শ্রদ্ধেয় স্যারদের সঙ্গে কিছুটা সময় এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ – ২
৩১. ১.২০১৯ । শ্রদ্ধেয় খোরেশ খাঁন স্যারের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ী ছুটছে অন্যখানে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই ১৯৭২ সালে জন্ম নিয়েছিলো মফঃস্বল শহরের জন্য সর্বচ্চো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কমলগঞ্জ গণ মহাবিদ্যালয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের প্রতিকুল অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন শ্রী রসময় মোহান্ত । অর্থ নয়, এলাকার মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসে অনেক অনেক ভালো সরকারী কাজের জন্য মনোনিত হবার পরও সেসব কাজে যাননি। সেই মানবতার তীর্থচারী আমার স্যার রসময় মোহান্ত স্যারের বাড়িতে। স্যার শুধু একজন শিক্ষাবিদই নন, একজন লেখক, গবেষক। পুরো পরিবারই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নানা পেশায় কর্মরত। অনেক্ষণ স্যারের বাড়িতে থেকে তাঁর লেখা বেশ ক’টি গ্রন্থ নিয়ে ফেরার পথে থেমে গেলাম এক জায়গায়। আমার শৈশব জীবনের স্মৃতিঘেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শংকর পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। যে স্কুলে দুটি বছর কেটেছে। সে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি, অনেক তিক্ত ঘটনাপ্রবাহ। যদি না লিখি তাহলে হয়তো অসমাপ্ত থেকেই যাবে…।
১৯৭১ দেশ স্বাধীন হবার পর অটোপ্রমোশনে ক্লাস থ্রিতে ওঠি। লেখাপড়া দুরন্তপনায় আবার মেথে ওঠি, ধীরে ধীরে যুদ্ধের ক্ষত বিক্ষত বিধ্বস্ত দিনের কথা ভুলতে থাকি। কমলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই।
সুযোগ পেলেই সারা দিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে গ্রামের রাখালদের সঙ্গে গল্প করতাম, হাডুডু, মারবেল, ডাংগুলি খেলতাম। রাখালদের সঙ্গে মাঠের ধুলাবালিতে নানা রকম খেলাধুলা গড়াগড়ি, খালে-পুকুরে সাঁতার কাটা কিংবা গাছ থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত থাকতাম। গ্রামের রাখালরা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। নিরক্ষর, সাধারণ গ্রামের ছেলে হলেও রাখালরা ছিল অসাধারণ। এমন বড় মনের প্রকৃত বন্ধুরা জীবনে আর কখনো পাইনি। এসব বন্ধুরা গাছের একটি আম খেলেও একা খেত না। যতই অভুক্ত থাকুক না কেন সবাইকে নিয়েই খেত। গাছ থেকে পাখির বাচ্চা ধরে আনতাম। এটা ছিল আমার নেশা। আর এ পাখির বাচ্চা ধরতে গিয়ে কত বিপদে পড়তে হয়েছে আর বাবার হাতে কত মার খেতে হয়েছে।
কমলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রতিদিনই বলতে গেলে স্কুল ফাঁকি দেওয়ার কারণে আমাকে ভর্তি করা হলো আমাদের বাড়ির সামনেই খিন্নী গাঙের ওপারে শংকরপুর প্রাইমারি স্কুলে। সেই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সম্পর্কে বাবার ভাগনে আমাদের গ্রামের বড় ভাই জ্ঞানেন্দ্র দেব শ্যামলদা। তিনিই আমাকে সঙ্গে করে শংকরপুর স্কুলে নিয়ে যেতেন। বৃষ্টির দিনে কিংবা বর্ষা মৌসুমে আমাকে কোলে করে কখনো কাঁধে তুলে খিন্নি গাঙ পার করাতেন। বর্ষার মৌসুমে হাতে ধরে ধরে রেল লাইনের ব্রিজটি পার করে স্কুলে নিয়ে যেতেন আর নিয়ে আসতেন। এভাবেই শ্যামলদাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি দুটি বছর, যা আজও ভুলতে পারিনি। শ্যামলদার কাছে আজও ঋণী হয়ে আছি, বিনম্র শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি।
ধান খেতের আল ধরে স্কুলে যেতাম। স্কুলে যেতে যত না ভয় ছিল, তার চেয়ে ভয় ছিল জোঁক আর সাপের। ধানের খেতের আল কাদা আর ঘাসে ভরা ছিল। ঘাস আর কাদার মাঝেই থাকত জোঁক আর সাপ। তাই কোনো অজুহাতে চেষ্টা করতাম স্কুল পালানোর জন্য। সত্যি কথা বলতে কী আমার একটুও ভালো লাগত না স্কুল যেতে। স্কুলে না যাওয়ার জন্য অকারণে কত কেঁদেছি, কত রকমারি ফন্দি বানিয়েছি।
বলতে গেলে কয়েক যুগ পর স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গিয়ে নষ্টালজিয়ায় ভুগতে হলো। ফিরে গেলাম সেই শৈশবের ফেলে আসা দুরন্ত স্মৃতির মিনারে। স্কুলের অনেকটা উন্নতি হলেও আমার মনের ভিতরের স্মৃতিচিহ্ন একটুও পরিবর্তন হয়নি।
শংকরপুর স্কুলের স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে চলছি। গাড়ী ছুটছে, সবার সঙ্গে কমলগঞ্জ বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের আরও এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জইন উদ্দীন স্যারের বাড়িতে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে স্যারের সঙ্গে অতীতের কতো ঘটনাপ্রবাহ আর স্মৃতিরোমমন্থন করতে করতেই ফিরতে হলো নতুন ঠিকানায়।
সকালে বের হয়েছিলাম দুপুরে শেষ বেলায় এসে ভানুগাছ বাজারে বসবাসরত আমার কলেজ জীবনের স্মৃতিঘেরা মানুষ অধ্যাপক/অধ্যক্ষ মোহন চদ্র দেব স্যারের বাসায় যাই। স্যার বিভিন্ন অসুখে নতজানু হয়ে বিচানায়। দেখামাত্র উঠে বসার চেষ্টা করলেন। ( আমি দেশ থেকে ফিরার কয়েক মাস পরেই স্যার চলে যান না ফেরার দেশে) স্যারকে নিয়ে রয়েছে অনেক ইতিহাস।
সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ১৯৭২ সালে জন্ম নেওয়া মফঃস্বলের আশার আলো কমলগঞ্জ গণ মহাবিদ্যালয় জন্ম নেওয়ার পর কলেজের শিক্ষকদেরকে বেতন দেওয়ার মতো কলেজের ক্ষমতা ছিলোনা। তখন এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদেরকে নিয়ে বেশ কয়েকবার সভা হয় কি করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চালানো যায়, বাঁচানো যায়। যারা জন্মলগ্নে কলেজের বিভিন্ন পদে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা বিশাল হৃদয় নিয়েই দিয়েছিলেন। শিক্ষকদের নামমাত্র সম্মানী ভাতা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চালানো হতো। তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও ছিলোনা। ফলে কলেজ এলাকার শিক্ষানুরাগী পরিবারগুলো কয়েকজন শিক্ষককে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এর মধ্যে আমাদের বাড়িতে পৃথক পৃথকভাবে দু’জন শিক্ষককে বেশ কয়েক বছর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিলো। এরমধ্যে প্রথমজন ছিলেন অধ্যাপক/অধ্যক্ষ নিরঞ্জন দাস যিনি কয়েকবছর পূর্বে মন্ট্রিয়লে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক/ অধ্যক্ষ মোহন চন্দ্র দেব। একমাত্র কলেজের অধ্যক্ষ রসময় মোহান্ত স্যার ছাড়া সব স্যারের বাড়িই ছিলো কমলগঞ্জের বাহিরে। স্যাররা আমাদের বাড়িতে থেকেছেন বিনিময়ে কিছুটা হলেও আমাদেরকে লেখাপড়া করতে সহায়তা করতেন। স্যারদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
# শ্রদ্ধেয় স্যারদের সঙ্গে কিছুটা সময় এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ – ২ । সদেরা সুজন, প্রধান নির্বাহী- সিবিএনএ
এস এস/সিএ
দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে CBNA24.com
সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
আমাদের ফেসবুক পেজ https://www.facebook.com/deshdiganta.cbna24 লাইক দিন এবং অভিমত জানান