মহাশ্বেতাদির সঙ্গে কবে, কোথায়, কখন, কী ভাবে আলাপ হয়েছিল এখন আর তা মনে নেই।
তবে এটুকু মনে আছে, আমেরিকার একটি প্রকাশনীর তরফ থেকে যখন পৃথিবীর সমস্ত ভাষার একজন করে গল্পকারের একটি করে গল্প নিয়ে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করিয়ে অসম্ভব ভাল একটি আন্তর্জাতিক গল্প সংকলন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, তখন বাংলা ভাষার একমাত্র লেখক হিসেবে— না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নয়, ওরা নির্বাচন করেছিল রমাপদ চৌধুরীর নাম। ওরাই বলে দিয়েছিল, ইচ্ছে করলে লেখক তাঁর মনোনীত কাউকে দিয়েও এটি অনুবাদ করিয়ে দিতে পারেন।
অনুবাদ করার কথা উঠতেই আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল মহাশ্বেতাদির কথা।
মহাশ্বেতাদিকে বলতেই তিনি রমাপদ চৌধুরীর ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটা শুধু যে অনুবাদ করেছিলেন তাই-ই নয়, মূল কপির সঙ্গে টাইপ করে দিয়েছিলেন আরও একটি কপি। হ্যাঁ, টাইপ মেশিনে টাইপ করে দিয়েছিলেন। কারণ, তখনও বাজারে কম্পিউটারই আসেনি। আর টাইপ করে দিয়েছিলেন এই জন্য, যাতে কম্পোজ করতে গিয়ে কোনও রকম ভুল-ত্রুটি না হয়। সেই কপি দুটি এখনও সযত্নে আমার কাছে আছে।
এর অনেক পরে আমি যখন বিভিন্ন প্রথিতযশা কবি-লেখক সম্পাদকদের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে একের পর এক সংকলন সম্পাদনা করছি, তখন লিটল ম্যাগাজিনের তরুণ লেখকদের গল্প নিয়ে একটি গল্প সংকলন করার পরিকল্পনা নিই।
এই কাজটি করতে গিয়ে যাঁকে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে সঙ্গে নেওয়ার কথা আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, তাঁর নাম— মহাশ্বেতা দেবী।
তার আগে অবশ্য লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে পাঁচশোর ওপর সংকলন যুগ্ম ভাবে আমি সম্পাদনা করে ফেলেছি।
রুবির কাছে রাজডাঙার বাড়িতে গিয়ে মহাশ্বেতাদিকে বলতেই তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, কার কার লেখা তুমি রাখতে চাও, তা হলে সবার আগে তাঁদের নামের একটা সুচিপত্র তৈরি করো।
করেছিলাম। এবং উনি সেই সুচিপত্রটাকে এক কথায় অনুমোদনও করে দিয়েছিলেন। তবে তার সঙ্গে শুধু দুটি নাম তিনি অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আমি তাতে এককথায় রাজিও হয়েছিলাম।
ওঁর ছেলে নবারুণ দার (আকাদেমি পুরস্কার এবং বঙ্কিম পুরস্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ট লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য) মৃত্যুর পর মহাশ্বেতাদি গল্ফগ্রিনের নবারুণদার বাড়িতে থাকা শুরু করেন । নানান কাজে আমি সেই বাড়িতেও যেতাম।
শেষ যে বার যাই, গিয়ে দেখি উনি পা ছড়িয়ে বসে আছেন। অস্বাভাবিক রকমের ফুলে গেছে দুটি পা। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। শারীরিক সেই কষ্ট নিয়েই উনি সে দিন আমার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক আলোচনা করেছিলেন আমাদের পরবর্তী কাজকর্ম নিয়ে।
আসার সময় আমাকে বারবার করে বলেছিলেন, আবার এসো। কিন্তু না, আমি আর কোনও দিনও যায়নি। এমনকী, তিনি যখন অসুস্থ হয়ে বেলভিউ নার্সিংহোমে ভর্তি হন এবং আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান না ফেরার দেশে, তখনও আমি সেই শোকমিছিলে পা মেলাইনি। কারণ, মহাশ্বেতাদির এই ভাবে চলে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনি।
আমি বিশ্বাস করি, উনি কোথাও যাননি। উনি আমাদের পাশেই আছেন। আছেন আমাদের সঙ্গেই। আমাদের মনের মণিকোঠায়। আমাদের ভালবাসায়। আমাদের শ্রদ্ধায়।