দেশের সংবাদ

এক বছরে সরকার

বাংলাদেশ ২০১৯

এক বছরে সরকার

শুদ্ধি অভিযান উন্নয়নে সাফল্য, সুশাসনে প্রশ্ন

আগামী সপ্তাহে আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আকাশছোঁয়া জয় পেয়েছিল আওয়ামী লীগ ও মিত্ররা। এর এক সপ্তাহ পর ৭ জানুয়ারি সরকার গড়েছিল আওয়ামী লীগ। এই এক বছরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাফল্য দেখাতে পেরেছে সরকার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের হারও সন্তোষজনক বলে বিভিন্ন বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়া) নীতি গ্রহণ গত এক বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে তাঁদের মতে, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুতে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে।

আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ বলে দাবি করছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোও। তবে দক্ষ, সেবামূলক ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তোলার উদ্যোগ অনেক দূর এগিয়েছে, জনবান্ধব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুরোপুরি পূরণ না হলেও এ ক্ষেত্রে সরকারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, রপ্তানি আয় বাড়ানো, অবকাঠামো উন্নয়ন বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে নিশ্চয়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ঘোষণা বাস্তবায়নের পথে। শিল্পায়ন, শিক্ষায় উন্নতি, সড়ক, রেলপথ ও বিমান পথে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও রয়েছে সাফল্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত এক বছরে গণতন্ত্র বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র উন্নয়ন হয়নি। প্রতি মুহূর্তে এসব অধিকার খর্ব হয়েছে বা হচ্ছে। এর সবটাই যে সরকারি প্রশাসন করেছে তা নয়। আওয়ামী লীগের লোকেরাও করছে। সরকার যদি জনগণের নৈতিক সমর্থন অর্জন না করে, নির্বাচনগুলোতে যদি মোটামুটি ভোট না হয় তবে জনগণের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়।

এখনকার সরকার খুব শক্তিশালী তবে তা জনগণের নৈতিক সমর্থনের জোরে নয়, ভয়ের জোরে। সরকার নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন প্রসঙ্গে আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, ‘দেশের মানুষ প্রাণপণ চেষ্টা করে কৃষি উত্পাদন বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার কীটনাশক বা সার বিতরণে সাফল্য দেখিয়েছে। আগের মতো আর ভোগান্তি নেই। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো বা গার্মেন্ট ক্ষেত্রে রপ্তানি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। সরকার সফলতার সঙ্গে এটাকে চালিয়ে রাখতে পেরেছে। জাতিসংঘের মিশনে সৈন্য পাঠিয়ে বিদেশি মুদ্রা আয় অব্যাহত রয়েছে। ফলে আর্থিক অবস্থা ভালো আছে।’

আরও পড়ুনঃ দিলীপ চৌধুরী স্মরণে

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার অত্যন্ত সুচিন্তিত, সুগঠিত ও সুলিখিত নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে এসেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় এ ইশতেহারের মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তাদের উৎসাহ, উদ্যোগ বা উদ্যোম দেখিনি। এমনকি আমার কাছে অনেক সময় মনে হয়েছে এগুলো যারা বাস্তবায়ন করার কথা মন্ত্রিপরিষদের সেই সদস্যরা অনেক নিরীহ প্রকৃতির। ইশতেহারের যে মূল প্রত্যাশা পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমানের উন্নতি, সেটার অগ্রগতি হয়নি। ফলে সংস্কারের অভাবে সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়ে সরকারের অর্জিত সাফল্যকে ম্লান করে আগামী বছরকে সরকারের পথচলার জন্য একটি অমসৃণ বছরে পরিণত করেছে।’

তবে সরকার তার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের সঠিক পথে আছে বলে মনে করেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ) চেয়ারম্যান ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের যে নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল তা মোটাদাগে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে সরকার। বেশ কয়েকটি লক্ষ্য আছে সুদূরপ্রসারী। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ, ডেল্টা প্ল্যান—এগুলো বাস্তবায়নে সরকার সঠিক পথেই আছে বলে মনে করি। সরকার সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান শুরু করেছে তাও কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণেরই অংশ।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার সব ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করেছে। কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের অনেকগুলো অর্জন রয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ বেড়েছে। শুধু পেঁয়াজের দাম ছাড়া অন্যসব জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতেও অগ্রগতি হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। ফলে সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদা অনুসারে সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।’

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইশতেহার দেওয়া হয় পাঁচ বছরের জন্য। এর মধ্যে মাত্র এক বছর পার হলো। আমি মনে করি, গত এক বছরে আমরা আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাফল্য অর্জন করেছি।’

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এই অঙ্গীকারের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়। সরকার গড়ার পর মন্ত্রীদের কার্যক্রম নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দেওয়া অঙ্গীকার রক্ষার কাজ শুরু করেন। ক্যাসিনোর মাধ্যমে অসাধু উপায়ে সম্পদশালী হওয়া সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে এ বছর শুরু হয় দুদক ও এনবিআরের সমন্বিত অভিযান। অনেকে একে শুদ্ধি অভিযানও বলেন। ওই অভিযান থেকে রেহাই পাননি সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ নিকটাত্মীয়রাও। ওই কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এটি দেশব্যাপী সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

আইনের শাসন : বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হলেও মানবাধিকার সুরক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে ‘আইনের শাসন, নিরাপত্তা, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার’ দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ বি এম শামসুল হুদা এ কথা বলেন।

এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশসহ মোট পাঁচটি দেশে ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থা চালু আছে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (আইআইডিইএ)। ২০১৯ সালের বৈশ্বিক গণতন্ত্র পরিস্থিতি শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন অভিমত তুলে ধরেছে আইআইডিইএ। বাংলাদেশ সময় গত ১২ ডিসেম্বর রাতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের কনফারেন্স ভবনে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইআইডিই। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিঙ্গাপুর ও কিরগিজস্তানে হাইব্রিড শাসন চলছে। বিশ্বের মোট হাইব্রিড শাসনের ১৮ শতাংশই এই অঞ্চলে। গত চার দশকের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ‘গণতান্ত্রিক’, ‘হাইব্রিড’ ও ‘অগণতান্ত্রিক’—এই তিন ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। অন্যদিকে আফগানিস্তান, সিঙ্গাপুর ও কিরগিজস্তানে কখনো পূর্ণ গণতন্ত্র ছিল না। এ ছাড়া মালয়েশিয়া ছয় দশকেরও বেশি সময় পর গত বছর ‘হাইব্রিড’ অবস্থা থেকে উন্নতি করে দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আগে ছিল ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ২০১৪ সালে সেই পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়ে হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তবে গণতন্ত্র থেকে পিছু হটার প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল আরো বেশ আগে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বিভিন্ন আইন ও মামলার মাধ্যমে গণমাধ্যমের ওপর পূর্ণ আক্রমণ চালায়। এ সময়ে সাংবাদিকদের হয়রানি ও হামলার তথ্য রয়েছে।

জনগণের ক্ষমতায়ন : দারিদ্র্য নিরসন ও বৈষম্য কমিয়ে উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদসহ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে।

আমার গ্রাম আমার শহর : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গ্রামকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রীয় দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধার মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামকে আধুনিক শহরের সব সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মেগা প্রকল্প : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মেগা প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণসহ ১০টি বৃহৎ প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করাই টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের অন্যতম টার্গেট। স্বপ্নের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এগুলোতে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ।

বিদ্যুৎ : বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উত্পাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট। এটি এ খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়নের দিকনির্দেশ করে। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা তিন কোটি ৫৫ লাখ এবং বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৯৫ শতাংশ।

কানাডা প্রবাসীদের অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখতে হলে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেল

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − 16 =