ভূমিকম্পে শিশুসহ নিহত ৬, আহত দুই শতাধিক
গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে দেশের তিন জেলায় শিশুসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুরে আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের পুলিশ ক্যম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ৬ শিক্ষার্থীসহ ৪১ জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ ৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এছাড়া পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে ১০ জনকে নেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরেও আহত হয়েছেন অনেকে।
শুক্রবার ছুটির দিনের সকালে ১০টা ৩৮ মিনিটে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭; উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে।
২৬ সেকেন্ড স্থায়ী এ ভূমিকম্পে প্রাথমিকভাবে আতঙ্ক ছড়ায়, বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। এরপর আসতে থাকে প্রাণহানি আর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য।
এই ভূখণ্ডে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেরও ইতিহাস রয়েছে। তবে গত কয়েক দশকের মধ্যে এমন প্রাণঘাতি ভূমিকম্প দেশের মানুষ আর দেখেনি।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে এ ভূমিকম্পটি হয়েছে, ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটে। ভূমিকম্পের কম্পনের তীব্রতা ছিল বেশ। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
হতাহতের চিত্র
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকার একটি ৮ তলা ভবনের পাশের দেয়াল এবং কার্নিশ থেকে ইট ও পালেস্তারা খসে নিচে পড়ে, যেখানে একটি গরুর মাংস বিক্রির দোকান ছিল।
সেখানে থাকা ক্রেতা ও পথচারীরা আহত হন। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা ৩ জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন নিহতরা হলেন- আনুমানিক ২২ বছর বয়সী রাফি উল ইসলাম, হাজী আবদুর রহিম (৪৭) ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন রিমন (১২)।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার একটি ভবনের দেয়াল ধসে দশ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার সকালে উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকায় এ ঘটনায় শিশুটির মাসহ আরও দুজন আহত হন।
নিহত শিশু ফাতেমা ওই এলাকার আব্দুল হকের মেয়ে; তিনি ঢাকার শ্যামবাজারে ব্যবসা করেন।
নরসিংদীতে পলাশ উপজেলার মালিতা গ্রামে মাটির ঘরের দেয়াল ধসে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির প্রাণ গেছে বলে পলাশ থানার ওসি মনিরুল ইসলাম।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেছেন, নিহতের নাম তাৎক্ষনিকভাবে জানা যায়নি, তার বয়স ৬৫ বছর।
নরসিংদী সদর থানার গাবতলি এলাকায় বাড়ির সানশেড ভেঙে পড়ে আহত হয় ১০ বছর বয়সী ওমর তার দুই বোন ও তার বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল। দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওমরের মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের পুলিশ ক্যম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানিয়েছেন।
উজ্জ্বল গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
শুক্রবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে স্বজনরা তাদের দুজনকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে।
ওমরের চাচা জাকির হোসেন বলেন, ভূমিকম্পের সময় দেলোয়ার হোসেন তার এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছিলেন। এসময় বাসার সানসেট ভেঙে তাদের উপড় পড়ে দুইজন গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা তাদেরকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বাবা ও ছেলেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলে চিকিৎসক ছেলে ওমরকে মৃত ঘোষণা করেন।
দেলোয়ারের আহত দুই মেয়ে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি আছে বলেও জানান তিনি।
তাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায় উত্তর পাড়া গ্রামের। বর্তমানে নরসিংদী গাবতলী এলাকায় ভাড়া থাকতেন তারা।
এদিকে গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজের উপ-পরিচালক আব্দুল সালাম সরকার বলেন, এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ভূমিকম্পে কম বেশি আহত হয়ে ১৫-২০ জনের মত এ হাসপাতালে এসেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের তিনতলা ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের চারতলা থেকে নিচে লাফ দিয়ে তিন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এছাড়া সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা ভেঙেছেন ছাত্রদল নেতা তানভীর বারী হামিম, আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
কলাবাগানের লেক সার্কাস রোড, হাতিরপুল, সেন্ট্রাল রোড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, এলিফেন্ট রোড, মিরপুর, গুলশান, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়, মানুষকে দ্রুত ভবন ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় কে কার আগে নামবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিও হয়।
ফায়ার সার্ভিসের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা
বেলা ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
১. আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকায় ৮ তলা ভবন ধসে পড়ার খবর পেয়ে সদরঘাট ও সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট সেখানে যায়। তারা দেখতে পায় পলেস্তারার কিছু আলগা অংশ এবং কিছু ইট খসে পড়েছে। ভবনের কোনো ক্ষতি হয়নি।
২. খিলগাঁও নির্মাণাধীন ভবন থেকে পার্শ্ববর্তী দোতলা একটি ভবনে একটি ইট পড়ে একজন আহত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
৩. বারিধারা ব্লক-এফ, রোড-৫ এ একটি বাসায় আগুনের খবর পাওয়া যায়। বারিধারা ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট সেখানে গিয়ে আগুন নেভায়। ভূমিকম্পের কারণেই ওই আগুন লেগেছিল কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
৪. সূত্রাপুর স্বামীবাগ আট তলা একটি ভবন অন্য একটি ভবনে হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। সূত্রাপুর ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেছেন।
৫. প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই।
৬. কলাবাগানের আবেদখালী রোডে একটি ৭ তলা ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশন থেকে একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ভবন ঠিক আছে, লোকজন আতঙ্কিত হয়ে ফোন করেছিল।
৭. মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় একটি বাসা বাড়িতে আগুন লাগে। গজারিয়া ফায়ার স্টেশন থেকে দুটি ইউনিট সেখানে গেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত
ভূমিকম্পের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি।
বোর্ড জানিয়েছে, উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।
পিডিবি এক বার্তায় বলেছে, শক্তিশালী ভূমিকম্পজনিত কারণে দেশের বিভিন্ন স্হানে অবস্থিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও সরবরাহ ব্যবস্হায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কিছু সময়ের জন্য বিঘ্নিত হয়েছে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক।
-বাংলাদেশ জার্নাল




