আবাহনীর দুঃসময়ের কাণ্ডারি কাজী শাহেদ আহমেদ
তানজীম আহমেদ।। বাংলাদেশের আধুনিক সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক দৈনিক আজকের কাগজের প্রকাশক ও সম্পাদক, জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গণের প্রতিও মনোযোগী ছিলেন সৃষ্টিশীল এই উদ্যোক্তা। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি। দেশের প্রথম আধুনিক ক্লাব আবাহনী লিমিটেডের ডিরেক্টর ইনচার্জ হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন কাজী শাহেদ আহমেদ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নির্মম মৃত্যুর পর তৎকালিন আবাহনী ক্রীড়া চক্র দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অনেকের রোষাণলে পড়ে দল পরিচালনা ছিল কঠিন। ঠিক সেসময় কাজী শাহেদ আহমেদ এসে অন্যদের সঙ্গে আবাহনীর হাল ধরতে শুরু করেন। এরপরই একটু একটু করে প্রয়াত শেখ কামালের হাতে গড়া দলটি সঠিক দিশা পায়।
সেই সময় আবাহনী লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদসহ অন্যদের সঙ্গে ক্লাব পরিচালনায়। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে হারুনুর রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন আবাহনীর দুঃসময়ের কাণ্ডারি। যখন ক্লাবের খারাপ অবস্থা যাচ্ছিলো উনি এসে অন্যদের সঙ্গে হাল ধরেন। এতে করে সবাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করে। বিশেষ করে ওই সময়ে একজন আর্মি অফিসার আবাহনীর ক্লাব পরিচালনায় এসেছেন তা ছিল আমাদের কাছে বড় প্রেরণার বিষয়।’
ক্লাবকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনে কাজী শাহেদের অবদানের কথা আরও তুলে ধরে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আজ আবাহনীর এতো সাফল্য পাওয়ার পেছনে কাজী শাহেদের অনেক অবদান। তিনি সরাসরি খেলোয়াড় চিনতেন। মাঠে এসে খেলা দেখতেন। তিনি ছিলেন দারুণ উদ্যোমী একজন সংগঠক। তার মৃত্যুতে জাতি আজ সুযোগ্য একজন সংগঠক হারালো।’
আবাহনীর ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক ও ক্লাবটির সাবেক পরিচালক আব্দুস সাদেকও শুরু থেকে সবকিছু দেখেছেন। তিনি শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এই তো ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মদিনে ক্লাবে গিয়েছিলাম। তখন কাজী নাবিল, কাজী আনিস ও কাজী ইনামের সঙ্গে কথা হলো। কাজী শাহেদ আহমেদ কেমন আছেন জানতে চাইলাম। আগে থেকেই জানতাম শারীরিকভাবে অসুস্থ। ব্যাংককেও দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওরাও তাই বলছিল। তার মৃত্যুর খবর শুনে অনেক খারাপ লাগছে।’
৭৫ পরবর্তী সময়ে কাজী শাহেদের অবদানের কথা তুলে ধরে সাদেক বলছিলেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদ খারাপ অবস্থায় আবাহনীর পরিচালনায় এসেছিলেন। দুঃসময়ে ক্লাবের পাশে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। শামসুল ইসলাম ও কাজী শাহেদ আহমেদসহ অন্যরা মিলে খারাপ সময়ে আবাহনী আগলে রেখেছিলেন। আমরা কাজী শাহেদের বাসায়ও মিটিং করেছিলাম। ক্লাব গঠনে তার অবদান অনেক। এটা বলতেই হবে।’
কাজী শাহেদ আহমেদে মাঠের প্রতি ভালোবাসা নিয়েও সাদেক বলছিলেন, ‘মাঠেও নিয়মিত দেখা যেত তাকে। তার বড় ছেলে কাজী নাবিলসহ অন্যদের নিয়ে আবাহনীর প্রশিক্ষণ দেখতে আসতেন। খেলোয়াড়দের চিনতেন। দিকনির্দেশনা দিতেন। দল কীভাবে ভালো করবে তা নিয়ে বলতেন। বলতে পারেন আবাহনী অন্তঃপ্রাণ একজন ছিলেন তিনি।’
বাংলাদেশ ফুটবর ফেডারেশন (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও খুব কাছ থেকে প্রয়াত কাজী শাহেদ আহমেদকে দেখেছেন। উনার মৃত্যুর খবর শুনে তিনি অনেকটা স্তম্ভিত হয়ে বলেন, ‘কাজী শাহেদ আহমেদ একজন ভালো সংগঠক ছিলেন। আবাহনীর দুঃসময়ে এসে ক্লাব পরিচালনায় যুক্ত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে অনেক খারাপ লাগছে। আজ আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
আবাহনী ক্লাব পুনর্গঠনে দুই জনের অনুরোধে যুক্ত হন কাজী শাহেদ আহমেদ। তিনি তার আত্মজীবনী ‘জীবনের শিলালিপি’ তে উল্লেখ করেছেন, ‘মোমেনুদ্দিন আহমেদ ও আবাহনী ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি হারুন এলো। তারা দুজনেই অনুরোধ করলো আবাহনী ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হতে। আবাহনী ধানমন্ডির ক্লাব, আর আমি ধানমন্ডির জামাই। তাই আবাহনীর প্রতি আমার দায়িত্ব আছে– এইরকম কথা বলে আমাকে দুর্বল করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তারা নাছোরবান্দার মতোই লেগেই থাকলো। প্রায়ই আসতে লাগলো আমার কাছে।’
কাজী শাহেদ আহমেদ লিখেন, ‘শেষ পর্যন্ত তাদের অনুরোধে একদিন আবাহনী ক্লাবে গেলাম। ক্লাব বলতে একটি মাত্র ঘর, তাও ছাদ নেই। হারুন কোনোরকমে আবাহনীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ডা. মুসাও আবাহনীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। সব দেখে-টেখে সিদ্ধান্ত নিলাম আবাহনীতে প্রাণ সঞ্চার করবো। এজন্য সবার আগে দরকার টাকার।’
আবাহনী ও মোহামেডানের খেলা নিয়ে কাজী শাহেদ আহমেদ আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন, ‘খেলা শেষে মারামারি অবধারিত। আবাহনী-মোহামেডানের সমর্থকরা পিটাপিটি করে কমসে কম রাত ১০টা পর্যন্ত। আর ওদিকে তখন আবাহনী-মোহামেডানের সব খেলোয়ার কোনও হোটেল বা কোনও রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে বসে স্যুপ বা চায়নিজ খাচ্ছে আর হুল্লোড় করছে।’ -সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন