সস্ত্রীক রমাপদ চৌধুরী (বামে) রমাপদ চৌধুরী এবং সিদ্ধার্থ সিংহ (ডানে)
সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীকে আমি যে ভাবে পেয়েছি ||| সিদ্ধার্থ সিংহ
বহু দিন আগের কথা। রাধানাথ মণ্ডল তখন বেঁচে। সামনেই আমার ছেলের মুখেভাত। তাই ওর কাছে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলাম। ও বলেছিল, দেব। ফলে মুখেভাতের সাত-আট দিন আগে থেকেই অফিসে ঢুকে আমার প্রথম কাজ ছিল রাধানাথদাকে জিজ্ঞেস করা, এনেছ?
আর প্রতিদিনই ও বলত, দেরি আছে তো। কাল নিয়ে আসব।
মুখেভাতের আগের দিন যখন বললাম, এনেছ?
ও ব্যাগ-ট্যাগ হাতড়ে বলল, যাহ্, টাকাটা খামে ভরেছিলাম। তার পর ব্যাগে ভরব হলে বিছানার ওপরে রেখেছিলাম। মনে হয়, ভরতে ভুলে গেছি। বিছানার উপরেই পড়ে আছে। ঠিক আছে, কাল একবার কষ্ট করে এসে নিয়ে যেও। বলেই, বেরিয়ে পড়ল।
আমি মুখ ভার করে বসে আছি। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। এই শেষ মুহূর্তে কার কাছে হাত পাততে সাব! এমন সময় ঘরে ট্রলি নিয়ে চা ঢুকেছে। রমাপদবাবু, নিরেনদাকে চা দিয়েছে। আমার কাছে চা নিয়ে আসতেই ইশারায় বললাম, লাগবে না।
আমার কথা শুনে ঘরের কোণের দিকে চেয়ারে পা গুটিয়ে ‘দ’ হয়ে বসে থাকা রমাপদবাবু বলে উঠলেন, খান খান, চা খান।
উনি গরম কালেও ও ভাবে বসতেন। চটি পরলেও মোজা পড়তেন। গায়ে শাল জড়াতেন। কারণ, উনি একদম ঠান্ডা সহ্য করতে পারতেন না। অথচ আমাদের পুরো অফিসটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
উনি সবাইকেই ‘আপনি’ করে বলতেন। আর আমি সবাইকে দাদা সম্বোধন করলেও, এমনকী রমাপদবাবুর সব চেয়ে কাছের যে বন্ধু, যাঁদেরকে বলা হত হরিহর আত্মা, একসঙ্গে সিগারেট খেতে নামতেন, টয়লেটে গেলেও একসঙ্গেই যেতেন, রমাপদবাবুর থেকে যিনি মাত্র এক বছর দশ মাসের ছোট, সেই নিরেনদা, মানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকেও আমি নিরেনদা বলেই ডাকতাম। অথচ কেন জানি না, সেই প্রথম থেকে একমাত্র রমাপদ চৌধুরীকেই আমি ‘রমাপদবাবু’ বলতাম। এবং ভীষণ ভাবে সম্মান করতাম। ফলে উনি কোনও কিছু বললে আমার পক্ষে ‘না’ বলাটা ছিল একেবারে অসাধ্য। তাই উনি বলতেই কোনও রকমে চা খেয়ে রমাপদবাবুর কাছে গিয়ে বললাম, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। আমি বাড়ি যাচ্ছি। বলেই, ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, রমাপদবাবু বললেন, এখনই যাচ্ছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
উনি বললেন, শুনুন।
কাছে যেতেই ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, এখানে খুলবেন না। বাড়ি গিয়ে দেখবেন।
কিন্তু আমার তর সইছিল না। সোজা টয়লেটে ঢুকে ছিটকিনি তুলে খামটা খুলতেই আমি হতবাক। যে টাকাটা রাধানাথদার কাছে ধার চেয়েছিলাম, উনি তার দশ গুণ টাকা খামে ভরে আমাকে দিয়েছেন।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
রমাপদবাবুর এটিএম কার্ড আমার কাছেই থাকত। যখন যা লাগত, আমাকে বললেই আমি সেই টাকা তুলে ওঁর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতাম।
একদিন সকালে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে বললেন, শুনুন, আমার দুটো ফোনই খারাপ হয়ে গেছে। আমি কাজের মাসির মোবাইল থেকে আপনাকে ফোন করছি। যত তাড়াতাড়ি পারেন টাকা তুলে একটা মোবাইল কিনে নিয়ে আসুন তো।
দুটো ফোনের একটা বিল উনি দেন। অন্যটা আনন্দবাজার থেকে সেই কোন যুগে দিয়েছে। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যতক্ষণ খুশি কথা বলা যায়। বিল দিয়ে দেয় আনন্দবাজার সংস্থা।
তো, দুটো ফোনই যখন খারাপ হয়ে গেছে কমপ্লেন করলেও ঠিক হতে হতে অন্তত দু’-চার দিন তো লাগবেই। তাই বললাম, ঠিক আছে আমি মোবাইল কিনে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কত টাকার মধ্যে কিনব?
উনি বললেন, কিনুন না, একটা ভাল দেখে কিনুন।
আমি বললাম, তাও কী রকম বাজেটের মধ্যে?
উনি বললেন, টাকার জন্য একদম চিন্তা করবেন না। যত টাকা লাগে লাগুক। আপনি আমার জন্য একটা ভাল ফোন নিয়ে আসুন।
তাও ইতস্তত করছি দেখে উনি বললেন, বললাম তো, দামের জন্য ভাববেন না। যত টাকা লাগে নাগুক। লাগুক না, হাজার টাকা লাগুক।
সে দিন সব চেয়ে কম দামের, মানে বারোশো টাকার একটা পাতি মোবাইল কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে উনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, একটা ফোনের দাম বারোশো টাকা! তা হলে আপনার মোবাইলটার দাম কত?
আমি বলেছিলাম, ষোলো হাজার।
দাম শুনে উনি মূর্ছা যান আর কী!
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
তখন অফিস থেকে বেরোতাম রাত সওয়া একটায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে পৌনে দুটো। উঠতাম বেলা করে। একদিন সক্কালবেলায় ফোন। তুলতেই ও প্রান্তে রমাপদবাবুর গলা, উঠেছেন?
ঘুম-জড়ানো গলায় বললাম, হ্যাঁ, এই উঠছি।
উনি বললেন, এখন উঠছেন? ঠিক আছে, তা হলে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আপনি ধীরেসুস্থে আধ ঘণ্টা পরে আসুন।
তখন যে অবস্থায় ছিলাম, ঠিক সেই অবস্থাতেই যদি আমি তক্ষুনি গাড়ি নিয়ে বেরোই, আধ ঘণ্টা কেন, এক ঘণ্টাতেও পৌঁছতে পারব কি না সন্দেহ।
তবে অত সকালে যখন ফোন করেছেন, নিশ্চয়ই কোনও জরুরি দরকার। তাই তড়িঘড়ি বেরিয়ে ওঁর বাড়ি গিয়ে দেখি, ওঁর কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। খোশমেজাজে চুপচাপ সোফায় বসে আছেন। আমাকে দেখে স্ত্রীকে বললেন, সিদ্ধার্থ এসেছে, চা করো।
স্ত্রী যেই চা করতে গেলেন উনি আমাকে চুপিচুপি বললেন, একটু বেরোব।
ওঁর বেরোব মানে কি, আমি জানি। বেরিয়েই ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সিগারেটের দোকানে। ট্যাক্সিটা একটু এগিয়ে দাঁড় করাতে হয়। কারণ, ওই দোকানদার নাকি তাঁকে চেনে। সে যদি তাঁকে দেখতে পেয়ে যায় এবং তাঁর জন্য সিগারেট কেনা হয়েছে, যদি টের পায় এবং তাঁর স্ত্রীকে যদি সে-কথা সে বলে দেয়, তা হলে নাকি কেলেঙ্কারি কাণ্ড।
তো, সিগারেটের দোকান থেকে একটা ক্লাসিক, না; উনি ক্লাসিক সিগারেট ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। সেই ক্লাসিক আর একটা দেশলাই বাক্স, সঙ্গে একটা লজেন্স নিয়ে আমি ফের গাড়িতে। উঠেই, ওঁকে সিগারেট দিয়ে দেশলাইটা জ্বালাতে যাব, প্রতিবারের মতো অমনি উনি বলে উঠলেন, সাবধান। আগুনের ফুলকি যেন আমার ধুতিতে না পড়ে।
না, ফুলকি পড়লে ধুতিটা পুড়ে ফুটো হয়ে যাবে বলে নয়, ফুলকি পড়লে ওঁর স্ত্রী টের পেয়ে যাবেন, উনি সিগারেট খেয়েছেন। তাই এই সাবধানবাণী। ছিয়ানব্বই-ঊর্ধ্ব অত্যন্ত সফল একজন মানুষ যে সামান্য একটা সিগারেট খাওয়া নিয়ে বউকে এত ভয় পাবেন, ভাবা যায়!
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
আর একটা জিনিসকে উনি খুব ভয় পেতেন, সেটা হল— ইনকাম ট্যাক্স। উনি যখন ‘বনপলাশীর পদাবলী’, যে উপন্যাসটা নিয়ে উত্তমকুমার সিনেমা করার পর হইহই পড়ে গিয়েছিল, সেটার জন্য এক কোটি টাকা পুরস্কার পেলেন, তখন উনি প্রথমেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, ওই টাকায় হাত দেওয়ার আগেই ট্যাক্সটা মিটিয়ে দেবেন।
আমি বলেছিলাম, ট্যাক্স জমা দেওয়ার তো এখনও প্রচুর সময় আছে। পরে দেবেন। অত দিন এই টাকাটা ব্যাঙ্কে থাকলে কত টাকা সুদ পাবেন, জানেন?
উনি বলেছিলেন, আমি যদি কালই মরে যাই, ইনকাম ট্যাক্সের লোকেরা আমার বউকে এসে ধরবে। আমি সেটা চাই না। কারণ, ও ওগুলোর কিচ্ছুই বোঝে না।
না, উনি আর দেরি করেননি। পুরস্কারের চেকটা ক্যাশ হওয়ামাত্রই স্টেট ব্যাঙ্কে গিয়ে আগাম তেত্রিশ লক্ষ টাকা ট্যাক্স মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
উনি বছরে একটাই উপন্যাস লিখতেন। উল্টোরথের দিন লেখা শুরু করতেন। একটা কলম দিয়ে একটাই উপন্যাস লিখতেন। তার পর আর ওই কলম ব্যবহার করতেন না। তবে সব কলম নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতেন।
আমার ছেলে শুভঙ্কর সিংহ লেখালিখি করছে শুনে, যে পার্কার পেন দিয়ে উনি ‘বনপলাশীর পদাবলী’ লিখেছিলেন, যে কর্ম দিয়ে ‘লালবাঈ’ লিখেছিলেন এবং যে কলমে ‘খারিজ’ লিখেছিলেন, সেই তিনটি কলম আমার ছেলেকে দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো দিয়ে লিখো।
প্রমান হিসেবে প্যাডের পাতায় লিখেও দিয়েছিলেন, আমার ছেলের হাতে তাঁর কলম তুলে দেওয়ার কথা।
ওই কলম দিয়েই আমার ছেলে লিখেছিল তার প্রথম বেস্টসেলার বই— গড : ‘এনসিয়েন এলিয়েন্ট অর আ মিথ?’।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
একবার আমি ঠিক করেছিলাম একটা প্রকাশনা করব। শুরু করব রমাপদবাবুর বই দিয়ে। না। তাঁর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত টুকরো টাকরা লেখা দিয়ে নয়, এমন পাণ্ডুলিপি চাই, যেটা শুধু আমার প্রকাশনীর কথা ভেবেই উনি লিখবেন। সেটা অন্য কোথাও নয়, সরাসরি বই আকারে বের করব। রমাপদবাবুকে বলতেই উনি বললেন, আপনি পাবলিকেশন করবেন? ঠিক আছে, দেব।
সেই কথা মতো উনি মাঝে মাঝেই আমাকে কিছু কিছু করে পাতা লিখে দিতেন। আমি সেটা কম্পোজ করিয়ে প্রথম প্রুফটা দেখে রাখতাম। দেখতে দেখতে পুরো উপন্যাসটা ছাপা হয়ে গেল। প্রথম মুদ্রণ পাঁচশো কপি। কিন্তু যাঁকে প্রচ্ছদ আঁকতে দিয়েছিলাম, আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি করে সে এত দেরি করিয়ে দিল যে, যখন প্রচ্ছদ হাতে পেলাম, তত দিনে বাঁধাইখানার মালিক গো-ডাউন খালি করার জন্য বহু দিন ধরে স্তূপাকৃত হয়ে পড়ে থাকা ফর্মাগুলোর সঙ্গে রমাপদবাবুর উপন্যাসের শেষ ফর্মাটাও ভুল করে কিলো দরে বেচে দিয়েছেন।
উনি মাঝে মাঝেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, আপনার পাবলিকেশনের কী হল?
আমি বুঝতে পারতাম, আসলে উনি জানতে চাইছেন, ওঁর বইটার কত দূর কী হল? কবে বেরোবে?
