পায়ে পায়ে শুনি মৃত্যুর গর্জন …….
নিঃশব্দ মৃত্যু চলে পায়ে পায়ে নিজের ছায়ায়। আমাদের যত পাপ, যত হিংসা, যত দ্বেষ, যত রক্তপাত যেন প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হয়ে স্থবির করেছে বিশ্ব,জীবন কে বিদ্রুপ করে দাবিয়ে বেড়াচ্ছে মরণঘাতী ভাইরাস পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। আমাদের অভিজ্ঞতায় যা আগে কখনো দেখিনি বটে তবে কালে-কালে এরা কেড়ে নিয়েছে লক্ষ-লক্ষ প্রাণ ভিন্ন ভিন্ন নামে উৎস প্রায় একই রকম। সময়ের মহাদূর্যোগের সাগর পারি দিয়েছে মানুষ তীরের খোঁজে। মৃত্যুর বিভৎসতায় মুষড়ে পরেছে সভ্যতা তবে আমাদেরকে মানবিক হতে শিখিয়েছে প্রতিটি মহামারীতেই।
১৮৯৯ সনে কলকাতায় প্লেগ মহামারী আকার ধারণ করলে জীবের মাঝে ঈশ্বর সেবায় নামেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর কাছেই ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের কথা শুনে ভারতকে আপন করে সুদুর ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন সমাজকর্মী মার্গারেট এলিজাবেথ। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে যার নাম হয় ভগিনী নিবেদিতা আর রবীন্দ্রনাথ যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন লোকমাতা। সেই নিবেদিতা মহামারিতে স্থানিয় যুবকদের নিয়ে রুগীর সেবা সুশ্রুষা ও নালা পরিস্কারের কাজ করেছিলেন। পথে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু আরো সমাজ হিতৈষী লোকেরা। তখন আজকের মত সোশ্যাল মিডিয়া ছিলনা, যোগাযোগের মাধ্যম ছিল তার কিংবা চিঠি।
আজকে আমরা যে কোয়ারিন্টিনের কথা বলছি সেও এসেছে ১৪শ শতকের প্রথম প্লেগ থেকে। তখন ইউরোপে প্লেগের মহামারী দেখা দিলে, প্রায় ১৯/২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। প্লেগের সংক্রমন ঠেকাতে ভেনিস নগরের কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করে বন্দরে কোন জাহাজ ভীরলে যাত্রীদের ৪০ দিন সমুদ্রে নোঙ্গর করে রাখতে হত চল্লিশ শব্দের ইটালিয়ান ভাষা কোয়ারান্তা। সেই সময়টিকে বলা হতো কোয়ারান্তিনো। সেই থেকে কোয়ারান্টিন শব্দটি। কিন্তু শুধুকি জানলে হবে, দেখতে হবে।
প্রতিটি দুর্যোগ মহামারিতে সমাজের প্রতিটি মানুষ, নিজেদের স্বজন প্রতিজনের কাছেই কোন না কোন গল্ল থাকে কোনটা সচেতনতার তো কোনটা মানবতার। আজ ২০২০ এ করোনা ভাইরাসের তান্ডবে আমরা টরন্টো শহরে ঘরে অবরুদ্ধ । প্রভিন্স জুড়ে স্টেইট অব ইমার্জেন্সি। শুধু ঘরে বসে(সেল্ফ আইসোলেশন) থেকে পুনরায় জীবন ভিক্ষা পাওয়ার চেষ্টা থেকে আমরা বঞ্চিত হবো কেন? সচেতন হয়ে সম্মিলিত ভাবে আমরাই পারি এর মোকাবেলা করতে।
“মূর্ছিত-বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন,
ওরি মাঝে পথ চিরে চিরে, নূতন সমুদ্রতীরে,
তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি”
দায়িত্বশীলতার দৃষ্টান্ত হয়ে কাজ করছেন আমাদের আশেপাশে অনেকেই। শুধু কুশল জানতে গিয়ে আজ কথা হয়েছিল আবৃত্তিকার সাংস্কৃতিক কর্মী মুনিরা সুলতানা মিলির সাথে। তাঁর বাবা-মা এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। এয়ারপোর্ট থেকে টেক্সি নিয়ে এসে মেয়ের বাসায় নিচতলায় কোয়ারিন্টিনে আছেন। মিলি যখন বলছিলেন দাদা এতদিন পড়ে বাবা-মাকে চোখের সামনে দেখেও দুর থেকে কথা বলতে হচ্ছে, হিমাঙ্কের কতটা নিচে নামলে বুকের ভিতরে ভাব আর ভক্তির লোনা জল জমাট বেঁধে বরফ হয় তা আঁচ করতে পেরেছি তার সাথে কথপোকথনে।
সাবলিল লেখা দিয়ে নিজের কোয়ারিন্টিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে মুক্তি প্রসাদ যা আমরা ইতিমধ্যেই ফেইসবুকে পড়েছি। মুক্তি দেশ থেকে আসার পর অনেকের মত আমিও আসার সংবাদ পাই তার টেলিফোনে, “দাদা এই মাত্র আসলাম” কুশল জেনে বলল পরে আগামী অনুষ্ঠানের আপডেট দিও। একই দিন ভালবাসার আর কেয়ারিং এর গল্প গড়িয়েছে পনেরো কিলোমিটার। আমার মতই সে হয়তো তার পৌছা সংবাদ জানিয়েছিল রিফাত কে। স্ব প্রনোদিত হয়ে নিজ হাতে রান্না করে, পনেরো কিলোমিটার ড্রাইভ করে, সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেনে মুক্তির দরজার সামনে খাবার রেখে এসেছে, আমাদের রিফাত নওরিন যে দেশেবিদেশে পত্রিকার পিঠা উৎসবের আহবায়ক ও বটে। আমার বিশ্বাস এই ক্রান্তিকালীন সময়ে সবাই যার যার জায়গা থেকে আমাদের সঞ্চয়ে লিপিবদ্ধ করছি মানবিক কাব্য যা অব্যাক্ত- অলিখিত থেকে যাবে।
আসমার ছোট ছেলেটির দুদিন থেকে সিজনাল ঠান্ডা লেগে নাক দিয়ে পানি পড়ছে। পারিবারিক ডে-কেয়ার করেন বাঙালি ভদ্রমহিলা রাত্রিবেলা ফোন করে জানালেন তিনি ভয় পেয়েছেন তার পক্ষে বাচ্চা রাখা সম্ভব নয়। পরের দিন কাজ, আসমা উদ্বেগের কথা হয়তো শেয়ার করেছেন কোন আপনজনের কাছে। সকাল আটটায় এসে হাজির হয়েছেন আখলাক হোসেনের স্ত্রী। আমার প্রিয় চাচা সমাজসেবক আখলাক হোসেন চাচীকে ড্রাইভ করে দিয়ে গেছেন আসামার বাসায়, তার ছেলেকে দেখে রাখার জন্য। যত্নে পাটকরে শড়ি পরে সুমিষ্ট ভাষায় উপস্থাপনা করে এবং আবৃত্তিকার আসমা হক দুই সন্তানের মা, তার বর্ণনা কবিতার মতই স্নিগ্ধ মনে হয়েছে। এ যেন এই দুর্যোগের মাঝে সহমর্মিতা আর ভালবাসার সোনার মোহর যা পড়ে আছে পথের ধুলায়। এই ছোট ছোট ভালবাসার কথা গুলি খুঁজে পাওয়া যাবে না বইয়ের মলাটে অথবা ফেইসবুকের আহা আর বাহার গ্রুপে, দেখা আর দেখানোপনার নাটকে। আজান হয় মসজিদে যাওয়ার জন্য। মানবতা, দায়িত্ববোধ, কর্তব্য কে আহবান করে বিবেকের আজান।
এই অস্থির সময়ে, এভাবেই একে অন্যের পাশে থাকা, কমিউনিটির মানুষের ছোট ছোট কাজে লাগা, তথ্য দিয়ে, সচেতনতার স্লোগান দিয়ে, আমাদের ঘরে রেখে চিকিৎসক-স্বাস্থ্য কর্মীদের রাত জেগে থাকা এত ভালবাসা এত যে সেবা এর মূল্য মিশে যেতে পারেনা ধরার ধুলায়। এভাবেই কালে-কালে এসেছে যত মহামারীর তরী, মানুষেই ধরেছে শক্ত হাল আঁকড়ি।
“তবু বেয়ে তরী সব ঠেলে হতে হবে পার, কানে নিয়ে নিখিলের হাহাকার,
শিরে লয়ে উন্মত্ত দুর্দিন, চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন,
হে নির্ভীক, দুঃখ অভিহত।
রাখো নিন্দাবাণী, রাখো আপন সাধুত্ব অভীমান,
শুধু একমনে হও পার এ প্রলয়-পারাবার,
নূতন সৃষ্টির উপকূলে, নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে”
মানুষের প্রগতির স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হবে আবার, করোনা ভাইরাসের কারণ উদঘাটিত হবে, মানুষেই খুঁজে বের করবে এর বশীকরণ। অবিশ্বাসী করবে বিজ্ঞানের জয়ধ্বনি, বিশ্বাসী বলবে হে ঈশ্বর হে আল্লাহ তুমি ধন্য। আর সবার ভিতরে বসে আছে যে অন্তর্জামী, বলবে হেসে হে মানব হউক চৈতন্য।
মরণব্যাধির সাথে এই যুদ্ধে কখনো জয়ী হবে জীবন, কখনো হারিয়ে দেবে মরণ। এর মাঝে অনেকেই হারাবে তাদের আপনজন। এই দুঃখ, এই ভাড়ের চেয়ে দুঃসহ আর কিছু বড় হতে পারেনা।
এমন কি কোন পেনডেমিক ভাইরাস ও না।
-হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব। লেখক, আবৃত্তিকার।
টরন্টো, ২১/৩/২০২০