি মানুষের অধিকার কায়েমের জন্যই সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।
ধন দৌলত ও বিলাশী জীবন তাকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকলেও তিনি সততার আর নীতির সাথে এবং নিজের আদর্শে বিশ্বাস ঘাতকথা করেননি কোনদিনও। দৈন্যদশার মধ্যে দিয়েই কাটিয়ে গেছেন সারাটা জীবন।
দেশ ও দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের জন্য ভাববার সময়টুকুও পাননি তিনি। প্রতিটি নির্বাচনেই জায়গা জমি বিক্রি করে নির্বাচনী খরচ যুগিয়েছেন। তিনি ছিলেন মনে প্রানে রাজনৈতিক। নিজের স্ত্রী ও সন্তানের জন্য মাথা গুজার ঠাইটুকুও করে জাননি তিনি। নাকি মাতৃভূমির জন্য কোন ত্যাগই বাকি রাখেননি। তিনি চরিত্র সম্পদের এত সমৃদ্ব ছিলেন যে, তার পক্ষে তুচ্ছজ্ঞান মনে হয়েছে বাহ্যিক ধন সম্পদ। তাইতো ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল তার দেশপ্রেম, অপরীসীম নিষ্ঠার কষ্টি পাথরে উত্তীর্ণ তার কর্মজীবন।
১৯৮৭ সালের ২১নভেম্বর রাতে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে জননেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও ছয় কন্যা ছাড়া সহায় সম্পদ কিছুই রেখে যেতে পারেননি।
আবহমান বাংলায় ত্যাগ ব্রতীদের অয় ইতিহাসে স্বর্ণারে যাদের নাম লিখা থাকবে মোহাম্মদ ইলিয়াস তাদেরই একজন। বর্তমান সময়ে তার মতো মানুষের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। আজ তার ৯৪তম জন্ম বার্ষিকী। তার মতো মানুষ যেন অধিক সংখ্যায় জন্ম নেয় এই বাংলায়, তবেইনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে পারবে এইদেশ।
আলাপকালে মোহাম্মদ ইলিয়াসের ভাগিনা সাংবাদিক সাব্বির এলাহী বলেন, ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন একজন বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ। গরীব দু:খী মেহনতি মানুষের জন্য কাজ করা এই রাজনীতিবিদ মারা যাওয়ার পর এখন আর তাঁর পরিবারের খোঁজ খবর নেন না নেতাকর্মীরা। একমাত্র মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো: আব্দুস শহীদ এমপি মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নেন। প্রায় ৩বছর আগে দলীয়ভাবে মোহাম্মদ ইলিয়াসের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছিল এরপর আর হয় নি। কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল উপজেলার সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ মোহাম্মদ ইলিয়াসকে ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের দাবি জানিয়ে আসছেন।
আলাপকালে কমলগঞ্জের লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ঢাকাকে কেন্দ্রবিন্দু করে সংগঠিত হলেও তা হয়ে উঠে বাঙালির জাতীয়তা তথা জাতিসত্তার আন্দোলন। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক গোষ্টির ভাষা বিরোধী এ আন্দোলন একই সঙ্গে গ্রাম ও শহরকে যুক্তভাবে গড়ে উঠে। ফলে বিভিন্ন স্থানে এ আন্দোলনের চরিত্র অভিন্ন ছিল। কমলগঞ্জের কুশালপুর গ্রামে জন্মগ্রহনকারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস ভাষা আন্দোলনের ঢাকা কেন্দ্রিক নেতা হলেও তিনিও মূল্যায়িত হননি। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার ৫২ বছরেও তিনি সেভাবে বিবেচ্য বা মূল্যায়িত হয়ে উঠেননি।