একদিন বুক ঠুকে বলেই ফেললাম নির্মম সত্যটা। উনি বললেন, কপি নেই? কিংবা কাটা প্রুফ?
আমি বললাম, না। থাকলে তো ওটা থেকেই ফের কম্পোজ করিয়ে নিতে পারতাম।
উনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, লাস্ট ফর্মাটা তো? ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না। আমি আবার লিখে দেব। শুধু যে তিনটে ফর্মা পাওয়া গেছে, তার একটা করে সিট আমাকে দিয়ে যাবেন। কী লিখেছিলাম মনে নেই তো! একবার দেখে নিতে হবে।
কিন্তু না, উনি আর শেষ ফর্মাটা লিখে দিয়ে যেতে পারেননি। তাই ‘মঞ্জুধারা’ শুধু অপ্রকাশিত উপন্যাস হয়েই নয়, অসমাপ্ত উপন্যাস হিসেবেই রয়ে আমার কাছে গেছে। এ জন্য কটু কথা বলা দূর অস্ত, পাছে আমি দুঃখ পাই, আমার মন খারাপ হয়ে যায়, তাই ওই ‘মঞ্জুধারা’ নিয়ে উনি আমার সামনে কখনও কোনও আফসোসও করেননি।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
সরস্বতী পুজোর দিন হঠাৎ ফোন, এক্ষুনি আসুন।
আমি তড়িঘড়ি গেলাম। দরজা খুলেই উনি বললেন, আজকের দিনে মাংস খান তো?
আমি যে মাংস খেতে ভালবাসি, আমার কাছের লোকজনেরা প্রায় সকলেই তা জানেন। তাই সুচিত্রাদি, মানে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বাড়িতে মাংস হলেই, সুচিত্রাদি আমাকে দুপুরের আগেই ফোন করতেন। বলতেন, চলে আয়। আজ দারুণ মাংস হয়েছে।
আমি শুধু দুপুরেই খেতাম না। খাওয়াদাওয়া করে দুপুরে ওখানে ঘুমিয়ে অফিস যাওয়ার আগে আর একপ্রস্ত মাংস-রুটি খেয়ে তার পর অফিসে রওনা হতাম।
আমার মাংস-প্রীতির কথা রমাপদবাবুও জানতেন। কিন্তু আজ তো সরস্বতী পুজো, সবাই এ দিন আমিষ খায় না, তাই বুঝি উনি এটা জিজ্ঞেস করছেন। তাই সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, খাই।
উনি বললেন, বাঃ, খুব ভাল কথা। আসুন আসুন। আজ আমাদের বাড়িতে মাংস হয়েছে।
আমি তো দারুণ খুশি। চা এল। ঘুঘনি এল। সোনপাপড়ি এল। আইসক্রিম এল। আমি আইশক্রিম ভালবাসি বলে উনি আমার জন্য দু-তিন রকমের আইসক্রিম বার কিনে ফ্রিজে মজুদ করে রাখেন। একের পর এক খাচ্ছি। আবার চা এল।
এ দিকে আমার তাড়া আছে। সবই খাচ্ছি। কিন্তু মাংস কোথায়! সরাসরি কিছু বলতেও পারছি না। মাংসের কথা বললে আমাকে হ্যাংলা ভাবতে পারেন, তাই মাংসের কথা মনে করানোর জন্য আমি একটু ঘুরিয়ে বললাম, এ বার তা হলে উঠি?
রমাপদবাবু বললেন, ঠিক আছে, আসুন তা হলে…
বুঝতে পারলাম, উনি কী জন্য আমাকে ডেকেছেন সেটা একদম ভুলে গেছেন। তাই বউদিকে বললাম, আসি তা হলে?
উনিও বললেন, হ্যাঁ আসুন। সাবধানে যাবেন।
তখন বাধ্য হয়ে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বললাম, না, রমাপদবাবু বলছিলেন আজ নাকি কী সব মাংস-টাংস হয়েছে…
সঙ্গে সঙ্গে রমাপদবাবু বললেন, হ্যাঁ, হয়েছে তো। এই তো খেলেন।
আমি তো অবাক, আমি মাংস খেয়েছি! নিশ্চয়ই ওঁরা কোথাও একটা ভুল করছেন। তাই বিড়বিড় করে বললাম, কখন?
উনি বললেন, কেন? ঘুঘনি খাননি? ঘুঘনির মধ্যেই তো মাংসের কিমা ছিল।
এর পর আর কিছু বলার থাকে না। সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে আমি নীচে নেমে এসেছিলাম।
পর দিন সক্কালবেলায় রমাপদবাবুর ফোন, একটু দরকার আছে, আসুন তো।
গিয়ে বসতে না বসতেই দেখি, আমার সামনের টেবিলে এক বাটি মাংস। বউদি বললেন, আপনার রমাপদবাবু বললেন, আজকে মাংস করতে। বললেন, একটু বেশি করে কোরো। সিদ্ধার্থ খাবে। বউদির কথা শুনে আমি একেবারে হতবাক।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
বহু বছর পরিষ্কার করা হয় না। হলেও কোনও রকমে দেখে বোঁচকা-টোচকা বেঁধে আবার ওপরে তুলে রাখা হয়। একবার সিলিঙের ওপরে কী আছে দেখার জন্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি হঠাৎ একটা পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাই। কয়েক পাতা পড়ার পরেই বুঝতে পারি, এই লেখাটা রমাপদবাবু ছাড়া আর কারও নয়। কিন্তু হাতের লেখাটা যেন একটু কেমন কেমন এবং পাণ্ডুলিপির চেহারাটা দেখে আমার মনে হয়, এটা অপ্রকাশিত। কিন্তু কথা হচ্ছে, যে লোকটাকে বারবার তাগাদা দিয়েও লেখানো যায় না, লেখা শুরুর আগেই ‘বুক’ হয়ে যায় কোন পত্রিকায় বেরোবে, তাঁর লেখা কি কখনও এ ভাবে পড়ে থাকতে পারে!
সঙ্গে সঙ্গে রমাপদবাবুর কাছে ছুটে গেলাম। পাণ্ডুলিপিটা তাঁকে দেখালাম। উনি হাতে নিয়ে একটু উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, এটা কোথায় পেলেন?
তার পর তিনি যা বললেন, সেটা আরও চমকপ্রদ। বললেন, এটা প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে লেখা আমার আত্মজীবনীমূলক একটা গদ্য।
কিন্তু কী লিখেছেন, তা নাকি তাঁর নিজেরই মনে নেই। আমি যদি পাণ্ডুলিপিটা তাঁর কাছে দিয়েও আসি, উনি পড়বেন কী করে! আঁতস কাচ দিয়েও কি পড়তে পারবেন!
তাই ঠিক করলাম, আমার অফিস যেহেতু সন্ধ্যাবেলায়, তাই অফিস যাওয়ার আগে প্রতিদিন দুপুরে ওঁর বাড়ি গিয়ে যে-দিন যতটা পারব, ওঁকে পড়ে শোনাব। আমি শোনাতাম।
একদিন উনি বললেন, এটা যখন লিখেছিলাম, তখন তো বয়স অল্প ছিল। সব কথা অকপটে লিখেছিলাম। কিন্তু এটা যদি এখন ছাপা হয়, আমার নাতনিরা তো বড় হয়েছে, ওরা কী ভাববে!
ফলে আপত্তিকর অংশগুলো নির্মম ভাবে কেটে কেটে বাদ দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের জন্য দিয়ে দেওয়া হল দেশ পত্রিকায়। যেহেতু ওটা হারিয়ে গিয়েছিল, তাই সেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য উনি ওটার নাম দিলেন— হারানো খাতা।
পরে দু’মলাটে বন্দি হয়ে যখন আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই আকারে বেরোল, তখন দেখলাম, দীর্ঘ ছ’পাতার ভূমিকার ছত্রে ছত্রে তিনি শুধু আমার কথাই লিখেছেন।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
তখন উনি গলফ গ্রিনের বাড়িতে। ডেস্কটপ চালু হলেও ল্যাপটপ এসেছে কি আসেনি। অনেকেই টাইপ রাইটার ব্যবহার করতেন। রমাপদবাবুও করতেন। আমার ছেলে তখন খুব ছোট। স্কুল ছুটির পরে ওকে কোনও দিন নিয়ে যেতাম পরিতোষ সেনের বাড়িতে। কোনও দিন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। আবার কোনও দিন সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। সে দিন গিয়েছিলাম রমাপদবাবুর বাড়ি।
ও দূর থেকেই টাইপ রাইটার দেখে এক ছুটে সেখানে গিয়ে ঠকাস ঠকাস করে বোতামগুলোয় মারতে শুরু করেছিল। আমি খেয়াল করিনি। খবরের কাগজ ওল্টাচ্ছিলাম। রমাপদবাবু হঠাৎ ঘরে ঢুকে ওটা দেখামাত্রই এমন চিৎকার করে উঠেছিলেন যে, আমার ছেলে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে থতমত খেয়ে রমাপদবাবুর দিকে তাকাতে তাকাতে গুটিগুটি পায়ে আমার পাশে এসে চুপটি করে বসে পড়েছিল।
রমাপদবাবুর ব্যবহারে আমি বেশ মর্মাহতই হয়েছিলাম। ওঁর স্ত্রী দারুণ পুডিং বানাতেন। আমার খুব প্রিয় ছিল তাঁর হাতের পুডিং। এমন চেটেপুটে খেতাম যে, ফের অন্তত একবার, কোনও কোনও দিন দু’বার তাঁকে পুডিং দিতে হত। তবু সে দিন পুডিং না খেয়েই ছেলেকে নিয়ে আমি চলে এসেছিলাম।
পর দিন সকালে শুধু টাইপ টাইটারই নয়, সুদৃশ্য বড় একটা এল নকশার টেবিল এবং রিভলভিং চেয়ার আমার ছেলের জন্য কিনে উনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
এই হচ্ছেন রমাপদ চৌধুরী।
তখনও পরিবার বা নিকট কয়েক জন আত্মীয় ছাড়া কেউই জানেন না, রমাপদবাবু বেলভিউ ক্লিনিকে ভর্তি। আমার কাছে খবর পেয়ে রমাপদবাবুর অত্যন্ত প্রিয় পাত্রী, যিনি রমাপদবাবুর শেষ সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন, স্বপ্নরাগ পরিবারের সর্বময় কর্ত্রী, কবি কৃষ্ণা গুহ রায় ওই নার্সিংহোমে তাঁকে দেখতে এলেন। রমাপদবাবু ওঁকে তাঁর বড় মেয়ে মহুয়ার মেয়ে, মানে বড় নাতনি ভেবে বারবার ভুল করছিলেন।
উনি কিছুতেই এক ভাবে শুতে পারছিলেন না। এ পাশ ও পাশ করছিলেন। না, ছিয়ানব্বই বছর বয়সের জন্য না। শরীরটায় কোনও মাংস না থাকায় বোধহয় যে দিকেই পাশ ফিরুন না কেন, মনে হয়, হাড়ে লাগছিল। তবু তাঁকে একটু রিলিফ দেওয়ার জন্য নার্সরা নানান হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাটের মাথার দিকটা খানিক পরে পরেই উপর-নীচ করছিলেন।
বউ-মেয়ে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে?
উনি ততবারই বোঝাতে চাইছিলেন, পিঠে ব্যথা হচ্ছে। হাতে ব্যথা হচ্ছে। নাকে গোঁজা নলটার জন্য অস্বস্তি হচ্ছে। আর কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে একটা কথাই বলছিলেন, আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি দুধ-ভাত খাব।
তখন সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। দুধ-ভাত কোথায় পাব?
না, তাঁকে আর দুধ-ভাত দেওয়া যায়নি। কোনও দিন দিতেও পারব না। তবু এখনও যেন কানে বাজছে রমাপদবাবুর সেই করুণ আর্তি— আমি দুধ-ভাত খাব। আমি দুধ-ভাত খাব।
আমি যখন রমাপদবাবুর সহকারী হিসেবে আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে কাজ করতে যাই, প্রথম দিনই উনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আপনি যখন এই অফিসে ঢুকবেন, আপনার যত রাগ, ক্ষোভ, দুঃক্ষ, হা-হুতাস আছে, সব গেটের বাইরে রেখে ঢুকবেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার শত্রুও যদি ভাল লেখে, তার বাড়ি বয়ে গিয়ে লেখা নিয়ে আসবেন। আর আপনার বন্ধুর লেখা যদি নট আপ টু দ্য মার্ক হয়, তা হলে জোড় হাত করে তাকে বিদেয় করবেন।। মনে থাকবে?
তাঁর কাছে আমি যত দিন কাজ করেছি এবং পরবর্তী কালে শুধু তাঁর সঙ্গে যৌথ ভাবেই নয়, অন্য কারও সঙ্গে কিংবা একক ভাবেও যখন কোনও সংকলন সম্পাদনা করেছি, তাঁর এই উপদেশটা আমি সব সময় মনে রেখেছি। তাই আমার বারবার মনে হয়, তাঁর এই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু যে বাংলা সাহিত্যের একটা অপূরণীয় ক্ষতি হল, তাই-ই নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল সম্পাদনার স্বর্ণযুগ।