এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়
অনেক বছর আগের কথা। সেদিন ছিল চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক মেলা। মেলা মানেই তো তালপাতার বাঁশির অপূর্ব মূর্ছণা, সূঁতোয় বাঁধা কাঠপুতুলের নাচন, ঝাল মুড়ি খাওয়া, নাগর দোলা চড়া, আরো কত কি! তখন কত আর বয়স আমাদের, তেরো চৌদ্দ হবে। প্রতিবারের মতো সেবছরও মেলায় যাবার অব্যক্ত আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কত আশা করে প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম, মেলা দেখতে যাবো, ঘুরবো, বেড়াবো, মজা করবো। কিন্তু বিধি বাম। সেদিন ঊষার প্রারম্ভেই হাল্কা কূয়াশায় ছেয়ে যায় চারদিক। কিছু দেখা যাচ্ছে না চোখে। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তন্মধ্যে ভাপসা গরম। একটু হাওয়া নেই, বাতাস নেই। পশু-পাখীর কলোরব নেই। পড়ন্ত বিকেলে শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এলোপাথাড়ী ঝড়। প্রকৃতির শোচনীয় অবস্থা। কিন্তু তা উপেক্ষা করে আমরা কিশোরীরা দলবেঁধে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বেড়িয়ে পড়ি মেলা দেখতে।
যাচ্ছিলাম শর্টকাট পথ ধরে, একটি ফুটবল খেলার মাঠের উপর দিয়ে। কিছুদূর যেতেই শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। একেবারে চাকা চাকা বরফের টুকরো। পড়ছে টপাটপ আমাদের মাথার উপর। বিড়ম্বণায় অস্থির হয়ে উঠি। কি করি! দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ি নিকটবর্তী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিতর। তারপর শুরু হয় মুসলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। সহসা থামবার কোনো লক্ষণ নেই। সেই সঙ্গে গুড়–ম গুড়–ম মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের বাঁকা ঝিলিক। গাছের ডালপালা ভেঙ্গে মুছড়ে সে একেবারে প্রলয়ঙ্করী বেগে ছুটে চলে দ্বিগি¦দিকে। ততক্ষণে ভাটা পড়ে যায় আমাদের আনন্দ-উল্লাসে। মেলায় ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতি সব গেল মাটি হয়ে। বেড়ে যায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। যা ক্ষণপূর্বেও ভাবিনি। তন্মধ্যে লোড-শেডিং। বিদুৎ নেই। গোধূলীর পূর্বেই নেমে আসে ক্ষীণ আবছা অন্ধকার। আমরা ঘাবড়ে যাই। আকস্মিক অনাকাক্সিক্ষত বিরূপ পরিস্থিতির কবলে পড়ে প্রহর গুনতে থাকি, নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাবার। ইতিমধ্যে কর্ণগোচর হয়, মানুষের কোন্দল, কোলাহল, চিৎকার-চেঁচামিচি।
আমরা চমকে উঠি। উক্ত বিদ্যালয়ের জানালা দিয়ে তাকাতেই দূরের হ্যাজাক্বাতির জোড়ালো রস্মি আমাদের দৃষ্টি আর্কষণ করে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, যেন অথৈ জলে কিনারা খুঁজে পেলাম। দেখলাম, ঐ ফুটবল খেলার মাঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত একটি বিশাল দালান বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রচন্ড ভীঁড়। লোকে লোকারণ্য। খুব হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু কোনো হেতু বোঝা যাচ্ছে না। অনুমেয় হয়ে ছিল, কারো মাথার উপর বজ্রপাত হয়েছে।
কিন্তু না, লোকের কানাঘুষোয় অবগত হলাম, শিশু অপহরণের দায়ে এক মহিলাকে আটক করে রেখেছে। মনে মনে ভাবলাম, এ আর নতুন কি! অহরহই তো ঘটছে! কিন্তু এমন ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে?
তবু স্বভাবসুলভ কারণে মহিলা চোরকে স্বচোক্ষে দেখার ইচ্ছাটা আমাদের প্রবলভাবে জেগে ওঠে। সম্বরণ করতে পারিনি। বৃষ্টি খানিকটা ধরে আসতেই আমরা কৌতূহলে ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি, সে এক অবাক কান্ড। নতুন বিস্ময়। একেবারে গল্প, নোবেলের মতো ঘটনা। ময়লা অপরিস্কার ছেঁড়া ফাটা বস্ত্র পরিহিতা একজন মহিলা একহাত ঘোমটা টেনে, কাঁথা জড়ানো একটি ছোট্ট শিশুকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। লোকজনের চিৎকার চেঁচামিচিতে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছে। গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছেনা। অপরাধীর মতো কড়জোরে মাথা নত করে আছে। ওর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলাম, দুহাত ভর্তি রং-বেরঙের প্লাাষ্টিকের চুড়ি। পায়ে স্যাঁতলাপড়া হাওয়াই চটি। ময়লা ভর্তি হাতে পায়ে বড় বড় নখ। পায়ের পাতাদুটোও ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা গেল, বেশ কয়েকদিন জলের মধ্যে থেকেছিল। আঙ্গুলের ফাঁকগুলি জলে ঘা হয়ে বিন্দু বিন্দু রক্তকণা ঝড়ছে। মাঝে মধ্যে শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মুছছে।
কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে পাড়ার মস্তান গোছের কয়েকজন যুবক ছেলে উত্তেজিত হয়ে বলছে,-‘ধর চুলের মুটি, বেটি দু-চার ঘা খেলে মুখ দিয়ে বুলি উতরে আসবে!’
কেউ বলছে,-‘কূলটা, পাপীষ্ঠা!’
আবার কেউ বলছে,-‘পালিয়ে যাচ্ছিস কোথায়? বল্ কোথা থেকে বাচ্চা চুরি করেছিস? কাদের বাচ্চা চুরি করেছিস শীগ্গিরি বল, নয়তো এক্ষুণি পুলিশে ধরিয়ে দেবো!’
পুলিশের নাম শোনা মাত্র ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে মহিলাটি র্থ র্থ করে কাঁপতে শুরু করে। ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে বাচ্চাটাকে সবলে বুকে চেপে ধরে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত জনতার দল নাছোরবান্দা। চোখ রাঙায়। হুমকি দেয়। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে তেড়ে আসতেই মহিলাটি কাঁন্ন্াজড়িত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে,-‘আমি চোর নই বাবু, চোর নই! ও আমারই বাচ্চা। কত্তকষ্টে নয়টামাস প্যাটে রাইখ্যা অরে আমিই জনম দিছি! আমিই অর মা!’
বাচ্চাটাকে সজোরে বাহুবেষ্টনে আলিঙ্গন করে, ওর কপালে গালে চুম্বন করে বলে,-‘সংসারে আমাগো কেউ নাই গো বাবু। বানের জলে সব ভাইস্যা গ্যাছে। আমারে দয়া করেন!‘ বলতে বলতে মহিলাটি হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে উন্মোচন হতে থাকে ওর জীবনের করুণ কাহিনী।
মহিলাটির নাম সরলা। অজ্পাড়া গাঁয়ের অত্যন্ত নি¤œবিত্ত পরিবারের কূলবধূ। জরা-জীর্ণের মতো রোগা শরীর। শ্যামলা গায়ের রঙ। বয়সের তুলনায় বেশ বুড়িয়ে গেছে। চোখমুখ গর্তে ঢুকে গেলেও খুটিয়ে দেখলে বোঝা যাচ্ছিল, যৌবনকালে কম সুন্দরী ছিল না। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে অনাদর অবহেলায় ময়লার আবরণে ওর লাবণ্যময় সৌন্দর্য্য একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঘটা করে না হলেও রীতিমতো পুরোহিত এসে শাস্ত্র মতেই ওর বিবাহ হয়েছিল ওদেরই পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটা অশিক্ষিত অসমর্থ দুর্বল লুলা ল্যাংড়া তরুণ যুবক গৌরাঙ্গের সাথে।
কথায় বলে,-‘সোনা বেঁকে গেলেও সেটা সোনাই। তার মূল্য কখনো কমে যায় না!’
ঠিক তেমনি একজন পুরুষমানুষ শত কালো কুৎসিৎ কিংম্বা বিকলাঙ্গ হলেও তার পুরুষত্ব কখনোই কমে যায়না। আর গেলেও সরলার মতো মেয়ের কিইবা এসে যায়! বরং ওর শাপে বরই হয়েছিল। তা’ছাড়া, বিমাতা কতৃক অমানবিকভাবে নির্যাতিত এবং লাঞ্ছিত হয়ে অর্ধাহারে জীবনযাপন করার চেয়ে লুলা ল্যাংড়া অক্ষম স্বামীর ঘর-সংসার করা ঢের ভালো। এ তো পরম সৌভাগ্য সরলার। বিধাতার অসীম দয়া। তা নাহলে ওর মতো অজ্ পাড়াগাঁয়ের একটা আন্এ্যডুকেটেড্, আনস্মার্ট এবং স্বল্প বস্ত্র পরিহিতা মেয়ের বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, জীবন সাথী পাওয়া, তার ভালোবাসা পাওয়া, এ কি কম সৌভাগ্যের কথা! স্বপ্নেও তো ভাবতে পারেনি কোনদিন!
গৌরাঙ্গ ক্র্যাচ্ ছাড়া চলতে পারতো না। চলার সামর্থ ছিল না। ওর পা-দুটোই অচল। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শুধুমাত্র মৌলিক চাহিদা মেটাতেই ওকে হিমশিম খেতে হতো। তবু ওর মনের শক্তি ছিল প্রকট। ছিল অসাধারণ আত্মবিশ্বাস, দূঢ় সংকল্পপ্রবণ মন-মানসিকতা। শারীরিক ভারসাম্যহীনতায় কখনো ভেঙ্গে পড়েনি, পিছুপা হয়নি। দুঃখ-দৈনতা ওকে কখনো ঘায়েল করতে পারেনি। বিকলাঙ্গ শরীর নিয়েই গরুরগাড়ির মতো ধিক্ ধিক্ করে ঠেলাগাড়ি টানতো। বাজারে ডাব বিক্রি করতো। বাড়িতে হাঁস-মুরগীর পোল্ট্রিও ছিল। তার দেখাশোনা করতো সরলা। তাতে যা আমদানি হোতো তা দিয়ে দু’জনের সংসার কোনরকমে চলে যেতো। কোনো কোনোদিন অর্ধাহারে কাটাতে হতো। তবু কোনো অসন্তোষ বা অভিযোগ ছিল না। ছিল সুখ, শান্তি। ছিল সরলার অনাবিল মুখের অনিন্দ্য হাসি। যা কখনো ¤øান হতো না। বাস করতো খড় কুটোর ছাউনি দেওয়া ছোট্ট মাটির ঘরে। যেখানে প্রত্যেক বছর বর্ষার জলে ধস্ নেমে গৃহহীন হয়ে পড়ে বাচ্চা-বুড়োসহ গ্রামের শত শত অসমর্থ দুর্বল মানুষ। মারাও যায় অনেকে। আর যারা না মরে অর্ধমৃত অবস্থায় সর্বস্ব নিঃশ্ব হয়ে বেঁচে থাকে, তারা এতিমের মতো আশ্রয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় রাজ্যের অখ্যাত কুখ্যাত অলিতে গলিতে, শহরের জনপথে। যেখানে প্রতিনিয়ত প্রবঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হয় আশ্রয়হীন, সম্বলহীন, ন্বজনহীন, গৃহহীন অগণীত অভূক্ত মানুষের জীবন।
সেবার প্রবল বর্ষণ ও ঝড়-তুফানে সরলার স্বামীসহ ঘর-সংসার, হাঁস-মুরগী সব বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। তারা জীবিত না মৃত, সরলার জানা নেই। কথায় বলে,-‘চাচা, আপন পরাণ বাঁচা!’
বন্যার জলে ভয়ঙ্কর বিপদগ্রস্থ সরলার ভালোবাসার মাটির প্রাসাদখানি যখন টলমল অবস্থা, তখন সে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। দ্বিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সুনিশ্চিতভাবে গন্তব্য নির্ণয় করা, ন্যায়-অন্যায়, বিচার-বিবেচনা করার মতো কোনো শক্তিই তখন ওর ছিলনা। যখন আসন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখে পালিয়ে যাওয়াই ছিল সরলার একমাত্র বাঁচার পথ।
নয়তো মা ও নবজাত শিশু দুজনের মৃত্যু অবধারিত।
অবলীলায় সরলা উপায়ান্তরহীন হয়ে সদ্য নবজাত শিশুকে বুকে আলগে একটি কাপড়ের পোটলা সাথে নিয়ে, স্বামী, ঘর-সংসার এবং ওর বৈবাহিক জীবনের বিশ্বাস-ভালোবাসার সকল বন্ধন ছিন্ন করে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে। যে ঘরে জন্ম নিয়েছিল সরলার প্রথম প্রেম, ভালোবাসা। কত আশা বুকে বেঁধে সাজিয়ে ছিল ওর নতুন সংসার। গড়ে তুলেছিল স্বর্গসুখ। কত না স্বপ্নীল আকাক্সক্ষা সঞ্চিত করে রেখেছিল মনের মণিকোঠায়। যা ভাগ্যবিড়ম্বণায় অবাঞ্ছিত, অর্থহীণ মনে হতেই হারিয়ে ফ্যালে মনের শক্তি, আশা ভরসা। যেদিন প্রকৃতির নিষ্ঠুর পরিণতির পূর্বাভাষে বোধগম্য হয়েছিল, আজই বন্যার জলে ভেসে যাবে ওর সুখের নীড়। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ওর দেবতূল্য স্বামী গৌরাঙ্গকেও। যার ছুটে পালাবার ক্ষমতা নেই। ওকে যে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোনো চিহ্নই থাকবে না। হয়তো গাছের লতাপাতার সাথে লেপটে থাকবে। হয়তো বা দম বন্ধ হয়ে সেখানেই মরে পড়ে থাকবে। যাকে শনাক্ত করা কিংবা জীবিত না মৃত তা অনুসন্ধান করবার মতোও কোনো সুযোগই থাকবে না। হয়তো কোনদিন আর দেখা হবে না গৌরাঙ্গর সাথে। কোনো জবাবদিহীও আর করতে হবেনা। হয়তো আজই ওর জীবনে শেষ দেখা।
অনেক আশা করেছিল, শহরে এসে কূল-কিনারা একটা নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। মাথা গোঁজার মতো একটুখানি আশ্রয় কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই জুটে যাবে। কোলের সন্তানই ওর একমাত্র সম্বল। বেঁচে থাকার সাহারা। যার মুখ চেয়ে জীবনের দুঃখ যন্ত্রণা সব ভুলে যাবে। ভুলে যাবে ওর অতীত। ভুলে যাবে স্বামী গৌরাঙ্গকেও। দুঃখই যার নিত্যসঙ্গী, প্রতিদিনকার খোরাক, লোকের বাড়ি ঝি-কাজ করে অনিশ্চিত জীবনের বাকী দিনগুলি সে নিশ্চয়ই কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু যত সহজ মনে হয়, বাস্তব তার চেয়েও কঠিন।
বলতে বলতে বিকলাঙ্গ স্বামী গৌরাঙ্গের অসহায় মুখখানা চোখের পর্দায় ভেসে উঠতেই বেদনায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে সরলার। শোকে বিহŸলে হঠাৎ দুইহাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করে ওঠে,-‘তারে আমি একেলা ছাইড়্যা আইছি। পারি নাই রক্ষা করতে। আমি যে বচন দিছিলাম, সারাজীবন তার পাশে থাকুম, অসময়ে তারে দেখুম, রক্ষা করুম। পারি নাই তারে বাঁচাইতে, রক্ষা করতে। আমি বড় নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। আমারে ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো। আমার বাচ্চাটারে বাঁচাও। অরে দয়া করো। আমারে পথ দেখাও।’
কিন্তু সরলাকে সঠিক পথ দেখাবে কে? সেদিনকার মতো সাময়িক আশ্রয় পেলেও পরের দিন দিগন্তের প্রান্তরে ঊষার প্রথম সূর্য্যরে কোমল নির্মল ¯িœগ্ধ আলো ফুটে উঠতেই হতাশ হয়ে শূন্য হাতে সরলাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। একটুকু সাহায্য, সহানুভূতি, নিরাপদ আশ্রয় কিছুই জোটেনি ওর কপালে। বিপন্ন জীবন নদীর ¯্রােতের টানে ও যে কোন মোগনায় আটকে আছে, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে, তা কেই জানে না। তার কারণ আমাদের সমাজ বড়ই কঠোর, নিষ্ঠুর, অস্থিতিশীল। সন্দেহের প্রকোষ্ঠে কারাবন্দী। ক্রমাণ্বয়ে ছলে-বলে সুকৌশলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ধূর্ত প্রতারকের প্রতারণায় প্রতারিত হতে হতে সাধারণ দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি বিশ্বাস-ভরসা, দয়া-মায়া-মমতা-ভালোবাসা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কোনপ্রকার অনুদান কিম্বা আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আমাদের সমাজ কুণ্ঠিতবোধ করে, পিছুপা হয়। মাথাকূটে কেঁদে মরে গেলেও তাদের অনুনয় বিনয় আর্তচিৎকার কারোর কর্ণপাত হয় না। উপরন্তু ভ্রষ্ঠাচারে লিপ্ততার অভিযোগে প্রতারক, কূলটা, পাপীষ্ঠা বলে অপবাদ দিয়ে একজন অসহায়কে কলঙ্কিত করে সুশীলসমাজ থেকে চ্যুত, বিতাড়িত ও বহিঃস্কার করতে আমাদের এতটুকু বিবেকে বাঁধেনা। যার ফলে সরলার মতো শত শত গৃহহীণ আশ্রয়হীন সম্বলহীন সহজ সরল অবলা অসহায় নারী আমাদের সমাজে আজও নিগৃহীত, নিপীড়িত। যারা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিমর্মভাবে জীবন পাত করে চলেছে। যারা পেটের দায়ে মান ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে শহরের অলিতে গলিতে বসে ভিক্ষে করছে। কেউ লোকের এঁঠো বাসন-পত্র ধুয়ে মেজে অন্ন যোগাচ্ছে। কেউ কূলি বিত্তি করে পাখীর ছানার মতো নিজের সন্তানের মুখে আহার তুলে দিচ্ছে। আর কেউ অর্থের বিনিময়ে নিজেকেই বেঁচে দিচ্ছে দয়া-মায়াহীন, নিষ্ঠুর অত্যাচারী পাষন্ডের হাতে। কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? কে দেবে এদের সাহারা? কে নেবে এদের দায়িত্ব? কি হবে এদের পরিণাম? যার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
অতঃপর, সেদিন চড়ক মেলার অনবদ্য আনন্দ ভুলে গিয়ে মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, এতক্ষণ ছবিঘরে বসে আমরা রূপালী পর্দায় সরলার জীবন কাহিনীর সরূপ চিত্র প্রদর্শণ করছিলাম। কিন্তু ওর বুকের যন্ত্রণার গভীরতা সেদিন অপরিণত বয়সে আমরা কেউই অনুভব করতে পারিনি। পারিনি মানবতার মানদন্ডে তার মূল্যায়ন করতে। কিন্তু সেইরাতে দুচোখের পাতা কিছুতেই আর এক করতে পারিনি। পারিনি মন থেকে তা অপসারিত করতে। এক ধরণের বেদনাময় অনুভূতির তীব্র দংশণ নদীর ঢেউএর মতো বার বার মস্তিস্কের স্নায়ূকোষে এসে লাগছিল। যা আজও নিরবিচ্ছিন্ন একাকী নির্জনতায় বিশেষতঃ চৈত্র সংক্রান্তি এলে আমার চোখের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠে, অতীতের হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্যপটের সর্বহারা অসহায় জননী সরলার আকুতি, মিনতি। কানে বাজে ওর ক্রন্দন, বিলাপ, আর্তনাদ। যা আজও আমাকে পীড়া দেয়।
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।
আরও পড়ুনঃ