যার ভিটে আছে বাড়ি নেই
তার ঠিকানা ভূপৃষ্ঠে
তার ঠিকানা ধূলোয়
তার ঠিকানা মাটিতে
বীজের মতোন মন্ত্রগুপ্তি নিয়ে সে
গেরিলার মতোন ওপেন সিক্রেট
মাটির শহিদ
একদিন অনুকূল পানিহাওয়ায়
মহীরুহের মতোন মহাবনস্পতির মতোন
তিলে তিলে গড়ে উঠবে সে
তিলে তিলে বেড়ে উঠবে
তিলে তিলে জেগে উঠবে,—
আশায় আশায় অপেক্ষায়
আশায় আশায় থাকি
আশায় আশায় রাখি
আমি আমার আশাকে মাইনের মতো পুঁতি
আমি আমার আশাকে বীজের মতো এম্বুশ করি
একটা জায়গা তো আছে, বীজতলা, স্বভূমি
হারিয়ে যায়নি, বেহাত হয়নি, তাই রাখি
কী জানি, না-থাকে যদি, কী হতো—আছে বলে
কথা, তার কন্ঠস্বর শুনি, ভাষা উঠে আসে
আমার বিশ্বাসের ভিত মজবুত, আমি নাস্তিক না
একদিন তার সাথে দেখা হবে, আমি আস্তিক
একদিন তার দেখা পাব, স্বপ্ন বুনি
আমি তাকে দেখি, কল্পনায়, সব্বোনাশে নয়
আমার সামনে জেগে ওঠে বিন্যাসে, ভেসে আসে বাস্তবে
( ফুল-পাখি-লতা-পাতা জিইয়ে থাকে, হয়তো মানুষ নয়
মানুষের চেয়ে এই অমানুষেরা ভয়ঙ্কর নয়, সুন্দর )
আমার চিন্তায়-মননে বিকশিত, সুশোভিত, প্রতিস্থাপিত
পুরনো দিনের স্মৃতিরা সে মাটিতে ঘুমিয়ে আছে
হারানো দিনের কথারা সে আলো-হাওয়ায় বাঙ্ময়
ফেলে আসা দিনরাত্তির আনাগোনা করে
বুকের বিবরে, কবরে নয়—ভুবনে সফরে
ওকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না
আমার অমূল্য অখন্ড ভূখণ্ড থেকে
সে আমার প্রপিতামহীর মানচিত্র
আমার পূর্বপুরুষের রেখাচিত্র
আমার মৌলিক পরিচয়, আত্মপরিচিতি
পড়ে থাক, খালি পড়ে থাক, শূন্য হোক
আমার এ জন্মের তীর্থ দর্শন হয়ে থাক
রূপে-রূপান্তরে জন্মে-জন্মান্তরে বহুজন্মে স্থাপিত থাক
কেউ না-থাকুক, ফুল-পাখি-লতা-পাতারা তো আছে
নিরন্তর থাকবে ওরা
আদিতেও ছিল, আজও আছে, আগামীতেও থাকবে
সহজাত ওরাই সতেজ হয়ে ফুটুক
আজন্ম ওরাই সতেজ হয়ে থাকুক
তীব্র হয়ে উঠুক
একছত্র অধিপতি হোক
ওরাই আমার আদিপ্রাণ
সহজ সরল আদিপুরুষ
আমার আদিম মঙ্গল
না-হয়, এবার আবার আমার উত্তরাধিকার
জয়তু, ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল
নিসর্গের স্বর্গপুরী, প্রকৃতির স্বপ্নপুরী
সহজাত বসতবাটি, প্রিয় ঘরবসতি
ওখানে হাত দিলে আমার নাড়ী
ওখানে হাত দিলে আমার ভিটে
ওখানে হাত দিলে আমার মাটি
ওখানে হাত দিলে আমি টের পাই—
একদা নয় একদিন নয় আজও এখনও
ঘেরা থাক বা না-থাক, বেড়া থাক বা না-থাক
মানবের চোখে, মানুষের চোখে
অনন্ত-অসীম অধীর দাঁড়িয়ে
কয়লা আর ছাইভস্ম থেকে কালো হাত থেকে পাকহানাদার আর তার দোসরদের কবল থেকে উন্নত শিরে দাঁড়ানো উনিশ শ একাত্তর পেরুনো বিজয়ী বাড়িটি আমার প্রত্ননীড় নয় নষ্টনীড় নয় ভস্মীভূত নয়—রত্ননীড় প্রিয়নীড় গহীননীড় জীবননীড় যাপননীড় স্বকৃতনীড় প্রাণের নীড় আত্মনীড় ।
আমি জানি, লোকে বলে—হয়তোবা মাথা গোঁজার ঠাঁই—কিংবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত—আর আমি বলি—এই অবিনশ্বর পিতৃঋণ-মাতৃঋণ—এই রক্তের ঋণ—এই নশ্বর মানবজমিনে—এ আমার প্রিয় অবিনশ্বর—অবিকল্প মহার্ঘ নূহের নৌকা !