ধর্ষণ : বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধনী এনে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা ইতিমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড হলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে কি না -এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে।
বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ধর্ষণের মামলা বছরের পর ঝুলে থাকার অভিযোগ আবারও সামনে এসেছে।
কিন্তু আইনে যা আছে, তদন্ত এবং বিচার যেভাবে হয়- এই প্রক্রিয়াগুলোতে গলদ কী আছে বা সমস্যাগুলো কোথায়-এ সব প্রশ্ন এখন আলোচনায় এসেছে।
নারীকেই সন্দেহ বা অবিশ্বাস
ধর্ষণের ঘটনায় এতদিন একমাত্র শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এখন করা হলো মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন সাজা।
সর্বোচ্চ এই শাস্তি ধর্ষণ এবং সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন বন্ধে কতটা সহায়ক হবে-এ নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তারা বলেছেন, একজন নারী যখন ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন, তখন তার মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত এবং বিচার-প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই নারীকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করা হয়। সেটাকে বিশেষজ্ঞরা বড় গলদ হিসাবে দেখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেছেন, আইনে অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত না করে শুধু মৃত্যুদণ্ডের বিধান এনে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না।
“যখনই একজন নারী আসবেন আদালতে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে, এখানে প্রথমেই ধরে নেয়া হয় যে, তিনি হয়তো সত্য কথা বলছেন না, তিনি মিথ্যা বলছেন।”
“এই যে আমাদের যুগ যুগ ধরে একেবার ব্রিটিশ সময় থেকে চলে আসা ধারা আমরা শক্তিশালীভাবে লিগ্যাসি বহন করে বেড়াচ্ছি। অন্য সকল মামলার থেকে যখন ধর্ষণের মামলা হবে, এটার অর্থই হচ্ছে যে, একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি ফেঁসে যেতে পারে।”
মিস ইয়াসমিন বলছেন, “এই যে প্রো-অ্যাকিউস্ড (অভিযুক্তের স্বপক্ষে) অ্যাপ্রোচটা-এখানে একটা পরিবর্তন দরকার। বিচার প্রক্রিয়ায় আমাদের গলদগুলো এত বেশি, সেগুলোকে অ্যাড্রেস করা প্রয়োজন। এই গলদগুলো এত শক্তভাবে শেকড় গেড়েছে যে, আপনি আইনে মৃত্যুদণ্ড লিখে দিলেই কোন পরিবর্তন আসবে না।”
আইনের দুর্বলতা নিয়ে তাসলিমা ইয়াসমিন আরও বলেছেন, “বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঘটে পারিবারিক সহিংসতা। এই পুরো আইনেই কিন্তু পারিবারিক সহিংসতাকে কোন অপরাধ হিসাবে দেখা হচ্ছে না।”
“এটা একেবারেই আনজাস্টিফাইঅ্যাবল, যখন এই আইনটার মূল বিষয়ই ছিল নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা। এটা নিয়ে ভাবা দরকার ছিল যে, পারিবারিক সহিংসতাকে আমরা কেন অন্তর্ভূক্ত করছি না?”
দু’দশকেও হয়নি নীতিমালা
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০০০সালে।
বিশ বছরেও এই আইনের কোন বিধিমালা করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ এবং বিচার সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে ব্যাখ্যা বা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকে বিধিমালায়, যা আইনে থাকে না। সেজন্য প্রতিটি আইনের ক্ষেত্রেই বিধিমালা প্রয়োজন হয়।
অনেক আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিধিমালা তৈরির আদেশ এসেছিল উচ্চ আদালত থেকে। কিন্তু এখনও তা করা হয়নি।
আইনজীবীরা বলেছেন, বিধিমালা না থাকায় ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলায় একেক বিচারক একেকভাবে বিচার করেন। সেটাকে তারা অন্যতম সমস্যা হিসাবে দেখেন।
নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেছেন, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা যা রয়েছে, তাও সীমিত। সেকারণেও ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সঠিক বিচার হয় না বলে তিনি মনে করেন।
“ধর্ষণের সংজ্ঞাটাকে কিন্তু আরও বিস্তৃত করতে হবে। সেখানে অস্বাভাবিক ধর্ষণের ঘটনা যেটা অনেক মামলায় আসছে, যেমন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যেটা হলো, এগুলো কিন্তু সবই ধর্ষণের সংজ্ঞায় আনতে হবে।”
এখন আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞা আছে, তাতে বলা হয়েছে, কোন পুরুষ যদি বিয়ে ছাড়া কোন নারীর সাথে যৌন সঙ্গম করে, সেখানে ঐ নারীর সম্মতি না থাকলে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে তা করা হলে, তবেই সেটা ধর্ষণ হিসাবে গণ্য হবে।
এই সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করার জন্য নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে দুই বছর আগে।
যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এখনকার সংজ্ঞা ”বাস্তবসম্মত” বলে তারা মনে করেন। একইসাথে তিনি বলেছেন, ধর্ষণের সংজ্ঞায় সংস্কারের বিষয় তারা বিবেচনা করতে পারেন।
“ধর্ষণের যে সংজ্ঞা, যতটুকু এখন আছে, সেটা নিয়ে আমার মনে হয় না, খুব একটা বিতর্ক হওয়া উচিত। কারণ বাস্তব সংজ্ঞাটাই আছে। তারপরও এটাতো পরিবর্তন করা যায়। এটা আমরা দেখতে পারি।”
তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
ধর্ষণ মামলার তদন্ত নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই।
নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলেছেন, বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল থাকলেও তদন্তের ব্যাপারে বিশেষায়িত কোন ব্যবস্থা নেই।
পুলিশ অন্য অনেক মামলার সাথে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের মামলা তদন্ত করে থাকে এবং সেজন্য লম্বা সময় লেগে যায়।
তারা মনে করেন, দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে তদন্তে দুর্বলতার প্রভাব বিচারের ক্ষেত্রে পড়ছে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলেছেন, ১০ বছর ধরে তারা প্রায় তিনশটি ধর্ষণের মামলায় আইনী সহায়তা দিচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মামলারই বিচার শেষ করা যায়নি বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
“সমস্যাটা হচ্ছে, তদন্ত যিনি করছেন, তিনি তদন্তে সময় লাগাচ্ছেন। তিনি অনেকবার সময় নিয়ে তারপর হয়তোবা আদালতে চার্জশিট দিচ্ছেন।”
“চাজশিট দেয়ার পর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এই সাক্ষ্য নেয়ার সময় শুরু হয় সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনা। ভিকটিমের সাক্ষ্যটা ভাইটাল সাক্ষ্য।”
“কিন্তু আরও অনেক সাক্ষী দরকার হয়। যিনি মেডিকেল করেছেন, সেই ডাক্তারের সাক্ষী নিতে হয়। জবানবন্দী নেয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্য লাগে। সাক্ষীদের আনার কোন ব্যবস্থা নাই। সরকারি কর্মকর্তা যারা সাক্ষী হন, দিনের পর দিন তারাও আসতে গাফিলতি করেন। এখানে কোন জবাবদিহিতা নাই।”
তিনি বলছেন, “গাফিলতির কারণে শুধু দেরি হয়, তা নয়, প্রসিকিউশনের গাফিলতির কারণে মামলার সবল দিকগুলো আদালতে ঠিকমত তুলে ধরা সম্ভব হয় না।”
যদিও আইনে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন।
তাদের অভিযোগ হচ্ছে, পুলিশী তদন্তে দিনের পর দিন সময় চলে যায়। অবশেষে তদন্ত শেষ হলে কোন মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তখন সরকার পক্ষের সাক্ষী হাজির করা নিয়ে চলে টালবাহানা। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নাই।
ফলে ধর্ষণের শিকার একজন নারী এবং তার পরিবারকে দীর্ঘসূত্রিতার ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান নারী নির্যাতন মামলার দীর্ঘসূত্রিতার বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিচার থেকে শুরু করে তদন্ত – প্রতিটি পর্যায়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি।
“হাইকোর্ট কিছুদিন আগেও একটা পর্যবেক্ষণে স্ট্রংলি বলেছেন, আইনে ১৮০ দিনের যে বিধান রয়েছে, সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এটা যতটা কার্যকরভাবে তদারক করার কথা, সেটা আমরা দেখতে পাই না।”
তিনি বলছেন, “আরেকটা মামলায় হাইকোর্ট বিভাগই বলেছেন যে, একটা মনিটরিং সেল হবে। কিন্তু দুই বছর হয়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে আমরা একটা শিথিল মনোভাব লক্ষ্য করে আসছি। এটা একটা বিরাট অন্তরায়।”
এখন অবশ্য দেশজুড়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনের বিধিমালা তৈরি এবং বিচার প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবস্থাগুলো দৃশ্যমান হবে। তিনি সাক্ষী সুরক্ষার ব্যাপারেও নতুন আইন করার কথাও উল্লেখ করেছেন।
“আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ করবো, তিনি যেন নারী ও শিশু ট্রাইবুনালের বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য একটা প্র্যাকটিস ডাইরেকশন দেন। যাতে তাড়াতাড়ি মামলাগুলো শেষ হয়।”
“এর পাশাপাশি প্রসিকিউটরদের ডাইরেকশন পাঠাচ্ছি, ধর্ষণ মামলায় তারা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হন, সেগুলো যেন চিহ্নিত করা হয় এবং চিহ্নিত করে তারপর ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
ডিএনএ টেস্ট নিয়ে জটিলতা
সরকারি তথ্য অনুযায়ীই ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া নারী নির্যাতনের বেশিরভাগ মামলা হয় যৌতুক নিয়ে পরিবারে নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগে।
এই অভিযোগের ক্ষেত্রে আপোষের মাধ্যমে মীমাংসার বিষয় আইনে যুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা এটিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন।
তবে এখন আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আনার পাশাপাশি আরেকটি বড় পরিবর্তন করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারী এবং অভিযুক্তের ডিএনএ পরীক্ষা। এনিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
তাসলিমা ইয়াসমিন মনে করেন, এই ডিএনএ পরীক্ষার বিষয়টি দ্রুত বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
“ডিএনএ টেস্ট করার জন্য একটা বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিচারক মনে করতে পারেন যে, এই সুনির্দিষ্ট মামলাটির ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন রয়েছে। তখন একজন বিচারক চাইলে ডিএনএ টেস্টের জন্য বলতে পারেন।”
“কিন্তু যদি আমি বলে দেই যে, সব মামলাতেই ডিএনএ টেস্ট করা হবে, এটা আসলে কতটুকু প্র্যাকটিক্যাল? যেমন যেসব মামলায় ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন নাই, সেখানে ডিফেন্স থেকে স্বাভাবিকভাবেই সুযোগ নিতে পারে। ডিফেন্স সেই সুযোগ নিতে পারে যে, যতক্ষণ না ডিএনএ টেস্ট করানো হচ্ছে, ততক্ষণ মামলার বিচার সহজে পেছানো যাবে।”
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ডিএনএ পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো আসলে কতটা রিসোর্সফুল। ঢাকার যে কোন একটা ট্রাইবুনালে অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে যদি অন্তত দুই হাজার মামলাও ডিএনএ টেস্টের জন্য যায়, ল্যাবগুলোর সেই সক্ষমতা আছে কিনা-সেটাও বিবেচনা করার বিষয়।”
তবে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, বাস্তবতা বিবেচনা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচারের ট্রাইবুনালের একজন পাবলিক প্রসিকিউটর বা পিপি সালমা হাই বলেছেন, অভিজ্ঞতা থেকে তিনি মনে করেন যে ডিএনএ পরীক্ষার কারণে সঠিক বিচার পাওয়া যাবে।
“ধরেন একটা মেয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলো। কিন্তু অভিযুক্ত তা অস্বীকার করলো। এখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এখানে অস্বীকার করার কোন সুযোগ থাকবে না।”
নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ও হেনস্তার অভিযোগ
ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে একজন নারীকে মামলা করা এবং তদন্ত থেকে শুরু করে লম্বা সময় ধরে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এগুতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু বিচারে গিয়ে সেই নারীকে তার চরিত্র নিয়েও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
বিবিসি বাংলা
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন