গ্রাম আমার অহংকার ||| প্রজ্ঞা চৌধুরী প্রাপ্তি
” শান্ত সুনিবিড় স্নিগ্ধ প্রবীর আমার দেশের গাঁও
চাহিদার চেয়ে কতো বেশি ঢের পাওয়া যায় তাতে ফাও “
বাবা-র রচিত দু’চরণ দিয়ে করছি যে লেখা শুরু
গাঁও নিয়ে আছে যতো কথা জানি লিখে যাবো আজ পুরো।
আমি গ্রামের মেয়ে তাই গ্রাম আমার অহংকার। আমি যে গ্রামে জন্মেছি তার নাম পাগুলিয়া। এটি মৌলভীবাজার জেলা সদরের শহর সংলগ্ন ঢাকা – সিলেট মহা সড়কের পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া একটি গ্রাম। এ গ্রামের দক্ষিণে কোদালি ছড়া নামক ছোট নদী বহমান। আমার গ্রাম প্রকৃতির এক লীলা ক্ষেত্র। গ্রীষ্মের খরতাপ, বর্ষায় মেঘমেদুর শ্যামল ছায়া, শরতের শুভ্র আকাশ, হেমন্তের সোনালী ফসল, শীতের কুয়াশা, বসন্তের পুষ্প সম্ভারে ভরপুর ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় আমার এ গ্রাম। শহরতলীর এ গাঁয়ে জন্মে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। এখানে ভোরের পাখির কলতানে সূর্যোদয়ের পূর্বাহ্নে যেমন জেগে উঠা যায় তেমনি রাত্রি নিশিথে বৃক্ষরাজির নিরবতায় নিদ্রিত হওয়া যায়। বর্ষায় টিনের চালে রিম ঝিমিয়ে বৃষ্টি পড়ার টাপুর টুপুর শব্দ, কলসি কাঁকে পুকুর ঘাটে জল ভরতে যাওয়া বালিকা বঁধুর নূপুর নিক্কণ সদৃশ মনে হয়। পূর্বপুরুষের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে গ্রামের ঐতিহ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে চলছি নিরন্তর সম্মুখের যাত্রা পথে। প্রত্যাশা করি গ্রাম বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য মহিমায় অবগাহন করে জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত যেন আনন্দ মধুরতায় কেটে যায়।
আমার আজকের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় গ্রাম এবং গ্রামের মানুষ। সুতরাং দেশ ও জাতির চালিকা শক্তি হিসাবে গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে ফুটিয়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চলমান থাকবে আমার লেখায়। সর্ব সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গ্রামের সংখ্যা ৮৭,১৯১ টি। হাওর-বাওর, নদী-পাহাড়, বিল-ঝিল বিধৌত গ্রাম বাংলার মেহনতী মানুষের হাড় খাটা পরিশ্রম এ দেশের আপামর মানুষের আহার সংস্থানে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাতী, কামার-কুমার প্রভৃতি পেশার প্রায় শতভাগ মানুষ গ্রামীণ জনপদে জন্মগ্রহণকারী। এদের শ্রম ঘামে হয় অন্নের সংস্থান। গ্রামীণ সমাজে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অট্টালিকার সমারোহ নেই। আধা পাকা কিংবা কাঁচা ঘরেই অধিকাংশ মানুষের বাস। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। এদের না আছে ভালো পোশাক, না সুচিকিৎসার ব্যবস্থা কিংবা ভালো লেখাপড়ার সুযোগ। যা আছে তা হলো দৃঢ় মনোবল। নিঃস্ব রিক্ত যারা তাদেরও মনের জুড়ের কমতি নেই। বজ্র কঠিন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তারা মাঠে ঘাটে জীবন যুদ্ধের হাতিয়ারকে সঙ্গী করে উৎপাদন উন্নয়নে সর্বদা ভুমিকা রাখছেন। আর্থিক দৈনতার কারণে চকচকে রঙিন মোড়কে আঁটানো ফলের বাসী জুস খেতে পারেন না হয়তো কিন্তু প্রকৃতি প্রদত্ত টাটকা খাবার এদের ভাগ্যেই জুটে যা অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত এবং রোগ প্রতিরোধক। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কোভিড উনিশ নামক যে মহামারী পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয় তাতে গ্রামের কৃষক মজুর জেলে তথা খেটে খাওয়া মানুষেরা তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ থাকতে সক্ষম হয় পরিশ্রমী দেহের প্রতিরোধী শক্তি বেশি বলে। তাদের বৃষ্টি ভেজা রোদে জ্বলা দেহের পরিশ্রমে উৎপাদিত শস্য পন্য ভোগ করেই শহুরে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তরা জীবন ধারণ করে থাকেন অথচ যাদের তরে জীবন রক্ষা তাদেরকেই অনেকে অচ্যুত অন্ত্যজ মনে করে থাকেন। এটা নির্ধিধায় নিন্দার্হ বিষয়। ধনীক শ্রেণির টাকার পাহাড় থাকতে পারে কিন্তু টাকা চিবিয়ে খেতে পারবেন না। ফসলের মাঠে নেমে চাষাবাদ করা কিংবা জলাশয়ে নেমে মৎস্য শিকার করতে পারবেন না। কৃষক মজুর জেলেরা হচ্ছে প্রকৃত অন্নদাতা, এদের বাস সবুজ শ্যমল গ্রামে। তাই গ্রাম এবং গ্রামের মানুষকে অবহেলা নয়। ওরাই দেশটাকে বাঁচিয়ে রাখছে। তাই আসুন আমরা মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়ণ করি, অবমূল্যায়ন নয়।
২৯.০৪.২০২২ খ্রিস্টাব্দ।