যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গে ||| মাসুদ রানা
৩ মার্চ রাজশাহী শহর মিছিলের শহরে পরিনত হয়। মিছিলকারীরা মিছল নিয়ে মালোপাড়ার শেষ প্রান্তে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে আসলে, টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। গুলিবর্ষণে একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এদিন ভূবনমোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সংগ্রামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। তাদের গুলিতে ঘটনা স্থানেই জাফর আলী নামক একজন ব্যবসায়ী নিহত হন এবং ১০০ জনের অধিক আহত হয়।
৩ মার্চ থেকে প্রকৃত অর্থে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দখল নিচ্ছে বলে এই দিন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। রাজারবাগ সদর দফতরের চারদিকে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হতে থাকে। সবার উদ্দেশ্য ছিল, ‘উদ্দেশ্য সামরিক জান্তাকে প্রতিহত করা।’ পরে ঘটনাটি গুজব প্রমাণিত হলে ছাত্র-জনতা শান্ত হয়ে রাজারবাগ ত্যাগ করে।
২ মার্চ সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যা এবং সন্ধ্যা আইনের নিন্দা জানিয়ে ঢাকা সহ পূর্ব বঙ্গের সকল প্রদেশ ও শহরে প্রতিবাদ ও শোক মিছিল করা হয়। ৩ মার্চ সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে বটতলায় প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধূরীর সভাপতিত্বে আয়োজিত হয় এক প্রতিবাদ সভা। সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পূর্ণ আস্তা জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনতার সঙ্গে এক হয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়া হয়। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮ জন শিক্ষক বিবৃতিতে শোষক ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দেশবাসীকে আহবান জানান।
৩ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ আয়েজিত পল্টন ময়দানের জনসভায় অসহযোগ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। কর্মসূচীতে সিদ্ধান্ত হয়, ‘৩ মার্চ থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালন করা হবে। হরতালের সময় সরকারি অফিস, কোট-কাচারি, কল কারখানা, যানবাহন, রেল ষ্টিমার, বিমান সহ সব কিছু বন্ধ থাকবে।’ হরতালের সময় গরীব দুঃখীদের সাহায্য করার জন্য বেলা ২ টার পরে রিক্সাওয়ালাদের বেশি পয়সা দেয়ার জন্য তিনি জনসাধারণকে অনুরোধ জানান।
বঙ্গবন্ধু জনগনকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘সামরিক বাহিনীকে ব্যরাকে ফিরিয়ে না নেওয়া হয়; তাদের অত্যাচার বন্ধ না করা হয়; জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয়; তাহলে আজ থেকে সকল ধরনের ট্রাক্স প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।’ তিনি ঘোষণা দেন, ‘যদি ইতোমধ্যে সরকারি মনোভাব পরিবর্তন না হয়, তাহলে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
৩ মার্চ পল্টনের ঐতিহাসিক সভায় স্বাধীন বাঙলা দেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়।
বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্যে কয়েকটি কর্মপন্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। কর্মপন্থাগুলো ছিল-
১) বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, মহল্লা, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করতে হবে।
২) সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
৩) শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন করতে হবে।
৪) হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালী-অবাঙালী সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
৫) স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃংখলার সাথে এগিয়ে নিয়ে বাবার জন্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে এবং লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজ বিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
উক্ত কর্মপন্থায় উল্লেখ হয় যে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক।’ এখানে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাঙলাদেশ’ গঠন আন্দোলনের এ পর্যায়ে নিম্নলিখিত জয়ধ্বনি ব্যবহৃত হবে-
- স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ দীর্ঘজীবি হউক;
- স্বাধীন কর, স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর;
- স্বাধীন বাংলার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব;
- গ্রামে গ্রামে দূর্গ কর, মুক্তিবাহিনী গঠন কর;
- বীর বাংগালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর
- মুক্তি যদি পেতে চাও, বাংগালীরা এক হও
এই দিন জনসভায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই জনসভায় পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ শক্তির লেলিয়ে দেওয়া সশস্ত্র সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালীদের উপর গুলিবর্ষণের ফলে নিহত বাঙালী ভাইদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে এবং পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ শক্তির সেনাবাহিনীর এই জঘন্য হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তোলার জন্য আহবান জানানিয়ে; পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের কবল হইতে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিয়া স্বাধীন বাংলাদেশে কৃষক-শ্রমিক রাজ কয়েমের শপথ গ্রহণ করে; স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁর সকল সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং দলমত নির্বিশেষে বাঙলার প্রতিটি নর নারীকে তার নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতা চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
এই দিন পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলায় ছাত্র-জনতা হরতাল পালন করার সময়; ছাত্র-জনতা মিছিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করেন।
৩ মার্চ রাজশাহী শহর মিছিলের শহরে পরিনত হয়। মিছিলকারীরা মিছল নিয়ে মালোপাড়ার শেষ প্রান্তে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে আসলে, টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। গুলিবর্ষণে একজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এদিন ভূবনমোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সংগ্রামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। তাদের গুলিতে ঘটনা স্থানেই জাফর আলী নামক একজন ব্যবসায়ী নিহত হন এবং ১০০ জনের অধিক আহত হয়।
এই দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহীর স্থানীয় সামরিক কতৃপক্ষ ৩ মার্চ সন্ধা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে। রাত সাড়ে ১০টার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে কোন প্রকার অবহিত না করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করে টহল দিতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী শামসুজ্জোহা হলের তালা ভেঙ্গে হলে প্রবেশ করে সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়।
খুলনাতে সকল স্থানের মতো এই দিন হরতাল পালিত হয়। সকাল থেকে মিছিল নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা হাদিস পার্কে জমা হতে থাকেন। খালিশপুর শিল্প এলাকা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক জনতা পার্কে সমাবেত হওয়ার হলে দুপুরে সেখান থেকে বিশাল একটি মিছিল হাদিস পার্কের পানির ট্যাংকের পাশের লোয়ার যশোর রোড ধরে সার্কিট হাউসের দিকে যাওয়ার পথে টেলিয়োন এক্সচেঞ্জ ভবনের কাছে মিছিলের উপর পাকিস্তানি সেনারা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত ও ৩৭ জন আহত হয়।
দৌলতপুর থেকে ছাত্রনেতা ইউনুস আলী ইনু ও শরীফ খসরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি মিছিল খুলনা শহরে মিছিল করে ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত হয়। এই সব ঘটনার পরিপেক্ষিতে ৩ মার্চ থেকে খুলনা শহরে কারফিউ জারি করা হয়।
৩ মার্চ সিলেটে হরতাল চলাকালিন সময়ে সিলেট নয়াসড়ক খাড়ঞ্চি বাড়িতে অবস্থিত তৎকালীন ই.পি.আর সেক্টর সদর দফতর থেকে ছাত্র চাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সন্ধা ৭টা থেকে সিলেট শহরে ১২ ঘন্টার জন্য সন্ধ্যা আইন জারি করা হয়। সন্ধ্যা আইনের বিরোধিতা করে ছাত্র-জনতা রাজপথে নামলে ৩৩ জন গ্রেফতার হয়।
চট্টগ্রামে ৩ মার্চ থেকে সন্ধ্যা আইন জারি করা হয়। এদিন ঝাউতলা পাহাড়তলী ওয়েরলেস কলোনীতে বাঙালি অবাঙালি বিহারীদের মধ্যে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। বিহারিরা নারীদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। এসময় পাকিস্তানি নৌবাহিনীর গুলিতে ভিক্টোরিয়া জুটমিলসের শ্রমিক আবুল কালাম নিহত হয়। তার লাশ নিয়ে ছাত্র-জনতা মিছিল করেন।
এই দিন সারাদেশ সামরিক বাহিনীর গুলিতে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর একটি ইউনিট বাঙালি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করায় কোর্ট মার্শালে মৃত্যুবরণ করে।
৪ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বলা হয়, ‘ঢাকায় গত দুই দিনে ২৩ জন নিহত ও তিন শতাধিক আহত’ পত্রিকায় আরো বলা হয়, ‘রংপুর ও সিলেটে কারফিউ জারি; রংপুরে আড়াইটা থেকে ২৪ ঘন্টাব্যাপী সন্ধ্যা আইন জারি।’
লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা