লেবাননে কেমন আছেন বাংলাদেশিরা
লেবাননের একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে কাজ করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোহাম্মদ আলী। তিনি বলছিলেন, ‘গত ৩ বছর আগে কোম্পানিটিতে ৭৫ জন বাংলাদেশি মাসিক ৫০০ মার্কিন ডলার বেতনে কাজ শুরু করলেও বর্তমানে আছেন মাত্র ৭ জন। দেশটির চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় আমরা খুব কষ্টে দিন পার করছি। আমাদের অনেক সহকর্মী বাধ্য হয়ে নিজ দেশে চলে গেছেন। আগামী নির্বাচনের পরে অবস্থা পরিবর্তন না হলে আমিও দেশে চলে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
একই অবস্থা দেশটির বেসরকারি ক্লিনিং কারখানায় কাজ করা নারায়ণগঞ্জের জাকির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রতিষ্ঠান থেকে আমার কাজ চলে যাওয়ায় দীর্ঘদির বেকার ছিলাম। বর্তমানে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে মাসিক ১৫০ ডলারে কাজ করছি। গত ৩ বছর ধরে একটি টাকাও সঞ্চয় করতে পারিনি। দেশে যা সঞ্চয় করেছিলাম, সেই অর্থ দিয়েই আমার পরিবার চলেছে। এ অবস্থায় দেশে ফেরত যাওয়া ছাড়া আমার বিকল্প কোনো পথ নেই।’
এমন করুণ চিত্র লেবাননে থাকা প্রতিটি বাংলাদেশির। লেবাননে গত ২০১৯ সাল থেকে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমেছে প্রায় ৯৫ শতাংশ। জাতিসংঘের মতে দেশটিতে পাঁচজনের মধ্যে চারজন দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, করোনা মহামারিসহ রশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং ২০২০ সালে আগস্টে বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
চলতি মাসের ৩ এপ্রিল দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী সাদে সামি স্থানীয় এক টেলিভিশনে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর রিয়াদ সালামেহ তা অস্বীকার করেছেন। বিশ্বব্যাংক ধরণা করছে, লেবাননের অর্থনীতি গত তিন বছরে শতকরা ৬০ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।
গত ৩ বছর ধরে জীবন-জীবিকার তাগিদে লেবাননে আসা প্রায় দেড়লাখ বাংলাদেশি এখন কঠিন সময় পার করছেন। ইতোমধ্যেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে বৈধ-অবৈধ অনেক বাংলাদেশিই নিজ দেশে ফেরত গেছেন। এখন মাত্র ৫০ থেকে ৬০ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছেন দেশটিতে।
একদিকে ডলারের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশিরা দিশেহারা। অর্থনৈতিক মন্দার জেরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমজীবী প্রবাসীরা পড়েছেন বিপাকে। অনেকেই লেবানন ত্যাগ করে দেশে চলে গেছেন। অনেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় পাউন্ডে বেতন দেওয়ার কারণেই দেশটিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রবাসীরা। আগের ৫০০ ডলারের বেতন নেমে এসেছে ১০০ ডলারে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে পরিবারের কাছে নিয়মিত অর্থ পাঠাতে পারছেন না তারা।
কয়েকমাস ধরে দেশটিতে দেখা দিয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট। পরিবহন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। দিনে বিদ্যুৎ থাকছে মাত্র ২-৩ ঘণ্টা। সারা দিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে মোমবাতির আলোতে প্রতিদিনের কাজ সারছেন তারা। যতদিন যাচ্ছে, ততই সমস্যা প্রকট হচ্ছে।
আগামী ১৫ মে লেবাননে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনের পরে যদি অবস্থার পরিবর্তন হয়, তাহলে হয়তো আবার সুদিন ফিরতে পারে বলে আশায় রয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।