ফিচার্ড মত-মতান্তর

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মহাকাব্য ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’

বাংলাদেশের-ভবিষ্যৎ-কি
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মহাকাব্য ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’

।।শিতাংশু গুহ।। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-কে নিয়ে লেখা, কবিতা, সাহিত্য, গল্প, নাটক বা আরো কত-কি আছে, কিন্তু মহাকাব্য কেউ লিখেননি, সেই সাহস দেখিয়েছেন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু’র জন্মস্থান গোপালগঞ্জের আর এক কৃতি সন্তান কবি নিখিল কুমার রায়। তাঁর মহাকাব্যের নাম ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’, এর ইংরেজী নাম, ‘In the Bengal of Sheikh Mujib’। তারমতে একজন বাঙ্গালী কবি এই প্রথম একজন বাঙ্গালী মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি অমর ‘মহাকাব্য’ রচনা করেছেন। আরো পরিষ্কার ভাবে বললে, কবি নিখিল রায় বাঙ্গালী, তাঁর মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী। এই ঘটনা এই প্রথম। তিনি বাল্মীকি রচিত ‘রামায়ণ’ এবং মহর্ষি ব্যাসদেবের ‘মহাভারত’-এর কথা এনেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ অথবা মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, এখানে লেখক-কবি বাঙ্গালী বটে, কিন্তু মহানায়করা কেউ বাঙ্গালী নন! কথা কিন্তু সত্য। অকাট্য যুক্তি।

‘শেখ মুজিবের বাংলায়’ কেন মহাকাব্য এ ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। ১৯২ পাতার এ মহাকাব্যের পর্বে পর্বে বঙ্গবন্ধু’র জন্ম থেকে মৃত্যু’র ঘটনা সাজিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, পুরানো ছন্দে সাঁজানো হয়েছে এ যুগের এক মহানায়কের কাহিনী। ছন্দ হিসাবে ব্যবহার করেছেন, চতুর্দশপদী, অক্ষরবৃত্ত, ছন্দবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও পয়ার। মহাকাব্যের ব্যাখ্যায় জিএম গেলে (G.M.Gayley)’র সংজ্ঞা টেনেছেন। গ্রিসের মহাকবি হোমার’র ‘দি ইলিয়াড’ (Illiad) এবং ‘ওডিসি’-র (Odyssey) প্রসঙ্গ এনেছেন। বাদ যায়নি ‘হেলেন অফ ট্রয়’ অথবা রোমের মহাকবি ভার্জিলের (Virgil) ‘এনিইড’ (Aeneid)। ব্রিটেনের মহাকবি মিল্টন (Milton)’র  প্যারাডাইজ লষ্ট এবং প্যারাডাইজ পুনরুদ্ধার (‘Paradise lost’ & ‘Paradise regained) এসেছে। কবি নিখিল কুমার তাঁর কাব্যগ্রন্থকে দশটি পর্বে বিভক্ত করেছেন, বিভাজনের মধ্যে তিনি ঐক্যও টেনেছেন। এক মহানায়কের জীবনী, বিবিধ ঘটনা, বহুবিধ চরিত্র, ভিন্নভিন্ন ছন্দ, উপমা, অলঙ্কার-এ মহাকাব্যের শোভন-শৈলীকে অলংকৃত করেছেন।

পন্ডিতগণ তাঁর ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’ মহাকাব্যকে ‘মহাকাব্য’ হিসাবে স্বীকৃতি দেবেন কিনা সেই সংশয় কবি নিখিল কুমার রায়ের আছে। তারমতে, তিনি চেষ্টা করেছেন, পুরানো আঙ্গিক ও রচনাশৈলী ব্যবহার করে আধুনিক বিষয়বস্তু ‘বঙ্গবন্ধু’-কে নিয়ে এ মহাকাব্য উপহার দিতে। মহাকাব্যের গঠনগত দিক, শুরু, মধ্যবস্থা, শেষ–এতে আছে। মূল চরিত্র একজনই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কাব্যের বিস্তৃতি ৫৪বছর ৭মাস ১৫দিন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু’র জন্ম থেকে মৃত্যু। দশটি পর্ব হচ্ছে: আবাহন, মহাপুরুষের আগমন, উদ্ভবকাল, বীরের ছাত্রজীবন, সঘন বিপ্লবী, স্বাধীনতা ঘোষণা, পরিকল্পিত গণহত্যা, রাহুমুক্ত বাংলাদেশ, অন্তিমকাল, এবং উপসংহার। এ মহাকাব্যের প্রথম প্রকাশ মার্চ ২০২১, প্রকাশক, কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের ‘আনন্দ প্রকাশন’।

উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতের মিত্রসেনার অনুকূলে, যা সচরাচর কেউ করেনা। শুভানুধ্যায়ী/অনুপ্রেরণা/ সহযোগিতায় দিয়েছেন বন্ধুবান্ধবদের নাম; আছেন বেশ ক’জন আশীর্ব্বাদক এবং গ্রন্থস্বত্ব রেখেছেন পরিবারের সদস্যদের। মুখবন্ধে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, কে এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব? ১৯৩৪ সালে ক্লাশ সেভেনে পাঠকালে বঙ্গবন্ধু ‘বেরিবেরি’ রোগে আক্রান্ত হ’ন বা ১৯৩৬ সালে তিনি ‘গ্লুকোমায়’ আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা ক’জনা জানেন? কবি নিখিল রায় জানান, মুসলমানের মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। তার ভাষায়, পাকিস্তান স্বাধীন হলো, জিন্নাহ হলেন প্রথম উজিরে আজম। তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা আনলেন, ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারী, ৬-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে কুর্মিটোলা বন্দী মেসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অপচেষ্টা, নিহত সার্জেন্ট জহিরুল হক সব কথাই এসেছে। এ মহাকাব্যে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে। কবি স্পষ্টত:ই রায় দিয়েছেন যে, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি ‘১৯৭১ সালে মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ত্রাতা, মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থী ও বীর বাঙ্গালীর মাতা হিসাবে অভিহিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনেছেন। ভয়াল মার্চ, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঘোষণা, রাষ্ট্রীয় পরিষদ গঠন, ১১টি সেক্টর, সবই আছে। পরিকল্পিত গণহত্যার চিত্র এঁকেছেন, শরণার্থীর কথা বলেছেন।

স্বাধীনতা, রাহুমুক্ত বাংলাদেশ, লেঃ জেনারেল নিয়াজীর ভারতীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র কাছে আত্মসমর্পনের প্রসঙ্গ এনেছেন। বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কথা এসেছে, ভুঁইফোড় নেতার হিড়িক তার চোখ এড়ায়নি। প্রতি কবিতায় ছন্দ উল্লেখ করেছেন। পঁচাত্তর এসেছে। ষড়যন্ত্রের কথা এসেছে। এসেছে অন্তিমকালের বর্ণনা। স্পষ্টভাবে ১৪ই আগষ্ট ১৯৭৫ দ্বিপ্রহর, ১৫ই আগষ্ট উষা ছন্দবৃত্ত কবিতায় এঁকেছেন। সব খুনির নাম এসেছে। বাঙ্গালীর বিলাপ বাদ যায়নি। সঘন বিপ্লবী কবিতায় জাতীয় ফুল শাপলার ছবি দিয়ে কবি গেয়েছেন, ‘অগাধ জলে বেড়ে ওঠে এই লাল শাপলা ফুল/শেখ মুজিবুর রহমান যেন তার শিরে মুকুল”। আবার ‘প্রমত্ত সংগ্রামে’ ছন্দবৃত্ত কবিতায় তিনি লিখেছেন, “পাকিস্তানী জান্তার মানবিকতা নাই কভু/বিধর্মী তাড়াতে চায়/মৌলবাদী হায়েনা পরাস্ত করিতে মুজিব সংগ্রামে ছুটে যায়”। ‘কালবরেণ্য শেখ মুজিব’ কবিতায় তিনি শত্রু সম্পত্তি আইনের প্রসঙ্গ এনেছেন, বর্ণনা করেছেন, কেন হিন্দুরা বিতাড়িত। কবি নিখিল রায় বঙ্গবন্ধুকে ‘বিধাতার দান গর্বিত সন্তান’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

আমি কবিতা বুঝিনা, কিন্তু কবি নিখিল রায়ের মহাকাব্য বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। কারণ, একজন বাঙ্গালী হিসাবে মহাকাব্যের মহানায়ককে আমি চিনি। ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’ মহাকাব্যে বাদল কৃষ্ণ সরকার একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন। কবি নিজেই বলেছেন, ‘মুজিবের জীবনী মানে পুরো বাংলার সংগ্রামী ইতিহাস, মহাকাব্যে তাই উঠে এসেছে। ভাষা সংগ্রাম; জেলের দিনগুলো; ‘শেখ মুজিবের জন্মধাম’; ‘কারাগারে দিনগোনা, জাগো বাঙ্গালী জাগো, শ্রেষ্ট বাঙ্গালী, পঁচাত্তর সাল, অনাকাঙ্খিত মহাপ্রয়াণ এবং আঠারো অক্ষরে সনেট, চতুর্দশপদী কবিতা, ছন্দবৃত্ত কবিতা, অক্ষরবৃত্ত সাহিত্যের বিচারে কতটা উন্নীত হবে জানিনা, তবে ইতিহাসের রায়ে বর্তে যাবে। কবি শেষ করেছেন, ‘শ্রেষ্ট বাঙ্গালী’ কবিতা দিয়ে। এর ঠিক আগের কবিতাটি হচ্ছে, ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’-যা দিয়ে এ মহাকাব্যের নামকরণ হয়েছে, এটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। প্রথম পর্বে, ‘বন্দেগী’ এবং ‘নিদানে বিধাতা স্মরণ’ করে ২য় পর্বে ‘মহাপুরুষের আগমন’ ঘোষণা করেছেন। কি নেই এতে? কবি তাঁর মহাকাব্যে বঙ্গবন্ধুকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সাঁজিয়েছেন, এবং তাইতো হবার কথা? তাঁর বর্ণনায় কল্পকাহিনী স্থান পায়নি।

কবি নিখিল কুমার রায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সুরকার, গীতিকার, বংশীবাদক হিসাবে পরিচিতি করেছেন। করোনা-কাল, সবাই গৃহবন্দী, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন কবি। তিনি কলকাতা ছিলেন, অখন্ড অবসর, বাঙ্গালীর সৌভাগ্য তখন তিনি এ মহাকাব্য লিখেছেন। প্রথম প্রকাশ ২০২১, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৮০, এখন ৮১, এখনো প্রচন্ড সক্রিয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। গোপালগঞ্জ মহকুমার কাশিয়ানী থানার গজারিয়ায় জন্ম। ওড়াকান্দির প্রসঙ্গ এনেছেন, সেখানে পড়াশোনা করেছেন। গুরুচাঁদ ঠাঁকুরের অমৃতবাণী ‘শিক্ষাছাড়া এজাতির হবেনা কল্যাণ’ শুনিয়েছেন। এ মহাকাব্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার আসনটি বোঝা যায়। ১৯৯২ সালে আমেরিকা আগমন। বেশ ক’টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আরো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। ‘শেখ মুজিবের বাংলায়’ মহাকাব্যের রচয়িতা কবি নিখিল রায় উপসংহারে বঙ্গবন্ধু’র দুই কন্যা এবং জাতির ওপর প্রত্যাশা রেখেছেন। গেয়েছেন বাঙ্গালীর জয়গান, ‘জাগো বাঙ্গালী জাগো’। তিনি দীর্ঘ সক্রিয় জীবন লাভ করুন এবং বাঙ্গালীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখুন।  সেপ্টেম্বর ২০২২। নিউইয়র্ক। guhasb@gmail.com;

এসএস/সিএ

 


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আমাদের ফেসবুক পেজ   https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান

সংবাদটি শেয়ার করুন