তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান জাতিসংঘের সাধারণ সভার অধিবেশনে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলে ভারতের সমালোচনা করার পর দিল্লি কঠোর ভাষায় তুরস্ককে পাল্টা আক্রমণ করেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার ভাষণে বলেছিলেন, “জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাবের কাঠামোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমেই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে হবে – কিন্তু কাশ্মীরে দিল্লির সিদ্ধান্তই পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে”।
জবাবে ভারত বলেছে, এই মন্তব্য ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সামিল এবং তা ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’।
বছর তিনেক আগে ভারত সফরে আসার ঠিক আগে কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দিল্লিকে চরম অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন।
এর পরেও তিনি বারবার কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, কিন্তু এর মাধ্যমে তুরস্ক ঠিক কী লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে?
বস্তুত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গত বেশ কয়েক বছর ধরে যেভাবে বার বার কাশ্মীর প্রশ্নে প্রকাশ্যে ভারতকে আক্রমণ করছেন ও ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সুরে সুর মেলাচ্ছেন – তা দিল্লির জন্য হজম করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে।
২০১৭র মে মাসে ভারত সফরে আসার ঠিক আগে তিনি ভারতেরই একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছিলেন, কাশ্মীরে রক্তপাত বন্ধ করতে ‘বহুপাক্ষিক আলোচনা’ দরকার আর তুরস্ক সেখানে সামিল হতেও রাজি।
এরপর অতিথির প্রতি কূটনৈতিক শিষ্টাচার দেখিয়ে ভারত বলেছিল, সিমলা চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ‘দ্বিপাক্ষিক বিষয়’।
তবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পর পর দুবছর জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলার পর ভারত এবার রীতিমতো কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ইউ এন তিরুমূর্তি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুইট করে বলেছেন, “অন্য দেশের সার্বভৌমত্বকে মর্যাদা দেওয়া তুরস্ককে শিখতে হবে, গভীরভাবে ভাবতে হবে নিজেদের নীতিগুলো নিয়েও!”
তবে প্রশ্ন হল, তুরস্ক থেকে বহু দূরের কাশ্মীর নিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এভাবে বারবার কেন মুখ খুলছেন?
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র পলিসি ফেলো আসলি আয়দিনতাসবাস ইস্তাম্বুল থেকে বলছিলেন, “আসলে তুরস্ক একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের উন্নীত করতে চায়।”
“একটি মাঝারি মাপের উদীয়মান শক্তি থেকে একুশ শতকের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশগুলোর কাতারে তুরস্ককে যাতে নিয়ে যাওয়া যায়, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার লিগ্যাসি-কে সেভাবেই রেখে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।”
“এবং এখানে তিনি কাশ্মীরকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন।”
“মধ্যপ্রাচ্য ও সিরিয়ার উত্তেজনা এবং দেশের ভেতরে মানবাধিকার রেকর্ডের কারণে তুরস্কের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত, এখন কাশ্মীরকে আঁকড়ে ধরে তুরস্ক বিশ্বের পাওয়ার পলিটিকে একটি মধ্যপন্থী শক্তি হিসেবে উঠে আসতে চাইছে”, বলছিলেন মিস আয়দিনতাসবাস।
এ বছরের গোড়ায় ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ভাষণ দিতে গিয়েও কাশ্মীরের প্রতি নি:শর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন মি এরদোয়ান।
এমন কী, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রশক্তির যে গ্যালিপোলির যুদ্ধ হয়েছিল, কাশ্মীরের তুলনা করেছিলেন তার সঙ্গেও।
এ কারণেই ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও তুরস্কে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত কানওয়াল সিব্বাল মনে করছেন, বারবার কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপনের মধ্যে এরদোয়ানের ‘ইসলামিক ও পাকিস্তানপন্থী এজেন্ডা’ই আসলে স্পষ্ট।
মি সিব্বাল বলছিলেন, “প্রথমত তিনি এখানে বন্ধু ইমরান খানের অনুরোধে সাড়া দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, মুসলিম উম্মা বা ভ্রাতৃত্বের প্রতি তার অঙ্গীকারও এখানে কাজ করছে।”
“পাকিস্তানে এসে তিনি শুধু কাশ্মীরের মুসলিমদের সম্বোধন করে ভাষণ দিয়েছিলেন, যা থেকে বোঝা যায় অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি তার দরদ কতটা।”
“তা ছাড়া, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো তার অভ্যাসে পরিণত – ইরাক, সিরিয়া, কাতার, লিবিয়ার মতো অজস্র দেশে সেনাও পাঠিয়েছেন।”
“এটা পুরোটাই তার বৃহত্তর এক পরিকল্পনার অংশ – যেখানে তিনি নিজেকে ইসলামী বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে দেখতে চান।”
আসলি আয়দিনতাসবাস আবার এ প্রসঙ্গে যোগ করছেন, “নিজের নেইবারহুড বা প্রতিবেশেই তুরস্ক আসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে – যে কারণে তারা ভারত ও পাকিস্তানের দিকে হাত বাড়িয়ে কাশ্মীর সঙ্কটের সমাধান করতে চায়।”
“তুরস্ক বিশ্বাস করে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বিরুদ্ধে একটি অক্ষ গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলো, সৌদি ও ইসরায়েল।”
“আর যেহেতু আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কও ওয়াশিংটনের বিরাট সমর্থন পাচ্ছে, তাই অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে তারা এখন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে আগ্রহী।”
“ফলে এই যে নিজেদের অঞ্চলে প্রান্তিক ও কোণঠাসা হয়ে পড়া, সেটা থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতেই দক্ষিণ এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে তারা।”
তুরস্ক ও পাকিস্তান চিরাচরিত মিত্র দেশ হলেও নব্বইয়ের দশকে প্রেসিডেন্ট টুরগুট ওজালের আমল থেকেই তুরস্ক ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিল।
তবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে সরে এসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যেভাবে ইসলামী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন, তাতে এখন আর সেই উদ্যোগের বিশেষ ভবিষ্যৎ দেখছে না ভারত।
আর দিল্লি ও আঙ্কারার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের এই ক্রমাবনতিতেই ইন্ধন জোগাচ্ছে কাশ্মীর।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন