জীবন ও স্বাস্থ্য

গণস্বাস্থ্য কিট: বিজ্ঞানটাকে বাঁচতে দিন

গণস্বাস্থ্য কিট: বিজ্ঞানটাকে বাঁচতে দিন


নজিরবিহীন মাত্রার আলোচনা, টকশো, সাক্ষাৎকারে গণস্বাস্থ্যের টেস্ট কিট এখন বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে  রীতিমত সেলেব্রেটি। সাফল্যের একের পর এক দাবীর আড়ালে  টেস্ট কিটের পেছনে যে বিজ্ঞান তা লজ্জিতবদনে রীতিমত নির্বাসনে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার পেশাদারিত্ব দারুণভাবে ব্যাহত হয় যদি প্রতিদিনই  টিভি বা সংবাদপত্রে নিউজ হতে থাকে। ফলাফলের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত না হয়ে খণ্ডিত অংশে মিডিয়া নির্ভর প্রচারণা আসলে বিজ্ঞানটাকেই মেরে ফেলে।  বাংলাদেশে কোভিড  সংকটের প্রথম দিকে গণস্বাস্থ্যের ঘোষণা এন্টিবডি  টেস্ট কিট উদ্ভাবন। এই মুহূর্তে বিশ্বে শত শত প্রতিষ্ঠান এন্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে  কোভিড যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত; শুধু  যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ১২০ টি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী এন্টিবডি  টেস্টের উপচে পড়া আত্মপ্রকাশের মধ্য থেকে সত্যিকারের অর্থে কার্যকরী টেস্ট কিট পাবার জন্যে  যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, সিডিসি এবং এনআইএইচের মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে  মান  নিয়ন্ত্রণে কঠোর  অবস্থানে যেতে হয়েছে।এদের মধ্যে বাংলাদেশের একটি কিট উদ্ভাবন তো খুবই সন্মানের বিষয়। যদিও সর্বসম্মতভাবে  সব দেশই  রোগ নির্ণয়ের  ক্ষেত্রে নিউক্লিক এসিড  নির্ভর টেস্ট (আরটিপিসিআর) অন্যদিকে  গবেষণা আর পরিস্থিতি মূল্যায়নে সেরোলজিক্যাল বা এন্টিবডি টেস্টের  সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এন্টিবডি টেস্ট কিটের ঘোষণার পর হঠাৎ সংবাদ সম্মেলনে গণস্বাস্থ্য জানান দিল এন্টিজেন টেস্টের কথা। সংবাদ সম্মেলনে এন্টিবডি  এন্টিজেন টেস্ট একই স্যাম্পল  বা একই কিটে কিনা এই প্রশ্নের  উত্তর  দিতে সক্ষম হননি উত্তরদাতা। কিছুদিন পর জানানো হল স্যালাইভা থেকে এন্টিজেন টেস্টের এবং এটিও জানানো হল এই ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ পাইওনিয়ার। মিডিয়াতে মহা হৈচৈ। এই অবস্থায় দেখা গেল কোটি কোটি মানুষের কোভিড নির্ণয়ে ব্যবহৃত গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে দাড়িয়ে থাকা আরটিপিসিআর টেস্টকে অবমূল্যায়ন করে স্যালাইভা থেকে  উদ্ভাবিত এন্টিজেন টেস্টের গুণকীর্তন শুরু। দুইদিন পরেই  এই এন্টিজেন টেস্টের ট্রায়াল বাতিল ঘোষণা এবং কেবল এন্টিবডি টেস্টের ট্রায়াল চলবে। এন্টিবডি টেস্টে বিশ্বের শত শত প্রতিষ্ঠানের একটি হয়ে পর্বতের মূষিক প্রসব।  সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনরা উদ্বেগের সাথে পরিস্থিতি দেখছিলেন। উদ্বেগের কারণ হল গবেষণা জগতের লাইফ লাইন পিয়ার রিভিউ, প্রেজেন্টেশন, সায়েন্টিফিক ডিসকাশনে অনীহার পাশাপাশি মিডিয়া ভিত্তিক  প্রচারণা। মিডিয়াতে যেভাবে সবকিছু উপস্থাপন করা হচ্ছে, আবেগাপ্লুত  হচ্ছে,  দাবীর মধ্যে অহরহ অসামঞ্জস্যতা ফুটে উঠছে, এগুলো তো বিজ্ঞান গবেষকদের শুদ্ধাচার নয়। ইতিমধ্যে দেশের পত্র পত্রিকায়  কলাম লিখে দেশী-অভিবাসী সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অপেশাদার সুলভ এই আচরণে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। এই সব দেখে ভাবছিলাম কিট নিয়ে হচ্ছেটা কি? এই অবস্থায় দেশে আর প্রবাসে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ আর  নিজ নিজ পেশার আলোকিত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলি।

ডাঃ শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর, জাপানের ইহিমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, গবেষণা আর  জাপানের  কর্পোরেট জগত মিলিয়ে হেপাটাইটিস ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন ৩২ বছর যাবৎ। হেপাটাইটিস চিকিৎসায় নাসভ্যাক ড্রাগের উদ্ভাবক ডাঃ আকবর ইউরো এশিয়ান জার্নাল অব হেপাটোগ্যাস্ট্রো এনট্রোলজির প্রধান সম্পাদক। ডাঃ আকবর বাংলাদেশে কোভিড গবেষণায় জড়িত। ডাঃ আকবর বিডিনিউজ ২৪ এ এক সাক্ষাৎকারে  এই কিট উদ্ভাবনে আন্তর্জাতিক শুদ্ধতার মানদণ্ডের গুরুতর ঘাটতি, সঠিক ডাটা প্রদানে অস্বচ্ছতা, বিভিন্ন টেস্ট পদ্ধতি নিয়ে অসত্য কথন আর বিজ্ঞান গবেষণায়  অপেশাদারিত্বে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গণস্বাস্থ্যের রক্ত থেকে এন্টিজেন টেস্টের অদ্ভুত ধারনায়  বিস্মিত হন ডাঃ আকবর।

ডঃ এস আশরাফ আহমেদ,  সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৌশলগত একটি ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে শিক্ষকতা, জাপানের  কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানের শীর্ষস্থানীয় একটি ল্যাব থেকে পিএইচডি, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অব হেলথে দীর্ঘ গবেষক ক্যারিয়ারের একজন আলোকিত বাংলাদেশী। মাইক্রোবিয়াল বায়োকেমিস্ট্রির এই বিশেষজ্ঞ একজন লেখক, লিখছেন করোনা নিয়ে। ডঃ  আশরাফের মতে কিট উদ্ভাবন নিয়ে গণস্বাস্থ্যের এপ্রোচ  বিজ্ঞান গবেষণার মানদণ্ডে সুখকর কোন অভিজ্ঞতা নয়,  গোঁজামিলের চেষ্টা স্পষ্ট। বিজ্ঞান বিষয়ে স্বচ্ছতা অপরিহার্য। প্রচারণা নয়, ফলাফলই চূড়ান্ত বিচার্য।

ডঃ এজাজ মামুন, সেল বায়োলজি  নিয়ে পড়াশুনা আর গবেষণা, এখন অস্ট্রেলিয়া সরকারের কর্মকর্তা। প্রায়ই উপসম্পাদকীয় লিখেন ইত্তেফাকে। কিট নিয়ে  গণস্বাস্থ্যের  অনেক দাবীর বিষয়ে অবাক হয়েছেন বৈকি; অপেশাদার সুলভ আচরণে স্পষ্টতই বিরক্ত। বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণাকে বিশ্ব মানদণ্ডে উন্নীত করার চাইতে প্রচারণা নির্ভর দাবী শুভ লক্ষণ নয় বলে মনে করেন।

রাষ্ট্রীয় পদক প্রাপ্ত  আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন  বিজ্ঞানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম মলিকুলার বায়োলজি বিশেষজ্ঞ। নিজ বিভাগের বায়োটেক ল্যাবের  RTPCR মেশিন  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে  হস্তান্তর করে কোভিড  ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করছেন। গবেষণা করছেন কোভিড বিষয়েও। কিট নিয়ে গণস্বাস্থ্যের আচরণ বৈশ্বিক মানদণ্ডের সাথে মেলাতে পারছেন না এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণায় এধরণের অপেশাদার আচরণকে দেখছেন অশনি সংকেত হিসেবে। কিট  উদ্ভাবনের বিভিন্ন স্তরে গণস্বাস্থ্যের বক্তব্যের অসঙ্গতিতে  বিব্রত।

ডঃ মাহবুবা খাতুন সিদ্দিকা,  বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কানাডার  গুয়েলফ  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে পিএইচডি করার সময় কাজ করেন ভাইরাস ডিটেকশন এবং জীন বৈশিষ্টের উপর। জার্মানির থেকে এমএস করার সময় গবেষণা করেন RNA  ভাইরাস সিকোয়েন্সিং এবং ক্যাপ্সিড প্রোটিনের উপর।  পোস্টডক করেন  নেক্সট জেনারেশন RNA  সিকোয়েন্সিং এর  উপর। গণস্বাস্থ্যের কিট উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন এই বিজ্ঞানী।  কিট উদ্ভাবনে কাজের চেয়ে অতিকথন আর বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে অসন্তুষ্ট  এই  অধ্যাপক। প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতার দিক থেকে গণস্বাস্থ্যের অনেক  বক্তব্যের  সাথে একমত নন।  কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রে কাজের অভিজ্ঞতায় গণস্বাস্থ্যের অনেক  দাবীর সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান।

কথা বলেছি লাইফ সায়েন্সে কানাডার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাকমাস্টারের গবেষক বিজ্ঞানী ডঃ  এম ফিরোজ মিয়ার সাথে। ডঃ ফিরোজ Immunology & Infectious Diseases বিষয়ে ম্যাকমাস্টারে গবেষণা করছেন  ১৭ বছর যাবৎ।

ডঃ ফিরোজের মতে dot blot immunoassay kit  ১৮-২০ বছর আগে ব্যবহৃত হতো এন্টিবডি টেস্ট করতে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এ ধরনের কিটের আবেদন কম, ব্যাপক false positive ও false negative ফলাফল দেয়।  তারপরেও গণস্বাস্থ্য GR rapid dot blot COVID-19 kit নিয়ে উৎসুক ছিলেন তিনি। গণস্বাস্থ্য কিট বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্যে ডঃ ফিরোজ বিস্মিত। প্রথমে বলা হল কিটটি কোভিড রোগীর রক্ত থেকে১০-১৫ মিনিটে ভাইরাসের Antibody নির্ণয় করবে, কিন্তু কিট হস্তান্তরের সময় বললেন কিটটি Antibody ও Antigen একসাথে সনাক্ত করতে সক্ষম করে তৈরি করা হয়েছে। রক্ত থেকে এন্টিজেন নির্ণয়ের ধারনাটি ছিল প্রযুক্তিগতভাবে হাস্যকর, পরে  Antigen নির্ণয় অংশটি বাদ দিতে BSMMU কে অনুরোধ করেছে গণস্বাস্থ্য। এরপর নিয়ে আসলেন স্যালাইভা থেকে এন্টিজেন  নির্ণয়ের ধারণা। আবার স্যামপ্লিং সমস্যায় BSMMU কে এটি স্থগিত রাখতেও অনুরোধ।  এতে সন্দেহ হয় যে কিটটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই বিভ্রান্ত কিনা?

ডঃ ফিরোজ আরও বলেন স্যালাইভা থেকে এন্টিজেন পাবার আইডিয়াটি বিশ্বে প্রথম,এরকম দাবী  অপরিপক্ব ও অসত্য। স্যালাইভাতে SARS-CoV-2 ভাইরাল লোড বেশী থাকে এবং এটি নিয়ে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়-শেঞ্জেন হাসপাতাল, চীনের গবেষণাকর্ম Lancet Infect Dis (2020; 20: 565–74) জার্নালে  প্রকাশিত হয়েছে। স্যালাইভা নিয়ে  এধরণের অনেক পাব্লিকেশনে রয়েছে।  ইতোমধ্যে Yale Uinversity ও Rutgers University গবেষকদল  স্যালাইভা এন্টিজেন  টেস্ট  গবেষণায় সফল হয়েছে এবং Quidel Corporation (Rutgers Univ) FDA অনুমোদন পেয়েছে। ন্যাসাল কেভিটির বদলে স্যালাইভা থেকে স্যাম্পল সংগ্রহে এফডিএ  অনুমোদন দিয়েছে। স্যালাইভা এন্টিজেন টেস্টে  বেশ ফলস নেগেটিভ  ফলাফল  আসে বিধায় RTPCR টেস্টে নিশ্চিত করতে বলেছে এফডিএ।

কোভিড যুদ্ধে লড়ছে পুরো বিশ্ব আর মানবতা। আজতক অর্জিত লাইফ সায়েন্সের অগ্রগতির সবটুকু ঢেলে দিয়ে লড়ছে প্রযুক্তি টেস্টিং সক্ষমতা উন্নয়নে, ড্রাগ আর ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনে। গণস্বাস্থ্যের সফলতা মানে বাংলাদেশের সফলতা। এই মুহূর্তে এন্টিবডি টেস্ট কিটের একটি সম্ভাবনার সামনে দাড়িয়ে গণস্বাস্থ্য। বিশ্বে একই ধরণের শত শত টেস্ট থাকলেও নিজেদেরটির গৌরব অন্যরকম। গবেষণা কর্মে বাংলাদেশের আভিজাত্যের বলয়ে প্রবেশ করার সময় এসেছে। প্রচারণার দৌড়ে থাকলে মর্যাদা কম্প্রোমাইজ হয়, বিজ্ঞান পিছিয়ে যায়। বিজ্ঞান গবেষণায় শুদ্ধাচার আর পেশাদারিত্ব আভিজাত্য আর মর্যাদার ইমিউনিটিতে  বিজ্ঞানটাকে বাঁচিয়ে রাখে।

লেখকঃ কলামিস্ট  এবং মাইক্রোবিয়াল বায়োটেক  বিষয়ে  মন্ট্রিয়লে বহুজাতিক কর্পোরেটে  ডিরেক্টর পদে কর্মরত।    

সি/এসএস


সর্বশেষ সংবাদ

দেশ-বিদেশের টাটকা খবর আর অন্যান্য সংবাদপত্র পড়তে হলে cbna24.com

সুন্দর সুন্দর ভিডিও দেখতে হলে প্লিজ আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন