পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন : বিজয়ী মমতার সামনে কি আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ?
মোঃ মাহমুদ হাসান | অমিত শাহ ম্যাজিক মেকার, সাবেক সর্ব ভারতীয় দলীয় প্রধান ও বিজেপির আধ্যাত্মিক গুরু। নরেন্দ্র মোদি মৌলবাদ কে ব্যবহার করে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সফল হিন্দুত্ববাদের অগ্রনায়ক, একজন প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্ধ শতাব্দীর ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের চেহারা কে বদলে দিতে এই দুই মহীরুহ ম্যাজিকের মতোই কাজ করেছেন, ঈর্ষণীয় সাফল্য ও অর্জন করেছেন। সর্ব ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির বাগান কে তছনছ করে দিয়ে, ভারতবর্ষের উত্তরাধিকারের রাজনীতির আদর্শ গান্ধী পরিবার কে হঠিয়ে রেকর্ডসম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দাপটে উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ কে অবিরত বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তাই হিন্দুত্ববাদ তথা সামপ্রদায়িকতার সম্প্রসারণে এবারের পশ্চিম বাংলার নির্বাচন মোদি-অমিত শাহদের জন্য ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার মানসে সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রেকর্ড সংখ্যক বার পশ্চিম বাংলা সফর করেছেন মোদি। প্রতিটি সফরেই একদিকে ধর্মীয় আবরণ আর অন্যদিকে ক্ষমতার চাণক্য কে ব্যবহার করে জনতা কে কাছে টানার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় এনআরসি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা মমতা কে সরিয়ে বিজেপি কে বিধান সভার নেতৃত্বে আনতে মরিয়া, বিজেপি কি পশ্চিম বাংলায় হেরে গেছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস কি সত্যি জিতে গেছে? মমতার বিজয় কি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্ম নিরপেক্ষতার বিজয়?
২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪ টি আসনের মধ্যে ২১১ টি আসনে বিজয়ী তৃণমূল কংগ্রেস ২০২১ সালে এসে ৪৭.৯৪% ভোট পেয়ে ২১৩ টি আসনে জয়ী হয়ে বিজয়ের ধারাবাহিকতা কে অব্যাহত রেখেছে। বিপরীতে বিজেপি ২০১৬ সালের নির্বাচনে মাত্র তিনটি আসন পেলেও, এবারের নির্বাচনে ৭৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে ৩৮.১৩% ভোট পেয়ে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে। বিগত নির্বাচনের তুলনায় তৃণমূলের মাত্র দু’টো আসন বাড়লেও বিজেপির অর্জন ৭৪ টি বাড়তি আসন। আরও ৬৫ টি আসনে বিজেপি প্রার্থীরা খুব সামান্য ব্যবধানে ই হেরেছেন। তুলনামূলক এই বিশ্লেষণে কি বলা যাবে সাম্প্রদায়িকতা হেরেছে? ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী কংগ্রেস আর অসাম্প্রদায়িক বাম দলগুলো মিলে ২০১৬ সালে ৭৬ টি আসন পেলেও এবারে তাদের অর্জন শুন্য। তাই তো অধ্যাপক আশীষ চক্রবর্তী ডয়েচে ভেলের আলোচনায় বলেছেন, আসনের হিসেবে বিজেপি হারলেও তাদের অর্জন আকাশছোঁয়া। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস আর বামদলের দৃশ্যপটের বাইরে চলে যাওয়া আর বিজেপির আকাশচুম্বী অর্জন, ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িক বাংলার জন্য নিতান্তই অশনি সংকেত। তাহলে পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে জিতলো কে? সাম্প্রদায়িকতা নাকি অসাম্প্রদায়িকতা?
যুগ যুগ ধরেই বংশ পরস্পরায় অসমীয়া হয়েও বিজেপির তথাকথিত এনআরসি আর নাগরিক পঞ্জির নামে অসম প্রদেশে ১৯ লক্ষ বাঙলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আজ নাগরিকত্ব তথা পরিচয় সংকটে নিপতিত। মমতার নেতৃত্বে তীব্র প্রতিরোধের মুখে বিজেপি পশ্চিম বাঙলায় এনআরসি না করতে পারলেও জেপি নাডডা, অমিত শাহ আর মোদিদের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় এখনো এটি প্রাধিকারের শীর্ষে। বাঙালি তথা মুসলিম বাঙালিদের রাষ্ট্রহীন করার এই হীন প্রচেষ্টা টি পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা বুঝতে পেরেছেন ভোটের ফলাফলেই যার স্পষ্ট প্রমাণ মিলে। তাই তো আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ভোট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বিবিসি কে বলেছে, ‘সংখ্যালঘুরা একাট্টা হয়েই তৃণমূল কে ভোট দিয়েছে’।
সোশ্যাল মিডিয়া আর গনমাধ্যমের তথ্যে এটি স্পষ্ট এবারের পশ্চিম বাংলার নির্বাচন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বেশ নাড়া দিয়েছে। আর বিবিধ কারণে এ নির্বাচন টি বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও ছিল বটে। তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে আগ্রহীদের একটি অংশের মনোযোগ ছিল, পশ্চিম বাংলায় পরিবর্তন হলে হয়তো বা তিস্তা সমস্যার জট খুলবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রসারণবাদ নিয়ে ওদের কোন মাথাব্যথা ছিলো না। আর একটি বৃহত্তম অংশ উগ্র হিন্দুত্ববাদ তথা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জনগোষ্ঠী যারা মনে প্রাণে জয় বাংলার খাঁটি বাঙালি মমতার বিজয় দেখতেই প্রহর গুনছিল। এদের ভাবনায় ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের মাটিতেও উত্তাপ ছড়াতে পারে, এনআরসির বিষক্রিয়ায় পশ্চিম বাংলা আক্রান্ত হলে এর স্নায়বিক চাপে বাংলাদেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর একটি অংশ ছিল আমেজি জনগোষ্ঠী ভোটের টানটান উত্তেজনায় যারা পুলকিত হয়। দীর্ঘদিন স্বদেশে এই পুলকিত হওয়ার সুযোগ বঞ্চিত বাঙালী বাংলা ভাষাভাষী পশ্চিম বাংলার নির্বাচন কে উপভোগ করেছে দারুণভাবে।
বিজেপির মতাদর্শ নির্ধারক হিসেবে পরিচিত আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ অত্যন্ত সুনিপুণ পরিকল্পনা নিয়ে সাধারনের মাঝে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বিস্তৃতির কাজটি করে থাকে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ধাপ পেরিয়ে ক্যাডার ভিত্তিক এই সংগঠনটিতে বিস্তারক বা প্রচারক হয়ে উঠা বেশ কঠিন কাজ। তবুও পশ্চিম বাংলায় গত কয়েক বছরে এদের সংখ্যাটি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পিছনে আরএসএস এর একটি গভীর সংকল্প কাজ করছে। আরএসএস বিশ্বাস করে তাদের প্রতিষ্ঠাতা ড. কেশব বলীরাম আর আর হিন্দু মহাসভা ও ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর জন্মভূমিতে পশ্চিম বঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো সম্ভব। জেপি নাড্ডা, অমিত শাহ আর মোদিসহ শীর্ষ নেতাদের অগনিত বার বাংলা সফর আর নির্বাচনী প্রচারে শ্যামাপ্রসাদ আর কেশব বলীরাম কে স্মরণ করে এরা মুলত আরএসএস এর সংকল্পের কথাটিরই জানান দিয়েছেন। শেষকথা হলো, ক্ষমতায় না আসতে পারলেও এই সাম্প্রদায়িক শক্তি গত নির্বাচনের চেয়ে ৭৪ টি আসন বেশি আর পাশাপাশি ৬৫ টি আসনে খুবই অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়ে প্রমাণ করেছে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি জয়ী হলেও সাম্প্রদায়িকতা হারেনি। কেশব বলীরাম আর শ্যামাপ্রসাদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর খুব সন্নিকটেই তাদের অবস্থান।
অত্যন্ত সাদামাটা জীবনের অধিকারী একজন খাটি বাঙালি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মতো ক্যারিশমাটিক গুণাবলীর নেতৃত্ব আজকালকার রাজনীতিতে বিরল। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জনগন বিশ্বাস করে বাঙলা আর বাঙালির অধিকার আদায়ে তাঁর কোন বিকল্প পশ্চিম বাংলা তথা ভারতবর্ষে নেই। তাই ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে বাঙালিদের ঐক্যের ফসল মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলের বিজয়ের এই ধারাবাহিকতা। সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি সর্ব ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার বিপরীতে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ যে আগামী দিনে আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়!! জয় বাংলার বিজয়ে বাংলাদেশের জনগনও আনন্দে উদ্বেলিত। দুই বাংলার এই আনন্দ কে চিরস্থায়ী করতে দ্বিপক্ষীয় ঝুলে থাকা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান দ্রুত সম্প্রসারণশীল উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রতিরোধে ও একযোগে কাজ করতে হবে।।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন : বিজয়ী মমতার সামনে কি আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ? লেখকঃ কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান