সেতু || ঋভু চট্টোপাধ্যায়
খবরটা চাওড় হতে বেশি দেরি হলনা। চেনা জানা প্রায় প্রত্যেকেই একথা সে’কথার মাঝে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে সুমনদার খবর শুনেছিস?’ শুনে থাকলে ঘাড় নাড়িয়ে বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ শুনলাম, শালা গাণ্ডু ছেলে একটা।’ না শুনে থাকলে ‘না রে বা না গো, কি ব্যাপার বল তো, আবার কিছু করল নাকি?’ আসলে আমাদের ডেলিপ্যাসেঞ্জারির গ্রুপে সুমনদা মানেই খবর, আর খবর মানে হাসি। সবাইকে যদি হাসতে হয় বা হাসির কথা মনে রাখতে হয় তবে আমাদের কাছে দাদাই টাটকা হাসির খোরাক। মানছি লোকটার কিছুটা সমস্যা আছে। তবে ঠিক মাথার সমস্যা বলা যাবেনা। প্রযুক্তিগত সমস্যা আছে, টেকনিক্যাল প্রবলেম।
গোড়ালির ওপরে প্যান্ট, বেল্ট, মোজা ছাড়া ফুল’ শু, ইনকরা ফুল শার্ট, পেতে ছাড়ানো চুল, ডানদিকে ব্যাগ। যেখানে নটার ট্রেনে চেপে দিব্যি সাড়ে দশটায় স্কুল যাওয়া যায়, সেখানে সুমনদা যায় সাতটার ট্রেনে। বাড়ি থেকে আট কিমি সাইকেল চালিয়ে স্টেশন, সেখান থেকে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে আবার এগারো কিমি সাইকেল চালিয়ে স্কুল যায়। যাতায়াত নিয়ে প্রতিদিন গড়ে আটত্রিশ কিমি সাইকেল। যে কোন লোক শুনলেই চমকে ওঠে।
আমাদের মধ্যে সব থেকে কম বয়সের দীপু বলে, ‘দাদা তুমি ঝুড়ি কিনেছ? কয়েকমাসের মধ্যেই মাথায় ঝুড়ি করে নিয়ে যেতে হবে তো।’
সুমনদা খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করে,‘কি ভাই?’
-না মানে সাতটা মহাসাগরের জল প্রস্থে প্রবেশ করবে তো, তাই।
একদিন আমিও বললাম,‘দাদা গো বয়স বাড়ছে প্রতিদিন এই রকম চল্লিশ কিমি সাইকেল করা ঠিক নয়।’
-চল্লিশ নয় তো, আটত্রিশ। প্রতিদিন গড়ে দু’কিমি কম, মাসে ষাট কিমি, বছরে……
-থাক, দাদা বুঝে গেছি।
-না ভাই এই সব ছোটখোটো ব্যাপারগুলো খুব ক্রুশিয়াল। তুমি দেখ না কত দোকানে মালের দামে নিরানব্বই বা উনচল্লিশ থাকে।একটাকা খুব ভয়ানক।
-দাদা আমার ঘাট হয়েছে তোমাকে বলা।
তবে সুমনদার মহিলাদের প্রতি আগ্রহ একটু বেশি রকমের বেশি। কারণে অকারণে বিভিন্ন মহিলাদের সম্পর্কে আলোচনার পাশে তার ঠিকুজি কুষ্ঠির প্রতিও দাদার খুব ঝোঁক। আমাদের স্টেশন দিয়ে যত মহিলা যাতায়াত করেন তাদের প্রত্যেকের ডেটাবেশ দাদার কাছে লোডেড্। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই ‘ও ঐ মেয়েটা তো? নতুন পল্লিতে থাকে।বাপের বাড়ি কেষ্টপুর, হাসবেন্ট পুলিশ।একটা ছোট মেয়ে আছে, এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি।’
রানাদা আমাদের মধ্যে খুব সোজাসাপ্টা কথা বলে। সুমনদা রানাদাকে দেখেই চমকে ওঠে, পালিয়ে যায়, এড়িয়ে যায়। রানাদা আবার সুমনদাকে দেখতে পেলেই ডাকে, ‘এই শালা শোন। বিয়ে কবে করবি? বয়স তো চল্লিশ ছাড়ালো।’
সুমনদা যতই পালাবার রাস্তা খোঁজে রানাদা ততই তাকে জাপটে ধরে বসিয়ে, বকবক আরম্ভ করে। ‘শোন্ সুমন ঈশ্বর তোকে ভালোবেসে একটা যন্ত্র দিয়েছে সেটা তো ব্যবহার করতে হবে। মরলে ভগবান যখন জিজ্ঞেস করবে কি উত্তর দিবি? তোকে একটা কবিতা পড়াব, ‘টু হিস কয় মিসট্রেস’, এসব কথা বলেছে।’
অন্য কেউ হলে সুমনদা বলত, ‘আসলে ভাই ঈশ্বরের দেওয়া সব জিনিস পত্র কি ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারি। ঈশ্বর তো হৃদয়ও দিয়েছেন আমার ওটাকে ডাস্টবিন বানিয়ে রেখে দিয়েছি। আর তুমি যা বলছ ওখানে তো স্বয়ং ভগবানের বাস। লিঙ্গ নিজেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে শক্তি, সাহসকে বোঝায়, আর যোনি হল সৃষ্টি, জরায়ু তো নারী-শক্তি। দুটো মিলেই তো পৃথিবী।’
-সেটাই তো বলছি। তুমি সেই শক্তিকেই ব্যবহার করছ না।
-ভাই, এই লিঙ্গের এগারোটা আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে, জানো কি?
আমরা থাকলে সুমনদা এভাবেই বলে। রানাদা থাকলে দৌড়ে পালায়। তবে সুমনদা সবাইকে অবাক করে দেয় যেদিন বলে,‘বিয়ে না করা মানে কি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহার না করা?’
-কি কি আরেকবার বল। কথাগুলো মনোজ বলে, বয়সে সুমনদার থেকে দশ-বারো বছরের ছোট। কিন্তু ঐ সমস্যা, ডেলি প্যাসেঞ্জার।
-না মানে শরীরে অনেক অঙ্গ রয়েছে তো অঙ্গ মানে শুধু তো…………….
-তুমি কথা ঘোরাবে না, তুমি কাদায় পড়ে এখন ঢোঁক গিলছ? আচ্ছা ট্রেনে আমাদের প্লাটফর্ম ঢোকার আগে মেয়েগুলো স্নান করে, তুমি দেখেছ?
-হ্যাঁ। তা না দেখার কি রয়েছে।
‘ব্যাটা জাতে মাতাল। সেই সুজয়দা আছে না সুমনদার বন্ধু, ঐ ব্যাটারও বিয়ে হয়নি। মোবাইল ভর্তি পানু। ট্রেনে কোণে বসে বসে এ’দুটো ঐসব দেখে।’
-এই ভাই এই সব বলা ঠিক নয়। আমি এই সব দেখিনা মনোজ।
-ডাকব সুজয়দাকে।
-মনোজ ছাড়।
সঙ্গে সঙ্গে সন্তু প্রশ্ন করে, ‘সুমনদা আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করব? তুমি সেইদিন মেয়েদের টয়লেটে কেন গেছিলে?
-সন্তু ছাড়।সুমনদা বলে।
সন্তু শেষের কথাগুলো এক্কেবারে ক্রিম। একসাথে সবাই লুফে নিয়ে বলে উঠল,‘সে কি বলছিস, রে কবে বলিসনি তো।’
-নয়নকে বলেছিলাম। চারপাঁচদিন আগে। আমি পরের ট্রেনটাতে আসছি, দেখি ট্রেনের গার্ডটা চেল্লাচ্ছে। আমি ‘কি হল?’জিজ্ঞেস করতেই বললেন,‘দেখুন ঐ ভদ্রলোক লেডিস টয়লেটে ঢুকেছেন। ’আমি কাছে যেতেই দেখি সুমনদা।
-শোনো সন্তু, সেদিনের ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা। আসলে খুব পেয়ে গেছিল। চেপে রাখতে পারিনি, কেউ তো ছিল না।
-সে তো আমাদের স্টেশনে সেরকম কেউ থাকেনা সুমনদা।
ও সব কথা বলা ও শোনার মাঝেই মনোজ যে বোমাটা ফাটালো সেটার জন্যে ঠিক তৈরী ছিলাম না। মনোজের সাথে ট্রেনের একই কামরায় ফেরবার সময় কথাগুলো শুনলাম। ‘মালটার কি হয়েছে বল তো?’
-কেন, আবার কি হল?
-মালটা তো বাড়ি থেকে সাইকেল করে প্রতিদিন স্টেশনে আসে, তারপর এই এ.টি.এম.কাউন্টারটার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক ভাবে বাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-কতক্ষণ?
-আরে সেটাই তো রহস্য।
প্রদীপ বলে,‘সাড়ে সাতটার মধ্যে চলে আসে।’
-সাড়ে সাতটা! মালটা ফুল ম্যাড হয়ে গেছে।
-তারপর শোনো কয়েকদিন আগে গেটের মুখে টিটি ধরেছিল।
-কে বন্ধন?
-কে তা জানিনা, আমাকে নিজেই বলছিল,‘ও নাকি লাইন পেরিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে এসে লেডিস কামরার দিকে একভাবে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।ব্যাস রেলপুলিশ ধরে ফাইন নেয়।’
-কিছু বলেনি খ্যাপাটা।
-ও কিছু বলেনি, তবে পুলিশ আর টিটিরা নাকি বলেছে, ‘আপনার মত ভদ্রলোক একটাও আমরা দেখিনি, কোন আর্গুমেন্ট ছাড়াই টাকা বের করে দিলেন বিশাল ব্যপার তো।’
এত দূর পর্যন্ত সুমনদা আমাদের যাতায়াতের সময় কাটাবার খোরাক। অবশ্য তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি কিছুই আলাদা বিষয় নয়। আলোচনা আরো জমে ক্ষীর হল যেদিন সন্তু এসে সুমনদার ঐ অপেক্ষা করবার কথা বলে।প্রতিবারের মত আমি খবরটা শুনলাম সব থেকে শেষে। তবে সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি তাকেই জিজ্ঞেস করে দিলাম,‘কি ব্যাপার বলতো, কি সব কথা শোনা যাচ্ছে, তুমি কি সত্যিই কোন প্রেম টেম করছ নাকি?’
-না ভাই। এই বুড়ো বয়সে প্রেম করবার কোন মানসিকতা নেই। চাপও নিতে পারব না।
-তাহলে তুমি এই এ. টি.এম কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখ?
-মানুষ গুনি ক’জনার মাথায় চুল আছে, ক’জনের নেই, ক’জনের ভূঁড়ি আছে এইসব আর কি।
-খ্যাপাগিরি কোরো না, বল।
-সুমনদা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে, ‘ভাই তুমি জান তো আমার একমাত্র বোন মারা গেছে।’
-শুনেছিলাম।সকালে মেয়েকে দিতে গিয়ে, স্কুলের গেটে মারা যায়।
-তার একটা মেয়ে আছে। বোনের হাসবেন্ট তো চাকরি করে, তাই স্কুল না থাকলে ওর বাবা বাসে চাপিয়ে দেয়। আমি স্টেশনে নামিয়ে আমাদের রুটের বাসে চাপিয়ে দি।এইখানে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করি।।
-তাই বলে প্রতিদিন!
-প্রতিদিন নয় তো, সবাই বানিয়ে বানিয়ে বলে।
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
-স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি দাঁড়িয়ে থাকলে তুমিও নজর রেখো।
কয়েকবছর আগে সুমনদার বোন যখন আচমকা মারা যায়, কয়েকমাস সুমনদা দাড়ি কাটেনি। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম,‘কি দাদা, দাড়ি কাটোনি কেন?’ সেই হাসিমুখেই জবাব দিয়েছিল, ‘ভাই দাড়ি গোঁফ থাকলে বোনটাইতো বলত। ও যখন চলে গেল…………….’
কয়েকদিন পরে স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখি সেই এ.টি.এম কাউন্টারের কাছে দাদা দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু গোপনে সুমনদাকে দেখতে লাগলাম। মিনিট দশ পরে চৌদ্দ নম্বর বাস এলে সুমনদা ছুটে গিয়ে বাস থেকে একটা তিন সাড়েতিন বছরের মেয়েকে নামিয়ে আরেকটা বাসে তুলে দিল। আমার সামনে কোথা থেকে একটা লম্বা সেতু খুলে গেল। দুই প্রান্তেই মানুষ, আর মানুষ। সুমনদাকে দেখলাম সেতুর ওপর দিয়ে হাঁঠতে হাঁটতে ভাগ্নির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে।
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান