ভিকটিম ব্লেমিং
সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পর এই অপরাধটি নিয়ে নানা ধরণের তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
একদিকে যেমন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি উঠেছে ঠিক তেমনি অন্যদিকে আবার ধর্ষণের পেছনে ভুক্তভোগীদের ভূমিকা বা পরোক্ষ ইন্ধন থাকার মতো বিষয়গুলো নিয়েও কথা বলছেন অনেকে।
এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তারকা অনন্ত জলিলের একটি ভিডিও। যেখানে তিনি নারীদেরকে টি-শার্টের মতো পোশাক পরা নিয়ে কটাক্ষ করেন।
তার মতে, নারীদের এ ধরণের পোশাক ধর্ষণের মতো অপরাধকে উস্কানি দেয়।
তার এই পোস্ট নিয়ে নানা ধরণের ট্রলসহ এর বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছেন অনেকে।
অনেকে বলছেন যে, পোশাক নিয়ে মন্তব্য করে মি. জলিল ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার ব্যক্তিদেরকেই আসলে দোষারোপ করছেন।
তিনি ভিকটিম ব্লেমিং করছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অভিযোগ তুলেছেন।
ভিকটিম ব্লেমিং কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিকটিম ব্লেমিং হচ্ছে এক ধরণের চর্চা। এটা সাধারণত যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, “পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং এতো বছর ধরে চলে আসা নারী বিদ্বেষ, আমাদের সংস্কৃতিতে অনেক শক্তিশালী।”
তিনি বলেন, যখনই কোন ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তখন সমাজের বেশিরভাগ মানুষের নজর চলে যায় যে এটা কেন হল, কনটেক্সটা কোথায়। “প্রশ্ন আসে যে, শাড়ি কিভাবে পড়েছে, শাড়িটা কেমন ছিল, ওড়না ছিল না, এতো রাতের বেলা বের হয়েছে কেন-এগুলো সবই ভিকটিম ব্লেমিং। এর ফলে অ্যাটেনশনটা আর অপরাধীর উপর থাকে না। ভিকটিমের স্বভাব চরিত্রের উপর গিয়ে পড়ে।”
এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ভিকটিম ব্লেমিং দুই ধরণের হয়ে থাকে।
প্রথম ক্ষেত্রে বলা হয় ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে, ভিকটিম চরিত্রহীন, লম্পট, খারাপ- যার কারণে সে মিথ্যা কথা বলছে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে সেটা মিথ্যা। সে হয়তো নিজের ইচ্ছায় গেছে। ব্ল্যাক মেইলিং করতে না পেরে অভিযোগ এনেছে।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জমি-জমা কিংবা পূর্ব শত্রুতার জেরে কোন নারীর স্বজন কিংবা স্বামী কোন কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ বা মামলা দায়ের করে ওই নারীকে জড়িয়ে। আর সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পর ওই নারীকেই দোষারোপ করা হয় যে, সে মিথ্যা বলেছে। অথচ এক্ষেত্রে সে নিজেও স্বজনদের ষড়যন্ত্রের কারণে ভিকটিম।
আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন মনে করেন, ভিকটিম ব্লেমিংয়ের চর্চা সামাজিক অবস্থার সাথে সাথে বিচার ব্যবস্থা বা বিচার প্রক্রিয়াতেও প্রতিফলিত হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমাজের যে পিতৃতান্ত্রিক মন-মানসিকতা তার অংশ সমাজের সব মানুষ। আর সেই সাথে বিচার ব্যবস্থা ও এর বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা রয়েছে তারাও এটার অংশ।
অভিযোগকারীকে সন্দেহ করার এবং অপরাধীকে নিরপরাধ ভাবার যে প্রবণতা, বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে একজন ভুক্তভোগীকে তার মুখোমুখি হতে হয়।
মিজ ইয়াসমিন বলেন, সাধারণ কোন অপরাধের মামলায় একজন অভিযোগকারীকে যত না প্রমাণ দিতে হয়, ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মামলায় তাকে আরো অনেক বেশি প্রমাণ হাজির করে তারপর অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়।
“তখন তাকেও অপরাধীর মতোই তাকে গণ্য করা হয়।”
ভিকটিম ব্লেমিং কেন হয়?
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী সাদেকা হালিম বলেন, আমরা এখনো নারীদের সমাজে অধস্তন হিসেবে ভাবি।
এক ধরণের মনোভাব আছে যে, নারীরা নিজেরা নিজেদের দায়-দায়িত্ব নিয়ে চলাফেরা করবে। কী ধরণের পোশাক পড়বে, কেমন আচরণ করবে, কেমন করে চলাফেরা করবে-তার সবকিছুর দায় দায়িত্ব তাকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, এ ধরণের বিষয়গুলোর সাথে ধর্ষণের ঘটনাকে এক করে ফেলা হয়। সেটাকেও তার দায় বলে ধরে নেয়া হয়।
অনন্ত জলিলের ভিডিওর কথা উল্লেখ করে সাদেকা হালিম বলেন, “অনন্ত জলিল যেসব মন্তব্য করেছে, সে তো ভিকটিম ব্লেমিংকে রি-ইনফোর্স করেছে তার কমেন্ট দিয়ে।”
তিনি বলেন, ধর্ষণ যেমনই হোক না কেন তার বিচার হতে হবে। এক্ষেত্রে সন্ধ্যা সাতটার সময় একজন নারী কোথায় ছিল, সেকি বন্ধুর সাথে ছিল কিনা, সে সিনেমা দেখতে গেছে কিনা-এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এগুলো তার সাংবিধানিক অধিকার।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, এক সময় নারীরা ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করতে চাইতো না লুকিয়ে রাখতো। যার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যেতো।
কিন্তু এখন নারীরা আওয়াজ তুলছে এবং ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগ করছে। যার কারণে অপরাধীর অপরাধ ভিন্ন পথে ঘুড়িয়ে দেয়ার জন্য ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হয়।
বলা হয় যে, তার পোশাক ভাল ছিল না, ও রাতের বেলা গিয়েছিল, ছেলে বন্ধুর সাথে ছিল ইত্যাদি নানা ধরণের পাল্টা অভিযোগ তোলা হয়।
“যাতে করে অপরাধটাকে অপরাধীর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে ভিকটিমের দিকে দিয়ে অপরাধীকে আড়াল করা যায় বা অপরাধীর অপরাধকে লঘু করা যায়। আর এই ক্যাচালের মধ্য থেকে অপরাধী পার পেয়ে যায়,” তিনি বলেন।
তিনি মনে করেন, এই ধরণের চর্চা চলতে থাকলে, ভুক্তভোগী আরো বেশি করে শিকার হওয়ার ভয়ে অভিযোগ বা প্রতিবাদ করবে না, পাশাপাশি যে অপরাধী সে নিশ্চিন্ত মনে অপরাধ চালাতে থাকবে।
“ফলে অপরাধের যে অভয়ারণ্য সেটি মুক্ত হয়ে যাবে। আর এর ফলাফল হবে মারাত্মক।”
এটা বিচার ব্যবস্থায় কতটা প্রভাব ফেলে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, বাংলাদেশের আইনে বলা আছে যে যদি কোন বিচারক মনে করেন যে কোন ভিকটিমের জবানবন্দীই বিচারের জন্য যথেষ্ট, তাহলে তিনি সেই জবানবন্দী অনুযায়ী রায় দিতে পারেন। এটা নিয়ে আইনে কোন বাধা নেই।
কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোন কিছু তো হয়ই না, বরং উল্টো জবানবন্দী ছাড়াও তাকে নানা ধরণের প্রমাণাদি দিয়ে সেটা প্রমাণ করতে হয়। যার কারণে ধর্ষণ মামলার বিচারের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশে।
জবানবন্দীতে যখন সন্দেহ এতো বেশি, এটা হয়ে থাকে ভিকটিম ব্লেমিংয়ের বিষয়টি থেকে। এটা শুধু সামাজিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলে তা নয় বরং বিচার ব্যবস্থার উপরও প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, সামাজিক প্রভাবটা বিচার ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে। এটা যখন বিচারে ঢুকে যায় তখন তার প্রভাব ন্যায়বিচার পাওয়ার উপরও থাকে। যখন জবানবন্দীর উপর সন্দেহ থাকে তখন প্রমাণাদির গুরুত্ব বাড়ে। আর তখন একটু এদিক-সেদিক হলেই অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান বলেন, এক সময় বাংলাদেশে তোলপাড় হয়েছিল যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলা হয়েছিল।
তিনি জানান, তখন তারা একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছেন যে, এই অভিযোগের কারণে অনেক নারীই আসলে আইনের আশ্রয় নিতে পারছে না।
তিনি বলেন, ভিকটিম ব্লেমিংয়ের কারণে প্রথমত থানায় কর্মকর্তারা অনেক সময় ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মামলা নিতে গড়িমসি করে।
দ্বিতীয়ত এটি যখন আদালতে গড়ায়, তখন আসামীপক্ষের আইনজীবী ভুক্তভোগীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কারণ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, আসামীপক্ষের আইনজীবীর অবাধ স্বাধীনতা থাকে ভুক্তভোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার। তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার।
যার কারণে সাক্ষীর উপর চাপ পড়ে এবং মামলাটি অনেক সময় দুর্বল হয়ে যায় বলে জানান আইনজীবী এলিনা খান।
বিচার শেষ হওয়ার পর যদি আসামী পার পেয়ে যায় প্রমাণাদির অভাবে তাহলে সব দোষ তখন ভুক্তভোগীর উপর এসে পরে এবং ওই নারী সম্পর্কে সবার খারাপ ধারণা জন্মায়। কিন্তু সে যে একই সাথে ভিকটিম এবং বিচারও পায়নি সেটি কেউ বিবেচনায় নেয় না।
সমাজবিজ্ঞানী সাদেকা হালিম মনে করেন, ভিকটিম ব্লেমিং যে কোন অপরাধের ঘটনাকে হালকা করে দেয়।
তিনি বলেন, এর কারণে কোন অপরাধের তদন্ত, তার বিচার এবং অন্য আইনি বিষয়গুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে ভিকটিম ব্লেমিং। এমনকি তদন্তের মোড়ও অনেক সময় এর কারণে ঘুরে যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিকটিম ব্লেমিংয়ের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, বিচার ব্যবস্থার সাথে যারা জড়িত তাদের ধর্ষণের প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রো-ভিকটিম অ্যাপ্রোচ বা অভিযোগকারীর প্রতি সহানুভূতিশীলতা বাড়ানো দরকার। আর এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট পদক্ষেপ নিতে পারে বলে মনে করেন তারা।
সূত্রঃ বিবিসি
বাঅ/এমএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন