দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ ৭ উদ্দেশ্যে সংবিধান সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ।
আর এ সংস্কার করা সংবিধান পাস বা অনুমোদন দিতে কোনো নির্বাচিত সরকার বা পার্লামেন্টের প্রয়োজন হবে না, এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ সংবিধানের বৈধতা দেবে বলে জানিয়েছেন সংস্কার কমিটির অন্যতম সদস্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মাহফুজ আলম।
ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা দেখতে চায় না সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে গঠিত কমিশন। একই সঙ্গে সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর অভাবনীয় এককেন্দ্রিকক্ষমতা হ্রাস করা, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা এবং ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান রোধ করার মতো সুপারিশ থাকবে সংবিধান সংস্কার কমিশনের।
রোববার বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের লক্ষ্য ও রূপরেখা তুলে ধরেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময় কমিশনের সদস্য ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, সদস্য অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, ফিরোজ আহমেদ ও মো. মুসতাইন বিল্লাহ প্রমুখ।
সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলী রীয়াজ বলেন- ক. দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। খ. ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। গ. রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা। ঘ. ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধ। ঙ. রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা এবং বিচার বিভাগের পৃথক্করণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন। চ. রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন। ছ. রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ করবো লিখিত মতামত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানোর জন্য। সরকার বিভিন্ন কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। ফলে কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে না। কিন্তু তাদের দেয়া প্রতিটি লিখিত প্রস্তাব ও মতামত কমিশন নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করবে এবং কমিশনের সুপারিশে তার যথাসাধ্য প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট থাকবে।
লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংস্কারের পরিধি নিয়ে বলেন, সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত হবে বর্তমান সংবিধান পর্যালোচনাসহ জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের লক্ষ্যে সংবিধানের সামগ্রিক সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন, পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্লিখন।
সাংবিধানিক সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো হবে সুপারিশে। পাশাপাশি রাজনীতি এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা, ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান রোধ, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের পৃথক্করণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, রাষ্ট্র ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়নের সুপারিশ থাকবে কমিশনের।
পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ থাকবে বলে জানায় কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন সংস্কারের সুপারিশ তৈরিতে বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত ও প্রস্তাব গ্রহণ করবে। পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের মতামত ও প্রস্তাব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। সংস্কারের অংশ হিসেবে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের লিখিত মতামত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ করবে। সুপারিশ পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে কমিশন।
এ ছাড়া সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি, তরুণ চিন্তাবিদ, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করবে।
এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনায় বসবে কমিশন।
তবে, যেসব ব্যক্তি, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বা দল জুলাই-আগস্ট ছাত্র- জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় সক্রিয়ভাবে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিল, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নকে সমর্থন করেছে, ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমকে বৈধতা প্রদানে সহযোগিতা করেছে কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ তৈরিতে যুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্র : মানবজমিন