মহারাসলীলা আজ: কমলগঞ্জে উৎসবের আমেজ
আজ শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) অনুষ্টিত হচ্ছে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা উৎসব। এ উৎসবে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর এলাকার মণিপুরীদের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। উৎসবের স্থায়িত্বকাল একটি রজনী। একটি রজনীকে কেন্দ্র করে মণিপুরীদের সংস্কৃতির এক বিশাল মিলন মেলায় পরিণত হয়। রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরের মণিপুরী পাড়া সমুহে চলছে প্রস্তুতি ও উৎসবের আমেজ। রং ছড়িয়ে মন্ডপ সমুহকে সাজানো হচ্ছে নতুন সাজে। রাসের দিন দুপুরে উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। রাতে জোড় মন্ডপে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা।
রাস উৎসবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্মের হাজার হাজার লোক মেতে উঠবে আনন্দ-উৎসবে। উৎসব উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন ছুটে আসেন। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়াম-প প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের আয়োজনে ১৭৯তম এবং আদমপুর মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের মহারাসলীলা উদযাপন কমিটির আয়োজনে ৩৬ তম রাসোৎসব পালিত হবে। উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। রাতে জোড় ম-পে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা। অপরদিকে উৎসবস্থল আদমপুরেও থাকবে যথারীতি রাখাল নৃত্য ও রাসলীলা। তবে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ এরা আলাদা স্থানে আয়োজন করলেও উৎসবের অন্ত:স্রােত, রসের কথা, আনন্দ-প্রার্থনা সবই একই। উৎসবের ভেতরের কথা হচ্ছে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সত্যসুন্দর মানবপ্রেম।
জানা যায়, রাস উপলক্ষ্যে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। রাস উৎসবকে সফল করতে প্রায় মাস খানেক ধরে কয়েকটি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। মাধবপুরে তিনটি জোড় মন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাসলীলা দুই ভাগে বিভক্ত : গোষ্ঠলীলা ও রাসলীলা। গোষ্ঠলীলায় কৃষ্ণের বাল্যকালে মাঠে মাঠে বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চড়াবার মুহূর্তগুলো অনুকরণ করা হয়। গোষ্ঠলীলাকে ‘রাখালনৃত্য’ বা ‘রাখোয়াল’ বলা হয়ে থাকে। রাসলীলায় অভিনীত হয় ‘গোপীনৃত্য’। গোপীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের লীলাখেলাকেই এই পর্বে অভিনয় করে দেখানো হয়। রাসলীলাকে ‘পূর্ণিমারাস’ও বলা হয়ে থাকে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে একদিনের এই আনন্দে। রাসোৎসবকে ঘিরে মাধবপুর ও আদমপুরের ম-পগুলো সাজানো হয়েছে সাদা কাগজের নকশার নিপুণ কারুকাজে। করা হয়েছে আলোকসজ্জাও। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। রাত ভর চাঁদের আলোয় মায়াবী জোৎনায় নূপুরের সিঞ্চনে মুদ্রা তুলবে সুবর্ণ কঙ্কন পরিহীতা রাধা ও গোপিনী রূপের মণিপুরী তরুনীরা। সুরের আবেশে মাতাল হয়ে উঠবে কমলগঞ্জের প্রকৃতি ও জনমানুষ।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, রাস উৎসবকে সফল করতে প্রায় মাস খানেক ধরে ছয়টি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। তিনটিতে রাসনৃত্য ও তিনটিতে রাখাল নৃত্য। মাধবপুরে তিনটি জোড়া মন্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি মন্ডপে আছেন একজন পুরোহিত। সেই পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধান মতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষককে সহযোগিতা করতে একজন সহকারী প্রশিক্ষক আছেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের ঠিক করেন। এরপর সামাজিক বিধান মতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। গোপীবেশী এই শিল্পীদের বয়স ১৬ থেকে ২২ বছর। শুধুমাত্র রাধার বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর। নৃত্যের প্রতিটি দলে নুনতম ১২ জন অংশ নিয়ে থাকে। একইভাবে রাখাল নৃত্যেরও প্রতিটি দলে ২০ থেকে ২২ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালক অংশ নিয়ে থাকে।
মাধবপুর ও আদমপুরে রাসলীলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, মহারাসলীলাল মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টা থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালক বেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। এই রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুরলীলাই কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা। রাস অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ ভাবে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পালিত হয়।
মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, রাস উৎসব আনন্দময় করতে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারের রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের কাছে হেমন্তকাল মানেই রাস-পূর্ণিমা, রাস উৎসব। তিনি আরো বলেন, এবারের রাস উৎসবের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি।
আদমপুর মহারাসলীলা উদযাপন কমিটির অন্যতম নেতা ইবুংহাল সিংহ শ্যামল বলেন, ‘আমাদের সকল আয়োজন এখন শেষ পর্যায়ে। উৎসব সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হবে।’
রাসলীলায় মণিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জেই নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মণিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরীদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাসলীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাসলীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান